![মিথ্যা ঘোষণায় পাচার ১১২৭ কোটি টাকা](uploads/2023/12/29/1703823760.NBR_TAKA.jpg)
মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশের ১ হাজার ৪৮৫টি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অর্থ পাচার-সম্পর্কিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ১ হাজার ৪৮৫টি প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে ২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানি করেছে। অথচ কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দাম দেখিয়েছে ৩ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুয়া বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেছে। কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কতটা, কী পরিমাণ, কী কী কাঁচামাল আমদানি করেছে এবং কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে কতটা কোন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে তাতেও মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। বেশি পরিমাণের ও বেশি দামের কাঁচামাল আমদানির হিসাব দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমদানি করা হয়েছে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানির মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনেক চালানে মদ, মাদক, সিগারেট, ঘন চিনি, রাসায়নিক, অস্ত্র, স্বর্ণও আমদানি করেছেন। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠান কম পরিমাণের, নিম্নমানের ও কম দামের পণ্য রপ্তানি করলেও কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে বেশি পরিমাণের দামি পণ্য।
প্রতিবেদনে আছে, বিভিন্ন সময়ে আমদানি বা রপ্তানির হিসাবের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনেদেনে গরমিল পাওয়া গেছে, এমন দুই হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে শুল্ক গোয়েন্দারা তদন্ত করতে থাকেন। তারা এনবিআরের শুল্ক শাখা, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, বিভিন্ন বন্দর, বাংলাদেশ ব্যাংক, লিয়েন ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ হাজার ৪৮৫ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, এলসি (ঋণপত্র), ব্যাংক লেনদেন-সম্পর্কিত সব তথ্য জোগাড় করেন। বিদেশে কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাঁচামাল কেনা হয়েছে এবং কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে, শুল্ক গোয়েন্দারা তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাগজপত্রে নাম থাকলেও অনেক ক্রেতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়নি। বছরব্যাপী (২০২৩) তদন্ত শেষে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ১ হাজার ৪৮৫ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে।
এভাবে গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সবাই পাঁচ বছর ধরে মিথ্যা দিয়ে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু অর্থ পাচারই করেনি, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। মোট ২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে ৮৩২ কোটি টাকার কাঁচামাল গোপনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।
এই ১ হাজার ৪৮৫টি প্রতিষ্ঠান এনবিআরের শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সরকারি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার অন্যতম সরকারি শর্ত, ‘শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান কেবল পণ্য উৎপাদনের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা পাবে এবং আমদানি করা কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। একটুও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। কাঁচামাল উৎপাদনে না লাগিয়ে, এনবিআরের অনুমতি না নিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করা হলে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করা হবে। হিসাব কষে রাজস্ব আদায় করা হবে। একই সঙ্গে জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। জরিমানাসহ রাজস্ব পরিশোধ না করলে শর্ত ভঙ্গকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ এবং মামলা করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এনবিআর।’
প্রতি অর্থবছরে রপ্তানি উৎসাহিত করতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ায় সরকার প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, দেশি শিল্পের মালিকরা সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে সামান্য লাভে বিক্রি করলেও শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা একই জাতীয় কাঁচামাল অবৈধভাবে বাজারে কম দামে বিক্রি হয়। কম দামে পাওয়ায় ক্রেতা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্য কিনছে বেশি। এভাবে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছেন সৎ ব্যবসায়ীরা।
শুল্ক গোয়েন্দারা ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮৫ প্রতিষ্ঠানের মোট ৪ হাজার ২৫৯টি চালানে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন। এসব চালানের মধ্যে ২০১৯ সালে ৪২৯টি, ২০১৮ সালে ৫২৭টি, ২০২০ সালে ৭৫৩টি, ২০২১ সালে ১ হাজার ৭৩৯টি এবং ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৮২১টি চালান আছে। এসব চালানের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করার সময় আটক করা হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা এসব পণ্য আটক করায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়মিত রাজস্বের বাইরে অতিরিক্ত ১৬৫ কোটি ১৩ লাখ ৭২ হাজার ৫০১ টাকা আদায় করা হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফকরুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক অনিয়ম করেছেন। বছরের পর বছর তারা এটা করেছেন। শুল্ক গোয়েন্দারা অনিয়ম বন্ধ করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন। তথ্য গোপন করে ক্ষতিকর পণ্য আনা হচ্ছে। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এর আগে এনবিআরের অর্থ পাচার-সম্পর্কিত তদন্তে বলা হয়েছে, দেশ থেকে পাচার করা অর্থের ৮০ শতাংশই আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাচার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) বিগত বছরে প্রকাশিত তথ্যানুসারে আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার বেশির ভাগই হয় মিথ্যা ঘোষণায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ অর্থ পাচারের ঘটনা ধরতে পারে, তার পরিমাণ খুব বেশি না। তবে আশার কথা, এসব প্রতিষ্ঠান আগের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ২০২০ সালের জুনে এলেক্স সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদনে ব্যবহারের জন্য ১৭ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানির মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশি মদ বন্দরে প্রবেশ করানোর সময় জব্দ করা হয়। এতে সরকার ১ কোটি ২৯ লাখ টাকার রাজস্ব পায়। একই বন্দর দিয়ে ২০২২ সালের জানুয়রিতে আরেক প্রতিষ্ঠান রুহিন অ্যাকসেসরিজের নামে ঘর-গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত ১২ কোটি টাকার পণ্য আমদানির মিথ্যা দিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য বন্দরে প্রবেশ করানোর সময় আটক করা হয়। এতে ১ কোটি ২১ হাজার টাকার রাজস্ব আদায় হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এবিএল লিমিটেডের নামে গত বছরের মার্চে প্রসাধনসামগ্রীর কথা বলে আনা ২ কোটি ২৩ লাখ টাকার মদের চালান জব্দ করা হয়।
গত বছরের মে মাসে সোনিয়া ডাইং লিমিটেডের ৮৭ লাখ টাকার বিদেশি কাপড় আমদানির নামে আমদানি নিষিদ্ধ ১৯ টন সোডিয়াম সাইক্লামেট (ঘন চিনি) চট্টগ্রাম বন্দরে জব্দ করা হয়। একই বন্দর দিয়ে আহনা ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ক্যালসিয়াম কার্বনেট আমদানির ঘোষণা দিয়ে ডেক্সট্রোজ মনোহাইড্রেট আমদানির সময় আটক করা হয়। এ সময় ২৫ লাখ ১৩ হাজার টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছিল। এ বছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশি ফল মালটা, আপেল আমদানির তথ্য কাগজপত্রে উল্লেখ করে দুই কনটেইনার মদ এবং দুই কনটেইনার বিদেশি সিগারেট আনা হয়, যা বন্দরে প্রবেশ করার সময় জব্দ করা হয়।