![বিএনপিতে ঝড়: কমিটি হঠাৎ বিলুপ্তির কী কারণ?](uploads/2024/06/15/bnp-1718422896.jpg)
হঠাৎ বড় সিদ্ধান্ত নিল বিএনপি। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই বিলুপ্ত করা হলো দলের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল মহানগর কমিটি। ভেঙে দেওয়া হয়েছে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি। একই সঙ্গে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগরের চারটি শাখার কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়েছে। আর তাতে যেন ঝড় বইছে দলটিতে।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) রাতে দলের এমন সিদ্ধান্ত প্রচার হওয়ার পর নানা আলোচনা হচ্ছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে। কেউ কেউ বলছেন, ঈদের আগে দল এত বড় সিদ্ধান্ত নেবে এটা তাদের ধারণার বাইরে। আবার অন্যরা বলছেন, এটা অনেকটা অনুমিত ছিল। কারণ সর্বশেষ আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে এসব কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকের ওপরই নাখোশ ছিলেন নীতিনির্ধারকরা। দল এখন উপযুক্ত সময় মনে করেই যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেন, দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে এসব ইউনিটের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর আগেও অনেক কমিটি হয়েছে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তা আবার ভেঙে দেওয়াও হয়েছে। সিস্টেমের মধ্য থেকেই সংগঠনে আবারও নতুন নেতৃত্ব আসবে। শিগগিরই এসব ইউনিটে নতুন কমিটি দেওয়া হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, ‘দল ভালো মনে করেছে বলেই তিন মহানগর ও যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটা একটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। আমাদের আগেই সিদ্ধান্ত ছিল, দল পুনর্গঠন করতে হবে। সবার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনাও হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এসব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সহসাই নতুন কমিটি আসবে। তবে কমিটি ভেঙে দেওয়ায় নেতা-কর্মীরা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’
একই সঙ্গে এত কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার পরই এর পেছনের কারণ খুঁজছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। অনেকেই বলছেন, দল পুনর্গঠন করার অংশ হিসেবে এসব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তিন মহানগরের আহ্বায়ক কমিটিই ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। নতুন কমিটি গঠনের মাধ্যমে দলকে চাঙা করারও পরিকল্পনা করছে হাইকমান্ড। তবে আরও কয়েকটি কারণ দেখছেন অনেকে। এর মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলে নিজের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। অঙ্গসংগঠনে নতুন নেতৃত্ব মানেই তারেক রহমানের পছন্দের নেতারা জায়গা পাবেন।
নতুন সরকারের এখন হানিমুন পিরিয়ড চলছে। এই সময়ে বিরোধী দলগুলো এক ধরনের রাজনৈতিক স্পেস পায় এবং দল ঢেলে সাজানোর সুযোগ পায়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সরকার এখন অর্থনীতিসহ একাধিক ইস্যুতে বিপাকে আছে। এই সুযোগে দল পুনর্গঠন করে নতুন শক্তি নিয়ে রাজপথে আগামীর আন্দোলন-সংগ্রামে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত করা হবে। এ ছাড়া কমিটি ভাঙার পেছনে সর্বশেষ এক দফার আন্দোলনের সময় কিছু নেতা বড় পদে থেকেও রাজপথে না থাকায় তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল বিএনপির হাইকমান্ড।
তা ছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ- এই দুই আলোচিত ইস্যু, বিরোধী দলগুলোকে মাঠে সোচ্চার হওয়ার জন্য একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। তাই দ্রুত নতুন উদ্যমে রাজপথে ফেরার পরিকল্পনা আছে দলটির।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তিন মহানগর ও যুবদলের কমিটি ভাঙার সিগন্যাল সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের আগেই জানানো হয়েছিল। প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলে এসব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিলুপ্ত কমিটির কোন কোন শীর্ষ নেতাকে আগামীতে আরও কোনো বড় দায়িত্বে দেখা যাবে- এটা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিশ্চিত করেছেন। তবে আরেকটি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাতেই যে তিন মহানগর ও যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হবে, সে বিষয়ে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়নি। স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, পরদিন সকালে গণমাধ্যমে তারা এ বিষয়ে জানতে পেরেছেন।
এদিকে ঈদের আগমুহূর্তে এবং রাতে কমিটি বিলুপ্ত করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কয়েক নেতা ও তাদের অনুসারীরা। বিশেষ করে ঈদের ঠিক আগে বিলুপ্তির ঘোষণা আসায় তাদের কাছে এবারের ঈদ বেদনায় পরিণত হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঈদের আগমূহূর্তে কমিটিগুলো ভেঙে দেওয়ায় কার্যত দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও তাদের কর্মীদের ঈদ নিরানন্দে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া এত বড় দলের কমিটি কেন রাতের অন্ধকারে ভেঙে দেওয়া হবে? বিলুপ্ত কমিটির কারও কারও যুক্তি, আন্দোলনে ব্যর্থতার কথা বলা হলেও গত ১৫ বছরে কোনো মহানগর কমিটি কি সরকারের পতন ঘটাতে পেরেছে? বর্তমান কমিটির কমবেশি সবাই জেল-জুলুম ও হামলা-মামলার শিকারও হয়েছেন।
২০২১ সালের ২ আগস্ট আমানউল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক এবং আমিনুল হককে সদস্যসচিব করে ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটি ঘোষণা করা হয়। যদিও এখন ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার। অন্যদিকে একই দিন আবদুস সালামকে আহ্বায়ক ও রফিকুল আলম মজনুকে সদস্যসচিব করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। সারা বছর সফল কর্মসূচি পালন করলেও শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে বিজয়ী হতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি ঢাকার নেতারা। কেউ কেউ ছিলেন পুরোপুরি আত্মগোপনে। আমিনুল হকসহ কয়েকজন ছিলেন কারাগারে।
দক্ষিণের সাবেক সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু খবরের কাগজকে বলেন, কমিটি ভাঙা বা নতুন কমিটি গঠন- এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগামী দিনে দলের প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তার সঙ্গে আমরা একমত।
মহানগর উত্তরের আমিনুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘কমিটি পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের আহ্বায়ক কমিটির বয়সও প্রায় তিন বছর। দীর্ঘ এই সময়ে ভালোমন্দ ও ভুলত্রুটি সবই ছিল। সবকিছুর দায়ভার আমাদের। তারপরও জেল-জুলুম এবং হামলা-মামলা মোকাবিলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর ডা. শাহাদাত হোসেনকে আহ্বায়ক ও আবুল হাশেম বক্করকে সদস্যসচিব করে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির ৩৯ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তাই মহানগরে নতুন নেতৃত্ব আনতে চাইছে হাইকমান্ড। এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’
২০২২ সালের জানুয়ারিতে মনিরুজ্জামান খান ফারুককে আহ্বায়ক ও জাহিদুল কবির জাহিদকে সদস্যসচিব করে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। সদ্য বিলুপ্ত বরিশাল মহানগর কমিটির সদস্যসচিব জাহিদুল কবির জাহিদ বলেন, ‘দলের জন্য ছিলাম, আছি, থাকব। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিন মাসের কমিটি হলেও আমরা ৩৩ মাস দায়িত্ব পালন করেছি। আর নেতৃত্ব নির্বাচন বেসিক্যালি চলমান প্রক্রিয়া।’
সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও মোনায়েম মুন্নার নেতৃত্বাধীন যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়। দলীয় সূত্রমতে, মেয়াদ থাকা অবস্থায়ই ভেঙে দেওয়া হয়েছে কমিটি। মূলত, নির্বাচনের পর দলকে নতুনভাবে চাঙা করা এবং পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে এই সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে যুবদলের সদ্য সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘হঠাৎ নয়, দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সবাইকে একত্রিত করেই দল পরিচালনা করতে চান। সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক (সহসভাপতির পদমর্যাদা) জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় সংসদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম শাখা ছাত্রদলের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছিরউদ্দীন নাছির এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছিরউদ্দীন নাছির বলেন, ‘কমিটি যেগুলো বিলুপ্ত করা হয়েছে, সব কটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এটা সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বিষয়। টানা আন্দোলন আর সার্বিক পরিস্থিতির কারণে তখন দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এখন উপযুক্ত সময় বিবেচনা করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ ও অতীত আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিলেন, তাদের নিয়েই কমিটি গঠন করা হবে। আশা করছি, ঈদুল আজহার পরপরই নগর কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
ঢাকা মহানগর ও যুবদলে আলোচনায় যারা
দু-এক দিনের মধ্যে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং জাতীয়তাবাদী যুবদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা হতে পারে। দলীয় সূত্রে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব, দক্ষিণের সদ্য সাবেক সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু এবং ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তরের শীর্ষ দুই পদে নাম শোনা যাচ্ছে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সদস্যসচিব আমিনুল হক, তাবিথ আউয়াল ও এস এম জাহাঙ্গীরের।
যুবদলের নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, সহসভাপতি নূরুল ইসলাম নয়ন, যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিন। তবে মুন্না ও নয়নকে দিয়ে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।