সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনায় পলাতক আসামি সিয়াম হোসেন গা-ঢাকা দিয়েছিলেন নেপালে। সেই সিয়াম নেপাল পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র এমনটিই ইংগিত দিয়েছে। তাকে ধরতে খুব শিগগিরই নেপালে যেতে পারেন বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একটি দল। ডিবি এবং কলকাতার সিআইডির টিমও এই ব্যাপারে নেপালি পুলিশের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে বলে সিআইডি সূত্রে জানা গেছে।
কলকাতা পুলিশের একটি সূত্র ইংগিত দিয়েছে, খুব শিগগিরই হাতে আসতে পারে নেপালে আত্মগোপনকারী আরেক ঘাতক সিয়াম। সিআইডি সূত্র জানায়, নেপাল প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় কথাবার্তা চালাচ্ছেন বাংলাদেশের তদন্তকারীরা। উত্তরপ্রদেশ হয়ে নেপালে পালিয়ে গেছেন সিয়াম। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই যোগাযোগ করা হয়েছে নেপাল পুলিশের সঙ্গে। কাঠমান্ডু পুলিশের একটি সূত্রকে সিয়ামের আটকের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেননি।
এদিকে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনের আবাসনের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া মাংসের খণ্ডগুলোর ফরেনসিক ও ডিএনএ পরীক্ষার পর পুলিশ নিশ্চিত হবে ওই মাংসের টুকরা আদৌ সংসদ সদস্য আজীমের কি না। এরপর বাংলাদেশের গোয়েন্দারা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই মাংসের টুকরা দেশে আনবেন। সিআইডি সূত্রে এমনটাই জানানো হয়েছিল। তবে তার আগে আনোয়ারুল আজীমের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের কলকাতায় এসে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নিজের রক্তের নমুনা দেবেন। সেই ডরিনের ভিসা নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় কলকাতার তদন্ত আটকে আছে। এমনই খবর সিআইডি সূত্রের।
কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন সূত্রে জানা গেছে, ডরিনের সঙ্গে তার চাচার আসার কথা রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এমপি আনার হত্যার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে তার মেয়ের ভিসা নিয়ে এত দীর্ঘসূত্রতা হবেই বা কেন! যেখানে আনোয়ারুল আজীম হত্যা তদন্তে প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন দুই দেশের গোয়েন্দারাই।
প্রসঙ্গত, সংসদ সদস্য খুনে এখন পর্যন্ত বনগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জুবের ওরফে জিহাদকে। খুনের তদন্তে উঠে এসেছে হানিট্রাপের প্রসঙ্গও। সংসদ সদস্য খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছেন শিলাস্তি রহমান নামে এক মহিলাও।
এদিকে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য খুনের তদন্তে শুক্রবার (৩১ মে) একটি সিট (স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিং টিম) গঠন করেছে কলকাতা পুলিশ। আইজি, সিআইডি আর রাজশেখরনের নেতৃত্বে এই সিট গঠন করা হয়েছে। সেই দলে রয়েছেন দুই ডিআইজিসহ ১২ জন সিআইডি এবং কলকাতা পুলিশের অফিসার।
কোন পথে এগোচ্ছে তদন্ত
এমপি আনার খুনের রহস্যভেদ কবে হবে, এই প্রশ্নটিই এখন বড় হয়ে উঠছে। নিউ টাউনের আবাসনের সেপটিক ট্যাংক থেকে যে দেহাংশ মিলেছে তা কি ওই এমপিরই? সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে। দু-তিন দিনের মধ্যেই ডিএনএ টেস্টের নমুনা দিতে কলকাতায় আসবেন নিহতের মেয়ে ডরিন। একই সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উদ্ধার হওয়া দেহাংশের ফরেনসিক রিপোর্টও হাতে পেতে চাইছে সিআইডি।
শুক্রবার সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, যে রাস্তা দিয়ে গিয়ে কেষ্টপুর খালসহ বিভিন্ন জায়গায় এমপির পোশাক ফেলে দেওয়া হয়েছিল গত ২৪ ঘণ্টায় সেই রুটের সিসি ক্যামেরাগুলোর ফুটেজ সংগ্রহ করেছে সিআইডি।
এদিকে খুনের মাস্টারমাইন্ডের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে লুকআউট নোটিশ। রেড কর্নার নোটিশ জারির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
সিয়ামকে পেলেই বাকি দেহাংশ উদ্ধার করা যাবে
এমপিকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তার দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলার ঘটনায় নাড়া দিয়েছে দুই দেশকেই। ডিবির তথ্য অনুযায়ী, দেহের কিছু অংশ কমোডে ফ্ল্যাশ করা হয় এবং বাকি অংশ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তার হাড় এবং মাথার টুকরোগুলো একটি লাগেজে ভরে জিহাদ ও সিয়ামকে দেওয়া হয়, যারা এই দেহাংশগুলো কাছাকাছি খালে ফেলে দেন। জিহাদকে গ্রেপ্তার করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। এবার পুলিশ মনে করছে, সিয়াম ধরা পড়লেই বাকি দেহাংশ উদ্ধার করা যাবে।
পুলিশ জানিয়েছে, সেই ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া মাংসের টুকরোগুলোই সম্ভবত কমোডে ফ্ল্যাশ করা হয়েছিল। এখন বাইরে ফেলে দেওয়া খণ্ডিত অংশগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এই খোঁজেই খুনে জড়িত অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদকে গ্রেপ্তারের পর কলকাতা পুলিশ তাকে নিয়ে এক সপ্তাহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে। তবে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত কোনো দেহাংশ উদ্ধার করা যায়নি।
কলকাতা ও ঢাকার পুলিশ মনে করছে, সিয়ামের নাগাল পেলেই দেহের বাকি অংশগুলো উদ্ধার করা যাবে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিয়াম হোসেনের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনে। এলাকায় তিনি সাগর নামে পরিচিত। তার আসল বাড়ি বরিশালে হলেও বাবা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বালি ৪০-৪২ বছর আগে চাকরির সুবাদে বোরহানউদ্দিনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সিয়াম সেখানে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।
সিয়াম এলাকায় সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তার বাবা-মা ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, সিয়াম ঢাকার একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি করতেন। তার চাকরির সুবাদে প্রায়ই ভারত ও নেপালে যাতায়াত করতেন। জানা গেছে, সিয়াম বরিশাল, বোরহানউদ্দিন এবং ঢাকায় প্রচুর জমিও কিনেছেন। সম্প্রতি ২২ লাখ টাকা দিয়ে বরিশালে একটি জমি কেনেন।
সিয়ামের এক বাল্যবন্ধু জানিয়েছেন, গত দু-তিন বছরে সিয়ামের জীবনযাপনে প্রচুর পরিবর্তন আসে এবং তিনি প্রচুর টাকার মালিক হন। কয়েক দিন পর পরই তিনি ভারত ও নেপালে যেতেন। তবে ঢাকায় তিনি কী করতেন, তার উত্তরে তিনি একেক সময় একেক রকম উত্তর দিতেন। কিছুদিন আগেও ৪০ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন সিয়াম।