![ক্রিকেট-ফুটবলের চেয়ে হকি যেখানে এগিয়ে](uploads/2024/04/21/1713679230.Hockey--Tofail.jpg)
বাংলাদেশে ক্রিকেট-ফুটবলের চেয়েও একটা জায়গায় যেন ঢের এগিয়ে হকি!
কথাটা হাস্য-রসাত্মক মনে হতেই পারে। যে খেলা নিয়মিত মাঠেই থাকে না, সেই খেলাকে ক্রিকেট-ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করা বোকামিই। আসলেই তাই। তবে ক্রিকেট-ফুটবলের মতো হকি নিয়মিত মাঠে থাকলে খেলাটির অন্য রকম ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি হতো, এ কথা বলা যায় নির্ধিদ্বায়।
এ বছর দেশের তিন শীর্ষ খেলা হিসেবে পরিচিত ক্রিকেট, ফুটবল ও হকির প্রিমিয়ার লিগ মাঠে ছিল একই সময়ে। হকি লিগ কার্যত শেষই বলা চলে। শুধু শিরোপা-নির্ধারণী প্লে-অফ ম্যাচ বাকি, যা না হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কারণ টেবিলের শীর্ষস্থানে থাকা দুই দল মেরিনার্স ইয়াংস ও আবাহনী লিমিডেট যুগ্ম চ্যাম্পিয়নের দাবি তুলতে পারে। যেটাই হোক, শিরোপার প্রশ্নে হকির মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু অন্য দুই খেলার (ক্রিকেট ও ফুটবল) লিগে নেই।
প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে যেমন এবারও বসুন্ধরা কিংসের একচ্ছত্র দাপট। প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী লিমিটেডও তাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্যর্থ। টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে আছে মোহামেডান। তবে শিরোপার দাবি জোড়ালোভাবে জানাতে পারছে না তারা। প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটে লিগ পর্ব শেষ হয়েছে পরশু (শুক্রবার)। কিন্তু সুপার লিগ পর্ব শুরুর আগেই আবাহনী যেন অন্য দলগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। ঠিক এই জায়গাটাতেই দেশের ঘরোয়া পর্যায়ে ক্রিকেট-ফুটবলের চেয়ে এগিয়ে থাকছে হকি।
পরশু (শুক্রবার) প্রিমিয়ার লিগ হকির শেষ রাউন্ডের দুটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। দিনের শেষ ম্যাচে আবাহনী লিমিটেডকে হারালেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত মোহামেডান। কিন্তু দলটা তৃতীয় কোয়ার্টারে ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা অবস্থায় আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষার পর আম্পায়াররা আবাহনীকে জয়ী ঘোষণা করেন। এতে ১৫টি করে ম্যাচ শেষে আবাহনী ও মেরিনার্স ইয়াংসের পয়েন্ট দাঁড়ায় সমান ৩৭। এখন নিয়ম অনুযায়ী প্লে-অফের মাধ্যমে শিরোপা নির্ধারণ হওয়ার কথা।
কোনো লিগে শিরোপার দাবিদার দল যত বেশি থাকবে, সেই লিগ তত বেশি জমজমাট হবে। হকিতে এই আবহটা দেখা যায় প্রায় প্রতিবারই। দেশের দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আবাহনী ও মোহামেডানের সঙ্গে মেরিনার্স ও ঊষা ক্রীড়া চক্র শিরোপার জন্য দল গড়ে। এবার আবাহনী, মোহামেডান ও মেরিনার্সের সঙ্গে ঊষাও একটা সময় পর্যন্ত শিরোপার রেসে ছিল। শেষ দিকে এসে ছিটকে যায় তারা। সব মিলিয়ে হকি লিগের সুপার লিগ পর্বটা ছিল দারুণ রোমাঞ্চকর। যদিও নানা অসংগতিও আছে। দুই বছরের বেশি সময় পর লিগ মাঠে ফিরেছিল। দ্রুত লিগ শেষ করার একটা প্রয়াস যেন ছিল ফেডারেশনের। তাতে ঠাসা সূচিতে খেলতে হয়েছে দলগুলোকে। আম্পায়ারদের ৬০ মিনিটের ম্যাচ অনেক সময় শেষ করতে ২ ঘণ্টাও লেগেছে। বিশেষ করে বড় ম্যাচে এমন ঘটনা দেখা গেছে প্রতিনিয়ত, যা হকির সৌন্দর্যকে নষ্ট করেছে।
তবে একেবারে শেষ রাউন্ডে এসে শিরোপার জন্য যে ত্রিমুখী লড়াই তৈরি হয়েছিল, তা হকিপ্রেমীদের মনে শুধু একটা হাহাকারেরই জন্ম দিয়েছে। লিগটা যদি নিয়মিত হতো…। চলতি মৌসুম শুরুর আগেও এমন আকুতি ছিল খেলোয়াড়দের। এবারের লিগে অ্যাজাক্স স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেছেন জাতীয় দলের সাবেক ডিফেন্ডার ইমরান হাসান পিন্টু। সিনিয়র এই হকি খেলোয়াড় খবরের কাগজকে আক্ষেপের সুরে বলছিলেন, ‘মাঠে নিয়মিত খেলা থাকলে অবশ্যই ক্রিকেট ও ফুটবলের চেয়ে হকি এগিয়ে থাকবে। যদি সঠিক পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে আমরা বিশ্বকাপ খেলার মতো দল। কিন্তু সেটার জন্য আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এটা অসম্ভব কিছু না।’ পিন্টু যোগ করেন, ‘আমাদের বড় সমস্যা হলো সাংগঠনিক। আমরা নিজেদের মধ্যে রেষারেষি বাদ দিয়ে যদি শুধু হকিটাকে ফোকাস করি, তাহলেই দেখবেন আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাব।’
আসলে কর্মকর্তাদের এই রেষারেষিটাই অতলে ডুবিয়ে দিচ্ছে হকিকে। নির্দিষ্ট করে বললে ক্লাব-কর্তাদের অহম। এবারের প্রিমিয়ার লিগ হকির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ নাটক হয়েছে অনেক। শুরুর তারিখ নিয়ে গণ্ডগোল, অঘোষিত ফাইনাল অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে নাটক এবং আরও কত কী। পিন্টু বলছেন, ‘আমাদের সবারই ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা সবকিছুতেই জিততে চাই। খেলার মধ্যে হার-জিত আছে। যদিও আমরা আইনটা সবাই জানি, কিন্তু আমাদের এখানে অফিশিয়ালরা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে মানতে চাই না। এখান থেকে আমরা যেদিন বেরিয়ে আসতে পারব, সেক্রিফাইস করতে পারব, শুধু খেলাটাকে মূল্য দেব, সেদিন থেকেই হকির সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।’
দেশের অগ্রসরমাণ খেলা থেকে হকি কেন পিছিয়ে গেল সেই ব্যাখ্যা দিলেন বিকেএসপির সাবেক হকি কোচ কাওসার আলী। সব্যসাচী এই ক্রীড়াবিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘হকি মাঝখানে পিছিয়ে গেল শুধু উদ্যোগের অভাবে। এখানে অবশ্যই কর্মকর্তাদের ব্যর্থতার কথাই বলতে হবে। হকি পিছিয়ে যাওয়ায় এখন খেলাগুলো হচ্ছে খুব অনিয়মিতভাবে। যদি ধারাবাহিকতা থাকত, তাহলে ক্রিকেট-ফুটবলের মতো হকিকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেত।’ কাওসার যোগ করে বলেন, ‘দুর্ভাগ্য যে হকিকে আমরা এখনো একটা ট্র্যাকে ফেলতে পারিনি। হকি লাইনে চললে অবশ্যই তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।’ এ জন্য কর্মকর্তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন একই সঙ্গে ফুটবল ও হকির শীর্ষ পর্যায়ে খেলা কাওসার।