![দেশে ফিরতে পারছেন না বিএনপির ২৭ নেতা](uploads/2024/06/15/BNP-1718439016.jpg)
শিগগিরই দেশে ফিরতে পারছেন না বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ কেন্দ্রীয় অন্তত ২৭ নেতা। বিগত ১৫ বছরে সরকারের হামলা-মামলা ও নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদের বেশির ভাগ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছেন। এই তালিকায় থাকা নেতাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে সাজাপ্রাপ্ত, আবার কারও কারও নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। বিদেশে থাকলেও থেমে নেই তাদের মামলার গতি। তাই দেশে ফিরতে পারলেও তাদের ঠিকানা নিশ্চিতভাবে কারাগার হবে বলে তারা মনে করছেন। ফলে শেষ বয়সে অনেকেই কারাগারে যেতে চাইছেন না। এ ছাড়া অনেকেই দেশে থাকাকালীন ব্যবসা-বাণিজ্য বা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে রাজনৈতিক চাপের মুখে ছিলেন। ফলে দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন না হলে তারা শিগগিরই দেশে ফিরছেন না। আবার স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদসহ দু-একজন নেতা দেশে ফিরতে আগ্রহী হলেও আইনি বেড়াজালে আটকে আছেন। অবৈধ প্রবেশের দায়ে মামলা থেকে খালাস পেলেও ট্রাভেল পাস না মেলায় দেশে ফিরতে পারছেন না সালাহউদ্দিন।
ভারতের মেঘালয়ে বসবাসকারী সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাকে কীভাবে ভারতে নিয়ে আসা হয়েছে, এটা দেশবাসী জানে। আমি অসুস্থ, আমার বয়স হয়েছে। বাংলাদেশে আমার মৃত্যু হোক, এটাই আমার শেষ চাওয়া।’ তিনি বলেন, ‘এখন আমার বিরুদ্ধে মামলা নেই, আদালত খালাস দিয়েছেন, এর পরও ভারত ফেরত পাঠাচ্ছে না। হয়তো ঢাকার সরকার নিষেধ করে দিয়েছে। এখানে আমার তো করার কিছু নেই।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই, বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। যে দুর্নীতি-অন্যায় করিনি অথচ সেই মামলায় আমাকে অন্যায়ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। দেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজকে না ধরে বিএনপির নেতাদের ধরতে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।’
বিদেশে থাকা কয়েকজন নেতা খবরের কাগজকে জানান, বিদেশে থাকা অবস্থাতেই তাদের বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে। এখন দেশে ফিরলে প্রথমেই তাদের কারাগারে যেতে হবে। এ জন্য তারা ভয় পাচ্ছেন। ফলে দেশে ফিরে তারা আইনি মোকাবিলাও করতে পারছেন না। তারা বলেন, একদলীয় শাসন পাকাপোক্ত করতেই বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়ষন্ত্র চলছে। একদিকে হামলা-মামলা, অন্যদিকে নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।
তারা বলছেন, আওয়ামী লীগে যোগ দিলে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। যার উদাহরণ বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর। তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ামাত্রই তার নামে কোনো মামলা নেই, তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ একই মামলায় বিএনপি নেতারা ঠিকই আসামি হিসেবে রয়ে গেলেন। এ থেকেই প্রমাণিত দেশের আইন-আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এখানে বিরোধীদের ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়া কিছুই মানা হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে প্রায় ৫০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি মামলায় তার সাজা হয়েছে। তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকেও দুদকের মামলায় তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আছেন। সেখান থেকেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তারেক রহমান। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। গ্রেপ্তার ও সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় বিএনপির এই শীর্ষ নেতা ও তার স্ত্রী দেশে ফিরতে পারছেন না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রায় ৯ বছর ধরে ভারতে আছেন। বর্তমানে ভারতের মেঘালয়ের ভাড়া বাড়িতে আছেন। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে তিনি নিখোঁজ হন। ৬২ দিন পর ১১ মে সালাহউদ্দিন আহমেদকে ভারতের শিলংয়ে পুলিশ উদ্ধার করে। পরবর্তী সময়ে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করে ভারতীয় পুলিশ। এই মামলায় সালাহউদ্দিন আহমেদ ২০১৮ সালে খালাস পান এবং ২০২৩ সালে আপিলের রায়েও খালাস পান। কিন্তু খালাস পাওয়ার ১৫ মাস পার হলেও ট্রাভেল পাস না দেওয়ায় দেশে ফিরতে পারছেন না তিনি।
আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু প্রায় এক বছর ধরে লন্ডনে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় তার ৯ বছরের সাজা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির এই দুই নেতা দেশে থাকাকালীন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এখনো ভার্চুয়ালি স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। দলীয় সিদ্ধান্তেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই শেষ বয়সে তারা দেশে ফিরতে চান।
বিদেশে থাকা বিএনপির অন্য নেতারা হলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মুশফিকুর রহমান, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন, ড. ওসমান ফারুক ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান, তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান (এ্যাপোলো), ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক সম্পাদক এম এ কাইয়ুম, সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, আনোয়ার হোসেন খোকন, নাজমুল আবেদীন মোহন, বেবি নাজনীন, প্রবাসী কল্যাণবিষয়ক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আব্দুস সালাম, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য গাজী শাহজাহান জুয়েল, শেখ সুজাত মিয়া, আলী আজগর লবি, মোশারফ হোসেন, কয়ছর এম আহমেদ, আব্দুল লতিফ সম্রাট, মির্জা খোকন, সাইদুর রহমান লিটন ও ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সাহাবুদ্দিন লাল্টু, নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রাশিদুল হক। এরা ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী সরকার বা আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে শোষণ-নির্যাতন ও মামলার ভয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছেন।
এদের মধ্যে আমেরিকায় আছেন ড. ওসমান ফারুক, বেবি নাজনীন ও আব্দুল লতিফ সম্রাট। লন্ডনে আছেন মুহিদুর রহমান, আনোয়ার হোসেন খোকন, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আব্দুস সালাম, কয়ছর এম আহমেদ, সুজাত মিয়া। গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী রয়েছেন দুবাইয়ে। সৌদি আরব আছেন কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন। মালয়েশিয়ায় আছেন ওয়াহিদুজ্জামান (এ্যাপোলো), মোশারফ হোসেন, এম এ কাইয়ুম, মির্জা খোকন এবং সাহাবুদ্দিন লাল্টু ও ফয়সাল আহমেদ কানাডায় রয়েছেন। বেলজিয়ামে বসবাস করছেন সাইদুর রহমান লিটন, অস্ট্রেলিয়ায় আছেন রাশিদুল হক।
বিএনপির আলোচিত নেতা ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ কাইয়ুম। প্রায় ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় আছেন তিনি। ইদানীং এম এ কাইয়ুমকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে একটি পক্ষ। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘মামলা-মোকদ্দমার কারণে বিদেশে চলে এলাম। কিন্তু বিদেশে আসার পরও দেশে আমার নামে মামলা দেওয়া থেমে নেই। তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যার হিসাব তার জানা নেই। দেশের বিচারব্যবস্থা-প্রশাসন দলীয়করণ করা হয়েছে। তবে দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলে দ্রুতই ফিরে আসব।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতন ও মামলার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বিএনপির অনেক নেতা। আবার অনেককে গুম করা হয়েছে। সালাহউদ্দিন আহমেদকে বাসা থেকে তুলে প্রথমে গুম করে রাখে। দুই মাস পর ভারতের শিলংয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রযোজনায় এসব করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, বিএনপির নেতারা মূলত সরকারের চাপে, মামলা ও গ্রেপ্তার ভয়, বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়া এবং ভবিষ্যতে সরকারের আরও রোষানলে পড়তে পারেন- এসব কারণে নেতারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।