লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে সম্ভাব্য চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সমঝোতা বৈঠক ডেকে আপসরফা করা হয়েছে। ৯ জন প্রার্থী থেকে একক প্রার্থী করার উদ্যোগ নিয়েছেন লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের এমপি আনোয়ার হোসেন খান। জানা গেছে, একক প্রার্থীর সম্ভাব্য ব্যয় ৩ কোটি টাকার বড় একটি অংশ ছাড় দেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।
রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে পাঁচজন চেয়ারম্যান ও চারজন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীকে নিয়ে এমন একটি সমঝোতা বৈঠকে মধ্যস্থতা করে ব্যাপক সমালোচনার কবলে পড়েছেন ওই এমপি। এই প্রার্থীদের কাছ থেকে বৈঠকের শুরুতেই সাদা কাগজে সই নিয়ে একক প্রার্থী ঘোষণা করেন তিনি। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় চলছে।
খোদ এমপির বড় ভাই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আখতার হোসেন খান নির্বাচনে এমপির হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে একাধিক প্রার্থী ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। এর আগে রামগঞ্জ শহরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে গত রবিবার (১৪ এপ্রিল) রাতে টানা ৬ ঘণ্টা ধরে এ সমঝোতা বৈঠক করেন স্থানীয় এমপি।
এমপি-মন্ত্রীরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ-প্রভাব বিস্তার করবেন না এই মর্মে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরও স্থানীয় এমপির এমন ভূমিকা ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।
সমঝোতা বৈঠকে অংশ নেওয়া ১০ জন নেতা জানিয়েছেন, একক প্রার্থী করার স্বার্থে এমপি সেখানে উপস্থিত ৯ প্রার্থীর কাছ থেকে অলিখিত কাগজে সই নিয়েছেন। পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদসহ ছয় নেতাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর সেখানে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বক্তব্য শোনা হয়। নির্বাচনে ৩ কোটি টাকা খরচ করবেন জানালে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দেওয়ান বাচ্চুকে চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় সোহেল রানা ও সুরাইয়া আক্তার শিউলীকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও দলীয় সূত্র জানায়, আনোয়ার খান গত রবিবার সন্ধ্যায় ডাকবাংলোতে দলের সিনিয়র নেতা ও উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের বৈঠকে ডাকেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। রাত ৮টার দিকে এমপি সেখানে আসেন। একক প্রার্থী করার স্বার্থে এমপি সেখানে উপস্থিত ৯ প্রার্থীর কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নেন। একপর্যায়ে যারা প্রার্থী নন, এমন ছয় নেতাকে এমপি এ কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন। তারা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সাত্তার, বেলাল আহমেদ, এম এ মমিন পাটওয়ারী, সফি উল্যা, শামছুদ্দিন ও সফিক মিয়া। পরে এমপি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা একে একে প্রার্থীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে কথা বলেন। কে কত টাকা ব্যয় করতে পারবেন, তা নিয়ে চলে খোলামেলা আলোচনা। পরে চেয়ারম্যান প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দেওয়ান বাচ্চু ৩ কোটি টাকা ব্যয় করবেন জানালে তাকে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সেখানে চেয়ারম্যান প্রার্থী আ ক ম রুহুল আমিন, শহিদ উল্যা, নুরুল ইসলাম, তাহসান আহমেদ রাসেলও উপস্থিত ছিলেন। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রাকিবুল হাসান মাসুদ, মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ভূঁইয়া, সুরাইয়া আক্তার শিউলী সভায় ছিলেন। সভায় চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইমতিয়াজ আরাফাতকে ডাকা হয়নি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল বলেন, ‘এমপি অলিখিত কাগজে আমাদের পাঁচ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সই নিয়েছেন। এটি দলীয় নির্বাচনি নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নির্বাচন করলে কত টাকা খরচ করতে পারব- তারা জানতে চাইলে আমি দেড় কোটি টাকার কথা বলেছি।’
আনোয়ার খান এমপির বড় ভাই মো. আখতার হোসেন খান বলেন, ‘এমপি নির্বাচনের প্রার্থিতা নিয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। আমিও তাকে সতর্ক করে দিয়েছি। তার লোকজনের হুমকির মুখে আমি এলাকায় যেতে পারছি না।’ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান মাসুদ বলেন, “বৈঠকে তিন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর সই নেওয়া হয়েছে। সেখানে নির্বাচন থেকে বিরত থাকার জন্য বুঝিয়ে আমাকে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য বলেছেন। আমি সেটা প্রত্যাখ্যান করেছি। পরীক্ষিত সাবেক তিন ছাত্রনেতা প্রার্থী থাকার পরও তিনি পদ-পদবিবিহীন টাকাওয়ালা একজনকে ‘কথিত সমর্থন’ দিয়েছেন।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র তিন নেতা জানান, দল সবার জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এমপি আসন্ন নির্বাচনে নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তিনি টাকার বিনিময়ে একক প্রার্থী ঘোষণা করছেন। এতে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়েছে। বক্তব্য জানতে আনোয়ার হোসেন খান এমপির মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে ওই এমপির স্থানীয় সমন্বয়কারী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ বলেন, নির্বাচনে কার কী অবস্থান, কার আর্থিক কী অবস্থা, প্রার্থীদের সক্ষমতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। এটি দলের আনুষ্ঠানিক কোনো সভা ছিল না। নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনা হয়েছে। কাউকে কিছু চাপিয়ে দেওয়া বা বাধ্য করা হয়নি।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু এমপি বলেন, ‘চেয়ারম্যান পদের দাম ৩ কোটি টাকা উঠেছে- রামগঞ্জের কয়েকজন আমাকে এটা জানিয়েছেন। এবার একক প্রার্থী ঘোষণা, সমর্থন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আনোয়ার খান দলের নির্দেশনা ভঙ্গ করেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের আমি বিষয়টি জানাব। রামগঞ্জে দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২১ মে এ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।’