প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ জুলাই তিন দিনের সফরে চীনের রাজধানী বেইজিং যাচ্ছেন। মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি ভারত সফর করে এসেছেন। ভারতের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে চীনের প্রসঙ্গও উঠেছিল। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক নিয়ে ‘নিশ্চিন্ত’ হতে চায় নয়াদিল্লি। এ অবস্থায় সফরকালে নয়াদিল্লি-বেইজিংয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রয়েছে ঢাকার কর্মকর্তাদের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন ও ভারত উভয় দেশই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দুই ধরনের। বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে রয়েছে ভারত। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ভূ-রাজনীতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে চীনের সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে ঢাকা।
এ প্রসঙ্গে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘চীন-ভারত উভয় দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশ ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেই চলছে। উভয় পক্ষের সংবেদনশীলতা ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় নিয়ে ঢাকাকে এগোতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না করায় বাংলাদেশ বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রেখে সেচকাজের মেগা প্রকল্প করার পরিকল্পনা করেছে। ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের এই ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’য় চীনের অর্থায়ন করার কথা ছিল। গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিষয়গুলো এমনই ছিল।
কিন্তু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পরই ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা ঢাকা সফরের সময় তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অর্থায়নের আগ্রহের কথা জানান। সে সময় ভারতের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা দ্য হিন্দু তিস্তা প্রকল্প নিয়ে দিল্লি-বেইজিংয়ের এই ‘টানাটানি’ নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত তার পর থেকেই দিল্লি-বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ঢাকার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা নিয়ে আলোচনা বেশি হচ্ছে কূটনৈতিক মহলে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরেও ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি আলোচিত হয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ঘিরে ভূ-রাজনীতি নিয়েও ভারত ও চীনের মধ্যে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। ভারত চায় ইন্দো-প্যাসিফিকে বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকুক। চীনের প্রত্যাশাও বাংলাদেশ তার সঙ্গে থাকবে। ফলে এশিয়ার ন্যাটো বলে পরিচিত জোট কোয়াডে ভারত চাইলেও ‘চীনের কারণে’ বাংলাদেশ যোগ দেয়নি। কোয়াড অর্থ চতুর্ভুজ এবং ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র এই জোটের সদস্য।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘কোয়াড পুরোপুরি চীনবিরোধী একটা জোট। আমাদের দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখা দরকার। ভারত আমাদের তিন দিকে বেষ্টন করে আছে। আবার চীন ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। মায়ানমারে বাংলাদেশের বিরাট স্বার্থ রয়েছে এবং চীনই একমাত্র দেশ, যাদের মায়ানমার সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে এসব নিয়ে ভালো অ্যাসেসমেন্ট করতে পারব প্রধানমন্ত্রী চীন সফর শেষ করে আসার পর।’
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঝুঁকিও দেখছেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে গত রবিবার তিনি বলেছেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ যে সঙ্গে আছে সেটা নয়াদিল্লি দেখাতে চাইছে বলে আমার মনে হয়। যেহেতু দেশ দুটির রেষারেষি বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে, তাই ঢাকার জন্য বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণও বটে।’
সোমবার ঢাকা সফররত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লি জিয়ান চাওয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আজ শুধু উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়নি।’
সফরকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বেইজিং
চার দিনের সফরে ঢাকায় অবস্থান করছেন চীনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী লি জিয়ান চাও। তিনি চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের চীনা এই মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের জন্য অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি। সফরটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা আশাবাদী। প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের জন্য আমরা খুবই উন্মুখ। সুতরাং আমাদের অনেক প্রত্যাশা আছে এবং আমি নিশ্চিত যে আমাদের দুই সরকার আগামীতে আমাদের দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার জন্য একটি সাধারণ পরিকল্পনা তৈরি করবে।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে চীনা এই মন্ত্রী জানান, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, সম্পর্কের ইতিহাস এবং বন্ধুত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে গভীর ও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ১৯৭৫ সাল থেকে ৫০ বছর ধরে সম্পর্ক অটুট আছে।’
চীন বাংলাদেশ অবকাঠামো, কৃষি, বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে মন্তব্য করে লি জিয়ান চাও বলেন, ‘চীন প্রতিবেশী এবং আধুনিকীকরণের অভিযাত্রার অংশীদার হিসেবে একটি ব্র্যান্ড। আমরা এসব কাজ করব বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কাঠামোর মধ্যে থেকে।’
সম্প্রতি শেখ হাসিনার আসন্ন সফর সম্পর্কে এক সেমিনারে এক প্রশ্নের উত্তরে ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সফর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হবে। এটি হবে একটি গেম চেঞ্জার। এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।’
শীর্ষ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে যা থাকছে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেইজিং সফরকালে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা ও চারটি দলিল সই হতে পারে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই), বাণিজ্য সহযোগিতা, বিনিয়োগ সুরক্ষা ডিজিটাল অর্থনীতি, সমুদ্র অর্থনীতি এবং মৈত্রী সেতু নির্মাণ ও সংস্কার।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে আলোচনা হতে পারে তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়ন ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়েও। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা ঢাকার অন্যতম মূল এজেন্ডা। মায়ানমারের ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে বিপাকে পড়া বাংলাদেশকে সবচেয়ে ভালো সহযোগিতা দিতে পারে চীন। কারণ মায়ানমারের সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি- উভয়ের সঙ্গে দেশটির ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া বিআরআই-জিডিআই নিয়েও আলোচনা হবে।
শীর্ষ বৈঠকে আলোচনার অন্যতম বিষয় হিসেবে রয়েছে চীনের ৭০০ কোটি ডলারের ঋণ। এর মধ্যে ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ স্থানীয় মুদ্রায় (টাকা-ইউয়ান) দিতে চায় দেশটি। শীর্ষ বৈঠকে বিষয়টির ফয়সালা হতে পারে।