পৃথিবীর সব সৃষ্টিই আল্লাহর। তাঁরই নিয়ন্ত্রণে চলে সবকিছু। এদের নিয়োজিত করেছেন মানুষের কল্যাণে, করেছেন মানুষের অধীন। মানুষের কাঁধে দিয়েছেন এদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। আদেশ করেছেন সৃষ্টির প্রতি সদয় হতে। প্রাণী ও প্রকৃতির ক্ষতি হয়, এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জোর তাগিদ রয়েছে কোরআন-হাদিসে। বিশেষত কোরআনের একাধিক স্থানে প্রাণিকুলকে উপকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রাণীর উপমা পেশ করে, সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে এর গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
প্রাণীর প্রতি দয়ার্দ্রতা
দুস্থ-অসহায় মানুষ তো বটেই; প্রাণীদের খাবারও আছে ধনবানদের ধনে। আদি ইবনে হাতেম তাই (রা.) যখন খেতে বসতেন, রুটির কিছু টুকরো পিঁপড়ার যাতায়াতস্থলে ছড়িয়ে দিতেন। আর সঙ্গীদের বলতেন, ওরা আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের কাছে তাদেরও আছে অধিকার। (শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকি: ১০৫৬৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যেকোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করবে অথবা কোনো ফসল ফলাবে; অতপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি বা পশু কিছু খাবে; সেটা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস: ২৩২০)
সৃষ্টির সেবায় স্রষ্টার সন্তুষ্টি
ইসলাম সৃষ্টিজগৎকে ‘আল্লাহর পরিবারভুক্ত’ আখ্যা দিয়ে সবকিছুর প্রতি সহানুভূতিশীল ও দয়া দেখানোর নির্দেশ দিয়েছে। সৃষ্টির সেবাতেই স্রষ্টার সন্তুষ্টি। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একটি কুকুর পিপাসায় কাতর হয়ে কোনো এক পানির কূপের চারপাশে দিশাহারা হয়ে ঘুরছিল। বনি ইসরাইলের এক গণিকা নারী তা দেখে নিজের পরিহিত মোজা খুলে কূপ থেকে পানি তুলে কুকুরকে পান করায়। এর অসিলায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২২৪৫)
নির্মমতায় শাস্তি
প্রাণীর প্রতি সদাচরণ করতে হবে। তাদের অকারণে হত্যা করা নিন্দনীয়। ইসলাম এমন হত্যা নিষেধ করেছে। আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) অবলা জন্তু-জানোয়ারকে আটকে রেখে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৫৫১৩)
আরেকটি হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পূর্ববর্তী যুগের এক নারীকে একটি বিড়াল হত্যার কারণে আজাব দেওয়া হয়েছে। সে বিড়ালটিকে বন্দি করে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কোনো খাদ্য-পানীয় তাকে দেয়নি; আবার বিড়াল নিজে জোগাড় করে খাবে, সে সুযোগও দেয়নি। এ কারণে তাকে জাহান্নামে দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৪৮২)
প্রাণী হত্যা নিষেধ
পৃথিবীতে বিচরণশীল প্রতিটি প্রাণীর কল্যাণ কামনা করা মুমিনের গুণ। ইবাদতও বটে। প্রাত্যহিক জীবনে বাহ্যত যেসব জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ তেমন কোনো কাজে আসে না; সেগুলো অকারণে বধ বা হত্যা করা নিষিদ্ধ। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) চার প্রকারের প্রাণী হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। মৌমাছি, পিঁপড়া, হুদহুদ এবং চড়ুই সদৃশ বাজ পাখি।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৫২৬৭)
অকারণে প্রাণী হত্যা নিষেধ। কোনো প্রাণী কাউকে কষ্ট দিলে কিংবা কষ্টের কারণের তীব্র আশঙ্কা হলে, হত্যা করতে অসুবিধা নেই। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) অনিষ্টকারী প্রাণী থেকে অনিষ্টতা প্রকাশ না পেলে তাকে মারতে নিষেধ করেছেন।’ (মুয়জামুল কাবির লিত তাবরানি, হাদিস: ১২৬৩৯)
ফুকাহায়ে কেরামের মতে, ক্ষতিকর, কষ্টদায়ক প্রাণী হত্যা করা জায়েজ আছে। যেমন—পাগলা কুকুর, বিড়াল। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ৭৫২)
পৃথিবীর স্থিতি, বিচিত্রতা, শান্তি-শৃঙ্খলা ও পরিবেশ ঠিক রাখতে বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি অপরিহার্য। সুস্থ-সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়ে আমাদের বেঁচে থাকার জন্যও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ প্রয়োজন।
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতু আনাস রা. সাইনবোর্ড