![চট্টগ্রামের এমপিদের বিরুদ্ধে জামায়াতকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ](uploads/2024/04/01/1711947095.Jamayat-islami.jpg)
গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের জামায়াতের তৎপরতা বেড়েছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে তা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে স্থানীয় এমপিদের প্রশ্রয়ে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা এখন প্রকাশ্যে দলে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের। তাই দলীয় নেতাদের উপজেলা চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা।
রবিবার (৩১ মার্চ) চট্টগ্রামের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অভ্যন্তরীণ সভায় এসব বিষয় উঠে আসে। তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই বিভাগের সংসদ সদস্য, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুবউল আলম হানিফ, দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।
সভা সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে জামায়াতের তৎপরতা বেড়েছে দাবি করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকার প্রতীক ও দলীয় প্রার্থী দেবে না- ঠিক আছে। তবে আমার কক্সবাজার জেলায় সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াতের যেভাবে তৎপরতা বেড়েছে, আওয়ামী লীগ যদি দলের একক প্রার্থী না দেয় তাহলে উপজেলাগুলো তাদের প্রার্থীদের হাতে চলে যাবে। তাই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে আমি এর সমাধান চাইছি।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেছেন, তৃণমূলে দলের কোথায় কী সমস্যা রয়েছে, তা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিলে কেন্দ্র দেখবে। জানতে চাইলে ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘এটি আমাদের দলের অভ্যন্তরীণ সভা। সভায় অনেক কথাই হবে, সব তো বাইরে বলা যাবে না। আপনি আমাদের কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে জানতে পারেন।’
চট্টগ্রামে জামায়াতের ইস্যুটি নিয়ে গত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এই আলোচনায় ‘ঘি’ ঢেলে দেন সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম-১৫ আসন) আসনের দুবারের সাবেক এমপি আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী।
গত মার্চের ২১ তারিখে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম-১৫ আসনের বর্তমান এমপি এম এ মোতালেবকে একহাত নেন ওই আসনের সাবেক এমপি নেজামুদ্দিন নদভী। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমপি এম এ মোতালেবের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সমঝোতার অভিযোগ তোলেন।
আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে সাবেক এমপি নদভী বলেন, ‘হয়তো তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে ভোটে আমাকে ঠেকালে উপজেলার নির্বাচনে তাদের (জামায়াত) সুযোগ দেওয়া হবে। কারণ এখন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তাদের সক্রিয় দেখা যাচ্ছে কেন? আমার সময়ে তো জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা এলাকায় ছিল না। এখন হাজার হাজার ক্যাডার সবাই মাঠে কেন? তিনি (এম এ মোতালেব) আওয়ামী লীগের না, স্বতন্ত্র এমপি। তার ছোট ভাই মাওলানা মাহমুদুল হক জামায়াতের সিনিয়র নেতা।’
নদভী বলেন, ‘নির্বাচনের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত এমপির প্রত্যক্ষ মদদে তার উগ্র সমর্থকরা সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করার অপরাধে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর নগ্ন হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও মিথ্য মামলা করেছে।’
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে নিজ বক্তব্যে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা দলের মধ্যে বলয় সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন। বৈঠকে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম পাটোয়ারী দুলাল আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার (মন্ত্রণালয়েও রয়েছেন) দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর সংগঠন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সংগঠনে কেন বলয় তৈরি হবে? বলয় মেনে নেওয়া হবে না। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ যেন এ বিষয়টি দেখে। দলের চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে হবে।
ঈদের পর চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যারা বলয় সৃষ্টি করেন তারা দলের দুঃসময়ের ত্যাগী এবং সিনিয়র নেতাদের সম্মান দিতে জানেন না। যার ফলে অভিমানে তারা সংগঠন থেকে দূরে সরে গেছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।’
এ সময় চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে আবু নাঈম পাটোয়ারী দুলাল বলেন, ‘খেতে একটি জিনিসের দাম কত? আর সেটা বাজারে আসতে আসতে দাম কেন বেড়ে যায়? আমাদের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের উচিত সেদিকে নজর দেওয়ার। আমরা রাজনীতি করি সাধারণ মানুষের জন্য। আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর। আমরা তৃণমূলের রাজনীতি করি, তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য মানুষ সরাসরি আমাদের কাছে দাম বেশি হওয়ায় অভিযোগ করেন। এতে দলেরই ক্ষতি হচ্ছে, আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। দু-এক দিনের ব্যবধানে জিনিসপত্রের দাম কেন এত বেড়ে যায়? এর পেছনে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে হবে। আমরা সবাই জানি এর মূল কারণ কোথায়- কেন তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না?’
বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে আবু নাঈম পাটোয়ারী বলেন, ‘দলের মধ্যে বলয় যাতে না হয়, সে বিষয়টি বলেছি। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কারা ভূমিকা রাখছে তাদের খুঁজে বের করার বিষয়ে কথা বলেছি।’
বৈঠকে নেতাদের উদ্দেশে কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা এমপি হতে পারিনি। যারা স্বতন্ত্র এমপি হয়েছেন, তাদের স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া উচিত। তাদের সংগঠনের বড় পদে রাখার দরকার নেই। স্বতন্ত্র এমপিরা দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন। তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করবেন। মানুষের সেবা করবেন। সংগঠনের জন্য নেতা-কর্মীরা আছেন। সবাইকে পদে রাখতে চাইলে সংগঠন দুর্বল হয়ে যায়।’
বৈঠকে উপস্থিত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, সভায় চট্টগ্রাম জেলা ও চট্টগ্রাম মহানগরের নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও দ্বন্দ্ব দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মহানগর নেতাদের মধ্যকার কোন্দল মিটিয়ে দলের মধ্যে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন তিনি। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর ও চাঁদপুরের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করতে বললেন। তখন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘কেন্দ্র যখন বলবে, তখনই আমরা সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করতে পারব। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিভাগের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচনে প্রশাসন কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আমরা এমপি-মন্ত্রী সাহেবরা যদি হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকি, তাহলে বিনা প্রতীকে নির্বাচন করার যে উদ্দেশ্য নেত্রী স্থির করেছেন তা সার্থক হবে। কেউ ক্ষমতার দাপট ও ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। যার নির্বাচন করার ইচ্ছা আছে করবেন। সে স্বাধীনতা আছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। জনগণ যাকে ইচ্ছা নির্বাচিত করবে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, যদি কোনো অনিয়ম হয় তারা ব্যবস্থা নেবে।’
দ্রব্যমূল্যের বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু জিনিসের দাম বেশি, আবার কিছু জিনিসের দাম কম থাকবে। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।