![সোনার ভরি ৪০ হাজার!](uploads/2024/04/26/1714116470.Gold.jpg)
পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের পলক জুয়েলারি নামের সোনার দোকানে স্বামী-স্ত্রী সেজে সোনার গয়না বিক্রি করতে আসেন দুজন। প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকার গয়না বিক্রি করে চলেও যান তারা। তবে এক সপ্তাহের মাথায় ঘটে বিপত্তি। হঠাৎ সেই সোনার দোকানে পুলিশ এসে হাজির। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দোকানদার বিশ্বনাথের (ছদ্মনাম) হাতে পরানো হয় হাতকড়া। তোলা হয় পুলিশভ্যানে। নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। থানায় যেয়ে তিনি অবাক। দেখতে পান এক সপ্তাহ আগে যাদের কাছ থেকে সোনার গয়না কিনেছিলেন তাদের তার সামনে হাজির করা হয়। তখন বিশ্বনাথের আর বুঝতে বাকি থাকে না ঘটনা কী।
গয়নাগুলো ছিল চুরি করা, যা তিনি ৪০ হাজার টাকা ভরিতে কিনেছিলেন। লোভ সামলাতে পারেননি। অতিরিক্ত লাভের আশায় এখন সবশেষ। পরে পুলিশ গ্রেপ্তার ওই দুই আসামি ও বিশ্বনাথের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। বেশ কয়েক মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে এলেও বিশ্বনাথ আর ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। এখন তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করছেন। রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে।
সোনার দোকানের সামনে বড় ছাতা বা চাদর মেলে দ্রুত তালা কেটে মালামাল ও টাকা নিয়ে পালায় চোরেরা। একই কায়দায় গত বছরের ১৪ এপ্রিল জুমার নামাজের সময় ছাতা দিয়ে আড়াল করে ভাটারার নূর জুয়েলার্সে চুরি হয়। দোকান মালিক দাবি করেন, ১৮৬ ভরি সোনা ও ৫০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে চোরেরা। এরপর ঘটনা তদন্তে ডিবি পুলিশ জানতে পারে, চুরিতে ১৩ জন অংশ নেয়। গত বছরের জুন মাসে আটজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ টিম। তাদের কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের কাছ থেকে ২ ভরি সোনা, ১২ লাখ টাকা, তালা কাটার যন্ত্রপাতি এবং চুরিতে ব্যবহার করা ছাতা উদ্ধার করা হয়।
চুরি হওয়া সোনার বিক্রি বিষয়ে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারে সরেজমিনে অনুসন্ধান চালায় খবরের কাগজের অনুসন্ধানী টিম। প্রায় দুই মাস অনুসন্ধানে চুরি হওয়া সোনা বিক্রির বিষয়ে মিলেছে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সোনার দোকান লুট, বাসাবাড়ি থেকে চুরি ও রাস্তাঘাটে মানুষের কাছ থেকে চুরি বা ছিনতাই করা সব ধরনের সোনাই বেচাবিক্রি হয় এই বাজারে। এ ছাড়া উত্তরা, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের সর্বত্র এখন ছড়িয়ে পড়েছে চোর ও ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেট।
সরেজমিনে ঢাকার তাঁতিবাজার ঘুরে দেখা যায়, নামে তাঁতিবাজার হলেও পুরান ঢাকার এ এলাকাটি বিখ্যাত সোনার দোকান, স্বর্ণকার ও কারিগরদের কর্মদক্ষতার জন্য। বলা হয়ে থাকে, দেশের সবচেয়ে বড় সোনার বাজার পুরান ঢাকার প্রাচীন এ এলাকাটি। দেশের বড় জুয়েলারি দোকানগুলোরও কারখানা এই তাঁতিবাজারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে জজ কোর্টের পেছন দিয়ে হাঁটতে গেলেই সরু কয়েকটি গলিতে চোখে পড়ে সারি সারি সোনার দোকান। এখানে কম করে হলেও ৫০০ সোনার দোকান রয়েছে। কেউ সোনা বিক্রি করছেন, কেউ বন্ধক রাখছেন, আবার কেউবা নিবিষ্ট মনে গড়ছেন নিখুঁত সব গহনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুধুমাত্র একটি ছোট জলচৌকি ও দুটি টুল দিয়ে বসেছে দোকান। বেশির ভাগ দোকানে তেমন কোনো গহনা সাজানো নেই। দোকানগুলোতে বড় অক্ষরে লেখা আছে, বন্ধক রাখা হয়। এ ছাড়া বেশির ভাগ ছোট আকৃতির দোকানের সামনে টুলে একজন দালাল বসা থাকে যিনি ক্রেতা দেখলেই কিনবেন না বিক্রি করবেন বলতে শুরু করেন। সোনা বেচাকেনার জন্য কেনা রশিদ, ভোটার আইডি দেখার নিয়ম থাকলেও এখানে মানা হয় না কোনো নিয়ম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চুরি করা সোনা বিক্রির জন্য বেশ কয়েকজন মহাজন আছে এই বাজারে। চুরির সোনাগুলো কেনার পর কারিগররা সেগুলো গলিয়ে খাদ থেকে আসল সোনা আলাদা করে ফেলেন। এরপর সোনার ওপর হলমার্ক বসানো হয়। এ ক্ষেত্রে চুরি হওয়া সোনা ধরার কোনো কায়দা থাকে না। এ ছাড়া জুয়েলারি দোকান থেকে স্বর্ণালংকার চুরির পর সেগুলো বিক্রি হয় অর্ধেকের চেয়ে কম দামে, ওজনেও দেওয়া হয় বেশি। চোরাই সোনা ১৬ আনায় ভরির বদলে বিক্রি হয় ২০ আনা ভরিতে। প্রতি ভরির দাম ধরা হয় ৪০ হাজার টাকা।
সরেজমিনে আরও দেখা মেলে, বেশির ভাগ কারিগর এখানেই থাকেন। নিচে সব দোকান আর ভাঙাচোরা বিল্ডিংগুলো কারখানা। কারিগররা কারখানায় কাজ করেন, কারখানাতেই ঘুমান। নুসরাত স্টোন অ্যান্ড সিলভার হাউজের ব্যবসায়ী মাহফুজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যবহার ও চুরি করা সব ধরনের সোনাই এখানে বিক্রি হয়। প্রায়ই শোনা যায়, পুলিশ এসে কারও খোঁজ করছে বা কাউকে ধরে নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘চুরি সোনা বিক্রি করতে এলে আমরা বুঝতে পারি। ঝামেলা হবে বুঝতে পারলে আর কেনা হয় না। তবে দাম বাড়ার কারণে এখন ক্রেতারা অন্য সময়ের চেয়ে সোনা বিক্রি বেশি করছেন বলেও জানান ওই ব্যবসায়ী।’
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সোনার মূল্য দামের অর্ধেক টাকা বন্ধকিমূল্য হিসেবে দেওয়া হয়। ধরেন ১ লাখ টাকার সোনা আনছেন, আপনি পাবেন ৫০ হাজার টাকা। সাধারণত ৬ মাসের জন্য বন্ধক রাখা হয়। তবে ৬ মাস বললেও প্রায়ই বছর কেটে যায়। তাঁতিবাজারে মূলত যারা সোনা বন্ধক রাখেন তাদের গুনতে হয় বড় অঙ্কের সুদ। লাখপ্রতি মাসে ৩ হাজার সুদ দিতে হয়।
সোনা বন্ধকের বিষয়ে বিক্রমপুর গোল্ড হাউজের ব্যবসায়ী একরাম খবরের কাগজকে জানান, ‘এটা মূলত স্বল্পকালীন ঋণের মতো। সুদের টাকা না ওঠালে তাদের লাভ বলে কিছু থাকে না। অনেক সময় সুদের টাকা তুলেও লাভ করতে পারেন না তারা।’
এ বিষয়ে ডিবি লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, উত্তরা, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরাই সোনা বেচাকেনা হয়। স্বর্ণালংকার চুরির পর সেগুলো বিক্রি হয় অর্ধেকের চেয়ে কম দামে, ওজনেও দেওয়া হয় বেশি। চোরাই সোনা ১৬ আনায় ভরির বদলে বিক্রি হয় ২০ আনা ভরিতে। প্রতি ভরির দাম ধরা হয় ৪০ হাজার টাকা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন ছড়িয়ে পড়েছে এই চোর চক্র। সম্প্রতি এসব চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ও তাদের নামে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে।’
এসব চোর শনাক্ত করা কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে মোটাদাগে আমিন মোহামাম্মদ গ্রুপ ও নতুন করে বসুন্ধরাসহ যারা সোনার ব্যবসার মালিক বনে গেছেন, তাদের আগে সোনার ব্যবসা ছিল তাতিঁবাজারের ব্যবসায়ীদের হাতে। তাঁতিবাজারে চোরাই সোনাগুলো রাস্তার ওপরে বসানো দোকানগুলোতেই বিক্রি হয়। চোরাই সোনা কেনার পর তা গলিয়ে ফেলা হয়। সোনা গলিয়ে খাদ আলাদা করে খাটি সোনায় হলমার্ক বসিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া এমন দোকানে এসব বিক্রি হয় যেখানে কোনো সিসি ক্যামেরা থাকে না। এক ব্যবসায়ীর দোকান থেকে চুরি হওয়া স্বর্ণ আরেক ব্যবসায়ী কেনেন। আরও দেখা যায় রাজশাহী থেকে এসে ঢাকায় চুরি করে। ফলে মামলা হলেও তদন্ত করেও তাদের ধরা কঠিন হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই চোর হওয়ার কারণে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।