ঢাকা ১০ আষাঢ় ১৪৩১, সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪

কোরবানি: বাজারের পশু ও মনের পশু

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪, ০২:২৫ পিএম
আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪, ০২:২৫ পিএম
কোরবানি: বাজারের পশু ও মনের পশু
ড. তোফায়েল আহমেদ

হে নবী! ওদের বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ- আমার সবকিছুই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। এ আদেশই আমি পেয়েছি। আমি সমর্পিতদের মধ্যে প্রথম।-সুরা আনআম, আয়াত ১৬২-১৬৩

কোরবানি ও ঈদুল আজহার আনন্দ এক যুগলবন্দি ইবাদত। তার মাঝখানে থাকে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর পুণ্য স্মৃতির স্মরণ। যার প্রধান মর্মবাণী- সর্বোচ্চ ত্যাগ ও আত্মসমর্পণ। সব কিছুর ওপরে আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের প্রাধান্য প্রদান। মহান আল্লার ইচ্ছায় যে পরম ও চরম ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দুই মহান নবী- হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.) প্রদর্শন করেন এবং তাকে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত স্মরণীয় করে রাখা  কোরবানি ও হজের নানা নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে অনুশীলন করা হয়। পিতা সন্তানকে কোরবান করছেন এবং সন্তান স্বেচ্ছায় আল্লাহর ইচ্ছায় পিতার হাতে কোরবান হয়ে যাচ্ছেন। মাঝখানে মহান স্রষ্টার কেরামতে পশু কোরবানি হয়ে গেল। শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর উম্মতদের ওপর পশু কোরবানির আদেশ হয়। পূর্বের আরও নবী- রসুলের উম্মতের ওপরও কোরবানির বিধান ছিল।

প্রতিটি ধর্মীয় বিধিবিধান কালক্রমে নানা জাতি তার সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ করে নিয়ে থাকে। উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশেও নানা ইসলামি বিধি-বিধান ও আচার-অনুষ্ঠানের দেশীয়করণ বা সামাজিক আত্তীকরণ হয়েছে। আমাদের দেশে কোরবানির ঈদ ও গরু বেচাকেনা একটি মহা বড় অনুষঙ্গ। পৃথিবীর কোনো মুসলিম দেশে কোরবানির পশু জবাইতে গরুকে এত বড় ভূমিকায় দেখা যায় না। অনুমান করা হচ্ছে, কম-বেশি এক কোটি সাত লাখ গরু বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উপলক্ষে জবাই হবে। বিশ্বব্যাপী ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট, মহিষ কোরবানি হয়। কিন্তু সংখ্যায় গরু এবং বড় পশু কোরবানিতে সম্ভবত বাংলাদেশই প্রথম।

কোরবানির বহুবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তার মধ্যে একটি অত্যন্ত গঠনমূলক আলোচনা হচ্ছে, ‘‌কোরবানির অর্থনীতি’র আলোচনা। এক. পশুপালন কর্মকাণ্ড। এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বহু অর্থ লেনদেন এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবন-জীবিকা সম্পৃক্ত। অবশ্য পশু চোরাচালানও হয়। দুই. ঈদুল আজহার এই একটি সপ্তাহে পশু কেনাবেচায় হাজার কোটি টাকার নগদ লেনদেন। তিন. পশুর চামড়া, হাড় প্রভৃতি শিল্পপণ্য হিসেবে বাজারে আসা। তিন. পরোক্ষভাবে মসলা, লবণ এবং ঈদে ব্যবহার্য নানা খাদ্য ও বিলাসসামগ্রীর বাজার। সব মিলিয়ে ঈদের অর্থনীতি একটি বিশাল আলোচনার বিষয় হতে পারে। কিন্তু আমাদের ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদরা এসব বিষয় সেভাবে আলোচনায় আনেন না। এখানে অপচয়, অনিয়ম, দুষ্কৃতি ও দুর্নীতি রোধ করা গেলে এ অর্থনীতির সুফল পুরো জাতি পেত। ঈদুল আজহার একটি বড় দুষ্কর্ম হচ্ছে নানা জাতের চাঁদাবাজি। পরিবহনে চাঁদাবাজি, গরুর হাটে চাঁদাবাজি। তেল, লবণ, মসলার বাজারে কারসাজি, চামড়াশিল্প ও চামড়ার বাজার নিয়ে নানা অনিয়ম ও ধান্দাবাজি। একটি পবিত্র সময়কে কালো ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজরা কলুষিত করে।

সমাজ-সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও আসামঞ্জস্যতার শেষ নেই। প্রথমেই চেষ্টা করা হয়েছে এ কথাটি বলার জন্য যে, ঈদুল আজহা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান নয়। এটি ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠান বিশেষও নয়। এটি একটি মহান ইবাদত বা উপাসনা। উপাসনা করার জন্য যে পরম পবিত্রতা, হালাল রুজি ও খাঁটি নিয়তের শর্ত- তা এক্ষেত্রেও পরিপূর্ণভাবে প্রযোজ্য। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ হজ। হজ এ সময়ের একটি মহান ইবাদত। সে হজব্রত শেষে হাজিরা কোরবানি করেন। যারা হজ করছেন না, তাদের মধ্যে সামর্থ্যবানরা পশু কোরবানি করেন। পশুর মাংস খাওয়া ও বিতরণ কোরবানির প্রধান কোনো রীতি বা অঙ্গ নয়। এটি আনুষঙ্গিক বা ঐচ্ছিক বিষয়। পশু জবাই করে রক্ত বইয়ে দেওয়াটাই কোরবানি। নিয়ত সঠিক হলে জবাই করা পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কোরবানি কবুল হয়ে যায়। মাংস, চামড়া, হাড়গোড় দিয়ে কী করবেন, এর সঙ্গে কোরবানির সম্পর্ক খুবই গৌণ। তাই পবিত্র কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘কিন্তু মনে রেখো কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা। এ লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেওয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সে জন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবী! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।’-সুরা হজ, আয়াত ৩৭-৩৮।

হালাল খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য উপজাত, যা সমাজের উপকারে আসবে- তা ফেলে দেওয়া বা অপচয় করা নিশ্চয়ই  উচিত হবে না। তাই তা নিজে, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-দুঃখী সবার মধ্যে বণ্টন-বিতরণ অবশ্যই পুণ্যের কাজ। তা কীভাবে করা ভালো, তারও বিধান রয়েছে। সমাজে তার চর্চাও হচ্ছে। কিন্তু এখানে আমার এ বিষয়ে লেখার মূল আবেদনটি হচ্ছে, গরিবের নিকট মাংস বিতরণ, একাধিক গরু-মহিষ জবাই করে সামাজিক ভোজ, জৌলুস করে গরু কেনা এবং গরুর পিছনে যেভাবে সময়, সামর্থ্য ও সামাজিক প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশি সমাজ ঈদুল আজহাকে এক ‘গরু জবাই উৎসব’ হিসেবে পালন করে, তাতে কোরবানির মূল পবিত্রতা ও একটি মহান ইবাদতের বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত।

যার ফলে পশু কোরবানি সঠিকভাবে হয় না। ভালো খাওয়া-দাওয়া, উৎসব আয়োজন হয়। সবার ঘরে ( যারা মাংস খায়) কিছু না কিছু মাংস পৌঁছায়। অনেকে বলেন, গরিবের প্রোটিন ঘাটতি পূরণ হয়। কিন্তু অন্তরের পশুটি কোরবানি হয় না। সে পশু যথাস্থানে অবস্থান করে এবং যথাসময়ে হানা দেয়। সে পশু নদীর বালু, জলাধার, পরের জমি, ঘরবাড়ি দখল করে। ছিনতাই-রাহাজানি, অবৈধ কন্ট্রাক্ট, নির্মাণে সিমেন্ট-বালু অনুপাত ঠিক রাখে না, রডের বদলে বাঁশ, ওষুধে ভেজাল, ফাইল ঠেকিয়ে অর্থ আদায়, সোনা চোরাচালান, মানিলন্ডারিং, বিনাভোটে বা ভোট চুরি করে নেতা হয়। প্রতি বছর হাতির মতো গরু, মহিষ, উট কোরবানি করে। কিন্তু তার চেয়েও বড় পশু বা পাশবশক্তিকে ভেতরে রীতিমতো লালন-পালন করা হয়। সে শক্তি সমাজকে তছনছ করে।

ধর্ম বা ধর্মের অন্তর্নিহিত গূঢ বিষয়কে বিকৃত আনুষ্ঠানিকতার মোড়কে ঢেকে ফেলায় আমাদের জুড়ি নেই। আনুষ্ঠানিকতা ও আচার সত্যিকারের ধর্ম নয়। হজ-উমরা পালন এবং ঈদুল আজহায় গরু জবাই উৎসবের ক্ষেত্রে বিষয়টি এখন প্রায় ধর্মীয় আবেদনের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। একই বিচ্যুতি রমজানেও আমাদের হয়। রমজানের শুদ্ধতা ও সংযমের চেয়ে বাহারি ইফতারে এবং ঈদের কেনাকাটায় বাজার ও বিজ্ঞাপন আমাদের বেশি প্রভাবিত করে। আত্মশুদ্ধি ও সংযমবিযুক্ত রোজা নিছক উপবাস। তাতে হয়তো মেদ হ্রাস হতে পারে বা অন্যান্য শারীরিক উপকার হতে পারে, কিন্তু রমজানের আধ্যাত্মিকতা ও শুদ্ধাচারী হওয়ার যে সুফল, তা আসবে না। একইভাবে নতুন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক কল্যাণমুখী কাজ হিসেবে কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে সরকার ও জনগণ দেখতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি মুসলমানের সত্যিকারের ধর্মীয় তাৎপর্য ও ইবাদতের বিষয়টি ভূলুণ্ঠিত হতে থাকবে।

লেখক: শিক্ষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected]

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার আলোকে এগিয়ে যাবে

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১১:০৫ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ১১:০৫ এএম
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার আলোকে এগিয়ে যাবে
এম. হুমায়ুন কবির

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক আশাব্যঞ্জক ও ফলপ্রসূ হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ১৩টি ইস্যুতে তারা পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিবাচক উন্নয়নে আলোচনা করেছেন। আমরা জানি, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বেশ গভীর এবং বিস্তৃত। ভারত আমাদের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী, একই সঙ্গে বন্ধুপ্রতিম দেশ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে অমীমাংসিত কিছু বিষয়ের পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে অর্থনৈতিক এবং যোগাযোগের বিষয়টি। দুই দেশকেই মনে রাখতে হবে যে, নিকট প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক সুষম হলে তা টেকসই ও গতিশীল হবে।

ভারতে এবারের সাধারণ নির্বাচন বলা যায় অনেকটা ড্রামায় পরিপূর্ণ ছিল। তার কারণ হচ্ছে, নির্বাচনের আগেই এ নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। সে ক্ষেত্রে ইতিবাচক না হলেও নেতিবাচক একটা প্রভাব দেখা গেছে। তার কারণ ছিল অনেকেই মোটামুটি প্রত্যাশা করছিলেন যে, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার যে ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক অবস্থান, অর্থাৎ তার যে ভাবমূর্তি, এতে বিজেপি তাকেই পুঁজি করে তাদের এই নির্বাচনি ছকটা সাজিয়েছিল। সাম্প্রতিককালে ভারতে গত ১০ বছরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের যে ব্যত্যয়গুলো ঘটেছে, যেমন রাজনৈতিক নেতাদের তার পার্লামেন্ট থেকে বের করে দেওয়া, দুর্নীতির অপরাধে জেলে পাঠানো, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা। নির্বাচন কমিশন থেকে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে মোটামুটিভাবে প্রভাব বিস্তার করার মতো বিষয়গুলো সামগ্রিক অবস্থার কারণেই লোকজন ধরে নিয়েছিল বিজেপি ক্ষমতায় আসবে। বিজেপি একটা স্লোগান আকারে রূপান্তিত করেছিল যে, এবার ৪০০-এর বেশি আসন পেয়ে যাবে। বিজেপি যথেষ্ট পরিমাণ আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, এ রকম একটা ফলাফল আসবে। দ্বিতীয় ড্রামায় যেটা দেখা যায়, ৪ জুনে ফল ঘোষণা হলো, তার দু-এক দিন আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মিডিয়া বিজেপির পক্ষে বরাত দিতে শুরু করে। এবার বিজেপি এবং তার সহযোগীরা বেশ ভালো ফল করবে। তারা প্রায় ৩০০-৪০০-এর কাছাকাছি আসন পাবে, এমন আশ্বাস দিয়েছিল। 

বাস্তবতা ছিল, এই বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা বিজেপি সরকার বা এনডিএ সরকার, তারা যে সরব অবস্থানে ছিল, সেখানে তাদের বিরোধীদের কোনো অবস্থায়ই সুযোগ নেই। কিন্তু ফলাফল যখন বেরিয়ে এল, তখন দেখা গেল চিত্রটা ভিন্ন। বিজেপি ১০ বছর ধরে শাসন করছিল এবং তারা জনমনে এমন একটা বার্তা প্রেরণ করেছিল যে, তাদের বিজয় অনিবার্য। কিন্তু ভারতের জনগণের চিন্তা ভিন্ন ছিল, যা ভোটে প্রকাশ পেয়েছে। বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠনের মতো অবস্থায় পৌঁছতে পারেনি। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো বিজেপির ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। বিজেপি এবং মোদির ভাবমূর্তি কিছুটা নষ্ট হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে কেন্দ্র করে তারা নির্বাচনি ইশতেহারটা তৈরি করেছে যে, ভোট দিতে হবে মোদিকে। সে ক্ষেত্রে জনগণ যখন বিজেপিকেই স্বাভাবিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিল না, তখন কিন্তু প্রকারান্তরেই মোদির নেতৃত্বের ওপর থেকে একধরনের অনাস্থা প্রকাশ হলো। দ্বিতীয়ত, বিজেপি দল হিসেবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সে ক্ষেত্রে বিজেপি যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভারত শাসন করছিল, ভারতের জনগণ সে পদ্ধতিতে একমত হতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল তাদের সহযোগীদের নিয়ে পার্লামেন্টে একটা উল্লেখযোগ্য বিরোধী দলের ভূমিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এটা বলা যায় যে, ভারতের জনগণ তাদের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পেরেছে। ভারতের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জিদ বা বিচ্ছেদ বা শঙ্কা তৈরি হচ্ছিল, যেই শঙ্কা ভারতের জনগণ সক্রিয়ভাবে দূরীভূত করতে পেরেছে। সক্রিয়ভাবে নির্বাচনের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পেরেছে। 

গত ১০ বছর ধরে বিশেষ করে এই নির্বাচনের প্রচারকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে বাজে বা কটু মন্তব্য করেছিলেন। মনে করা হয়েছিল, এতে করে তিনি হয়তো আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে তার পক্ষে নিয়ে আসতে পারবেন। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল, উত্তর প্রদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে যে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক দাঙ্গা বেগবান হয়েছিল, সেই উত্তর প্রদেশেই তারা হেরে গেল। অর্থাৎ তারা গত নির্বাচনে যে আসন পেয়েছিল, তার অর্ধেকে নেমে গেল। সেখানে কংগ্রেস ও সহযোগী সমর্থকরা খুব ভালো ফল করেছে। তারাই কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। কাজেই উত্তর প্রদেশের বিজেপির এই পরাজয়টা শুধু ভোটে নয়, বিজেপির রাজনৈতিক ধারার প্রতি ভারতের জনগণের অনাস্থা প্রকাশ পেল। 

আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল, সেখানেই রামমন্দির তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এ বছরের জানুয়ারি মাসে এই মন্দির উদ্বোধন করেন। উত্তর প্রদেশে জনগণ ধর্মীয় রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি রামমন্দির যে জায়গায় তারা সেটাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। সেখানে তারা বিজেপিকে ভোট দিয়ে জয়ী করেনি। ভারতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ক্ষেত্রেও উত্তর প্রদেশে নির্বাচন একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। 

ইতোমধ্যে সরকার গঠিত হয়েছে। এনডিএ জোট বস্তুত ১৯৯৯ সাল থেকেই ক্ষমতায় আছে। কিন্তু গত সরকার এনডিএ জোটেরই সরকার ছিল। যেহেতু বিজেপির নিজস্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, সেহেতু এনডিএ জোটের প্রয়োজন হয়নি। সেটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেখানে মোদি ব্যক্তি হিসেবেই বিজেপির চেয়েও বড় হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা তৈরি হয়েছিল বা কেন্দ্রিকতার প্রক্রিয়াগুলো শুরু হয়েছিল। এবার যেহেতু বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই; এবারের নির্বাচনে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। ভারতে নব্বইয়ের দশকে যে কোয়ালিশন রাজনীতি ছিল, সেটা আবার প্রকারান্তরে ফেরত এসেছে। এখন একক দলের নেতৃত্বের চেয়ে কোয়ালিশন সরকার আসার একটা সুযোগ তৈরি হলো।

কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে গত ১০ বছরে যে সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছিল, সেখানেও একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে। এখন রাজ্যগুলোকে কেন্দ্রের ওপর আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। এখানে সবাই বিজেপিকে কেন্দ্রে থাকার যে সমর্থন দিচ্ছে তার বিনিময়ে কিন্তু তারা কিছু চাইবে। চাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্কে একটা ইতিবাচক দ্বিবচনের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে হয়। ভারতের জনগণ গণতন্ত্র রক্ষা করেছে। তারাই এই নির্বাচনের নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিজেপি এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে একটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ভারতের জনগণ সেটা ভোটের মধ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে। ভারতে আবার সেই কোয়ালিশন সরকারের পুনরুত্থান দেখতে পাচ্ছি। এবার লোকসভায় বিরোধী জোট আছে, সে কারণেই স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পার্লামেন্ট যেভাবে কাজ করে, সেভাবে কাজের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূলমন্ত্র দায়বদ্ধতা, যা সরকারকে মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। সেই জায়গাটা শক্তিশালী হবে বলে মনে হয় এবং পার্লামেন্টটা প্রাণবন্ত হবে। আরেকটা বিষয় হলো, কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ করছি- আগামী ৫ বছরে মোদি সরকার অর্থনীতি নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন। ভারতের অর্থনীতিতে তা দৃশ্যমান বলে মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে এই অর্থনীতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এখন ভারতে কর্মসংস্থান, মানুষের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন ইত্যাদি কাজগুলোকে এখন প্রাধান্য দিতে হবে।

মোদি সরকার অর্থনীতির দিকে বেশি মনোযোগ দেবে। ধর্মীয় বিষয়টায় ততখানি মনোযোগ হয়তো দেবে না। কারণ তারা বিজেপির রাজনীতি বজায় রাখতে চেষ্টা করবে। কিন্তু ধর্মীয় বা এ ধরনের উগ্র চিন্তার জায়গায় অর্থনীতির প্রতি মনোযোগী হওয়াটা বোধ হয় এই সরকারের বিষয় হবে। তারই একটা ভিন্নতা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি।

তিস্তা সমস্যার সমাধান হওয়া খুবই দরকার। তিস্তার পানিবণ্টনের সঙ্গে আরও ছয়-সাতটি নদীর পানি এবং গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়টা যোগ হয়েছে। আমরা এ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানমুখী চিন্তায় আগ্রহী। এ বিষয়ে জনমনে যথেষ্ট প্রত্যাশা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ বিস্তৃত। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কে ছাড় কিংবা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্দর, রেলওয়ে ব্যবহারে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুষম সুযোগ পেতে বাংলাদেশ কী সুবিধা পেতে পারে, সেগুলো নিয়ে পরস্পর আলোচনা নানা আঙ্গিকেই যুক্তিসংগত। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু উত্তর-পূর্ব ভারত নয়, অন্য রাজ্যগুলোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ বাড়তে পারে সে বিষয়ে কাজ করতে হবে। নৌপরিবহনে জোর দিতে নৌযোগাযোগকে সমৃদ্ধ করা আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ বিষয়টিও চর্চায় রাখতে হবে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে আগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে দুই দেশের বাইরে আঞ্চলিক ইস্যুগুলোতেও একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা যেমন ভারতের প্রয়োজনীয়তাকে সম্মান জানাই, তারাও বাংলাদেশের মানুষের প্রয়োজনীয়তা, প্রত্যাশাকে সম্মান করবে- এটাই সবার চাওয়া। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে তৈরির কিছু নেই। চলমান বোঝাপড়াটাকেই শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হবে। যেগুলো সম্ভাবনার জায়গা আছে, সেগুলোর বিষয়ে অগ্রগতি হলে এই সফর অথবা আলোচনাটা সার্থক হবে। যেমন সীমান্ত হত্যা যদি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি হয়, সেটিও একটি অগ্রগতি হিসেবে ধরতে হবে আমাদের। এর পাশাপাশি বহুকাল ধরে ঝুলে থাকা ভারতে পণ্য রপ্তানিতে আধা শুল্কের মতো সমস্যাগুলোর সমাধান হওয়ার মতো বিষয়গুলোও আমাদের জন্য সফলতা। ভারতের দিক থেকে যদি বলি তারা হয়তো কানেক্টিভিটি বাড়াতে চাইবে। এর পাশাপাশি নতুন এরিয়ায় তারা যেতে চাইবে, যেমন মোংলা বন্দর। এখন যেতে চাওয়া আর কার্যকর হওয়া ভিন্ন বিষয়। সেটি যাতে কার্যকরযোগ্য হয় ও উভয়েই সুষমভাবে সুযোগ-সুবিধা পায় তা মনে রাখতে হবে।

আমাদের দিক থেকে মনে করি বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় কাঠামোর মধ্যে এটিকে সমৃদ্ধ করার জন্য আমরা দুই পক্ষই চেষ্টা করতে পারি। ভারত ও চীনের মধ্যে বিরাজমান প্রতিযোগিতা দিয়ে বাংলাদেশকে দেখা সঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশের দিক থেকে আমরা দ্বিপক্ষীয় চিন্তাভাবনার আলোকেই সম্পর্কটা বাড়াতে ও সমৃদ্ধ করতে চাই। সেটাকে চীনের আলোকে দেখা উচিত হবে না। আমাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ আছে। একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট যে, ভারতের সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করা যায়, সেগুলো নিয়েই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে যেসব ইস্যুতে কাজ করা জরুরি এবং সেটি করতে গিয়ে দুটি পক্ষকেই স্বপ্রণোদিত হতে হবে। আমাদের আশ্বস্ত হতে হবে যে, ভারত ও চীন কারোরই যাতে ক্ষতি না হয়। বাংলাদেশকে সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে হবে। এ কাজগুলো করতে গিয়ে আমরা পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার আলোকে এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে গেলে দুই দেশই লাভবান হবে। পাশাপাশি দুই দেশের জনগণও পরস্পর আন্তরিক ও সন্তুষ্ট হবে।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ব্যাপকভাবে শুরু হোক

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১১:০১ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ১১:০৫ এএম
দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ব্যাপকভাবে শুরু হোক
মো. সাখাওয়াত হোসেন

দুর্নীতি একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে তলানির দিকে নিয়ে যেতে পারে; দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা রাষ্ট্র তথা পৃথিবীর জন্য একটি অশনিসংকেত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আজ সবাই সোচ্চার। এটি একটি ইতিবাচক ও সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম একটি অংশীদারত্বের বিষয়। তা হলে দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত, এ প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়। এ ব্যাপারটিকে আমলে নিয়ে গুরুত্ব প্রদান করা ব্যতিরেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনোভাবেই সফল হবে না। যে বা যারাই যে সেক্টর থেকেই আসুক না কেন; কেউ যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে- তার বিরুদ্ধে যথাযথ অ্যাকশন গ্রহণ করতে হবে। জানিয়ে দিতে হবে দুনিয়াকে, দুর্নীতিবাজের জায়গা সভ্য সমাজে নেই। দুর্নীতিবাজরা সমাজের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হয়। দুর্নীতির মাত্রা অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মতো। যে ব্যক্তি বা সংস্থা দুর্নীতির মধ্য দিয়ে পদ আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় কিংবা অধিক সম্পদের মালিক হতে চায়, তাদেরও দুর্নীতির পথ অতিক্রম করতে হয়। অর্থাৎ তাদেরও কোনো না কোনো দুর্নীতিবাজকে খুশি করতে হয় কিংবা দুর্নীতিবাজদের তোয়াজ করে চলতে হয়। সে কারণেই বলা যায়, দুর্নীতির বিষয়বস্তু একটি চেইনের মতো। যে প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি হয় সেখানে দেখা যাবে টপ টু বটম সবাই কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কাজেই দুর্নীতিকে সমস্বরে বিদায় বলে দেওয়ার সময় হয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম পাঠ হওয়া উচিত নিজের কর্মস্থল কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রত্যেকেই যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাতারে শামিল হতে পারে, তা হলে বাংলাদেশের ললাট থেকে দুর্নীতির বিষবাষ্পকে সহজেই বিতাড়িত করা সম্ভব হবে। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং সরকারের প্রতিটি সেক্টরে এ নীতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কাজে লাগানোর তাগিদ প্রদান করতে হবে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতি নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতির কথা শুধু মুখে মুখে বললে হবে না; কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে, তার তথ্যও দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিলে সরকার ব্যবস্থাও নেবে। এ দফা ক্ষমতায় এসে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ জনগণকে যে কথা দেয়, সে কথা রাখে। যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা পালন করে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে বলেই জনগণ তার সুফলও পাচ্ছে। ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রকাশ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করেছিলেন। মন্ত্রিসভা গঠনের পর তিনি মন্ত্রীদের দুর্নীতি সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন। পরবর্তী সময় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে দুর্নীতিবিরোধী সুনির্দিষ্ট চারটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছিলেন- যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের আত্মশুদ্ধি চর্চা করতে হবে; আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে; তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণ করতে হবে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।

গত কয়েক মাসে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়ে ‘বিগফিশ’দের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এমনকি পুলিশপ্রধান থেকে শুরু করে যাদেরই বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তাদেরই বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দুর্নীতি কোন দেশে হয় না, এ দাবি কেউ করতে পারে না। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে দুর্নীতির মহোৎসব শুরু হয় বিএনপির আমলে। আমাদের সরকারপ্রধান দুর্নীতি করেন বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন- এমন অভিযোগ কেউ করতে পারবে না। তিনি সৎ জীবনযাপন করেন।’ মন্ত্রী বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। তদন্ত-মামলা-গ্রেপ্তার সবকিছুর একটা আইনি প্রক্রিয়া আছে। সরকার এখানে দুদককে ডিঙিয়ে আগ বাড়িয়ে কেন ব্যবস্থা নেবে? সরকারের দুর্নীতিবিরোধী যেসব সংস্থা আছে, তাদের কোনো ব্যর্থতা থাকলে তারও বিচার হবে।’

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট ক্যাসিনোকাণ্ডে সংগঠন থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ওমর ফারুকসহ অনেক প্রভাবশালী নেতাই এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠায় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। রেজওয়ানুল ও রাব্বানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ থেকে চাঁদা দাবি করেন বলে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম অভিযোগ তোলার পর ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন সাঈদ খোকন। তার বাবা মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটির প্রথম নির্বাচিত মেয়র। ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, দলীয় কোন্দলে যুক্ত হওয়া, সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সব মিলিয়ে মনোনয়ন পাননি তিনি। মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুরু থেকেই নানা বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেন সাঈদ খোকন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টারসংলগ্ন আওয়ামী লীগের কর্মী সমাবেশের পাশে পাল্টা কর্মসূচি দেন সাঈদ খোকন। এমনকি আওয়ামী লীগের ওই সমাবেশের সামনে ট্রাকে করে সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার ঘটনায় তাকেই দোষারোপ করা হয়। 

আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় হাওয়া ভবনের মতো ঘটনার জন্ম হয়নি। হাওয়া ভবনের সংস্কৃতির কারণে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি-গোষ্ঠীর মানুষ দেশব্যাপী দুর্নীতির একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার পাঁয়তারা করেছিল। পরে সরকার পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে হাওয়া ভবনের দুর্নীতির বিষয়টি সবার গোচরীভূত হয়। এ ধরনের অপকর্মের কারণে রাজনীতিতে বিএনপি জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বলা যায়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের রাজনৈতিক অভিযান চালানো উচিত। খবরের কাগজে অভিযোগ পাওয়া যায়, দলীয় পদ-পদবি পেতেও অবৈধ টাকার লেনদেন হয়। এ ধরনের সংবাদ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। নির্বাচনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে টাকা লেনদেনের অভিযোগের সংবাদও আমাদের গোচরীভূত। একটি প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহির মধ্য দিয়ে নিয়ে আসার জন্য ইন্টার্নাল ও এক্সটার্নাল মেকানিজম অত্যন্ত অর্থবহ হিসেবে দেখা দিয়েছে। 

ইন্টার্নাল মেকানিজম সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হয়ে থাকে এবং এখানে প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে সৎ মানসিকতার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা থাকতে হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দল ও সরকারের মধ্যে যারা দায়িত্বশীল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে- তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক ও অন্যদের জন্য একটি দৃষ্টান্তও বটে। কেননা বর্তমানে যারা দায়িত্বশীল পদে কাজ করছেন তাদের মধ্যে এ ভয়টি অবশ্যই কাজ করবে যে, দুর্নীতি করলে কোনোভাবেই ছাড় পাওয়া যাবে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর দুর্নীতি প্রকাশ পাবেই- এ ভাবনা থেকে যাদের দুর্নীতিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ রয়েছে, তারাও সরে আসবে। 

অন্যদিকে এক্সটার্নাল মেকানিজম বলতে সংবাদমাধ্যমসহ অন্যান্য এজেন্সি হিসেবে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তাদের ভূমিকাকে তুলে ধরা হয়। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণেই অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। পরবর্তী সময়ে দুদক অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে। সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিশেষ করে সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ ছাড়া গবেষণাধর্মী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা দুর্নীতির তথ্য-উপাত্তকে প্রকাশ করে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এক বাক্যে সবার সমর্থন প্রদান করা উচিত এবং যে যার জায়গা থেকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সমাজ থেকে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের প্রতিহত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
 
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের স্বার্থ যেন রক্ষা হয়

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:১২ পিএম
আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:১৪ পিএম
বাংলাদেশের স্বার্থ যেন রক্ষা হয়
মুন্সি ফয়েজ আহমদ

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি যা-ই হোক না কেন, তাতে যেন বাংলাদেশের স্বার্থটা আমরা ঠিকমতো রক্ষা করতে পারি, সেই বিষয়টা সব সময় মাথায় রাখতে হবে। আমাদের কাছে যেন বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করাটাই মূল লক্ষ্য হয়। 

প্রধানমন্ত্রীর সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যে অনেক সহযোগিতা চলছে। সেই সহযোগিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

দুই দেশেই নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের পর দুই দেশই নতুন করে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে চায়। নতুন নতুন বিষয় নিয়েও চুক্তি হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি যে খুব ভালো কিছু হবে। 

তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে ভারত আগ্রহ দেখাচ্ছে, এটা ইতিবাচক। আমি মনে করি না যে ভারত তিস্তা প্রকল্পে যুক্ত হলে ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে। যদিও এমন আশঙ্কা অনেককেই করতে দেখি। আদতে তা ঠিক নয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত

সফরে নতুন একটা রোডম্যাপ হয়েছে

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:০২ পিএম
আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:১৪ পিএম
সফরে নতুন একটা রোডম্যাপ হয়েছে
শহীদুল হক

খুবই ভালো সফর হয়েছে। একটা নতুন রোডম্যাপ হয়েছে। দুদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্মত হয়েছেন যে, সমন্বয়ের মাধ্যমে নতুন ডেভেলপমেন্টের পথে যাত্রা হবে। যেখানে দুই দেশ একে অপরকে সহযোগিতা করবে। 

এবার মেরিটাইমে ফোকাস করা হয়েছে। ডিজিটাল পার্টনারশিপের কথাও বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে সফর খুব ভালো হয়েছে। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, একটি টেকনিক্যাল টিম আসবে। তারা কনজার্ভেশন এবং ডেভেলপমেন্টের বিষয়টা দেখবে। 

তিস্তা প্রকল্পে ভারতের যোগ নিয়ে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন যে, এতে ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের টানাপোড়েন হতে পারে। আদতে বিষয়টা কিন্তু তেমন না। বাংলাদেশ যেখানে ভালো পাবে, সেখানেই যাবে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। 

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব 

আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১০:৫৫ এএম
আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১১:১১ এএম
আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস
তোফায়েল আহমেদ

মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা দলের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। কারণ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেন, ‘এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ ’৪৭-এর শেষে বঙ্গবন্ধু সতীর্থ-সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১৫০, মোগলটুলিতে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ সংগঠিত করেন এবং ’৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ‘ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। 

একই বছরের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে সূচিত হয় প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মহান ভাষা আন্দোলন। ’৪৯-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের দাবিদাওয়া আদায়ের সংগ্রাম সংগঠিত করার কারণে ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে কারারুদ্ধ ও পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে শর্ত দেওয়া হয়, যদি তিনি মুচলেকা দিতে সম্মত থাকেন, তবে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। 

বঙ্গবন্ধু অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করেননি। ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্মকালে বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ ছিলেন। এ সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হলো ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হলো জয়েন্ট সেক্রেটারি।” 

’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু তখন কারারুদ্ধ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ কর্তৃক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কর্মসূচির সঙ্গে কারাগারেই তিনি একাত্মতা প্রকাশ করে অনশন করেন। ’৫৩-এর ১৪ নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিলে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ’৫৪-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘যুক্তফ্রন্ট’ ভূমিধস বিজয় অর্জন করে এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৫ মে সমবায়, ঋণ ও গ্রামীণ পুনর্গঠনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। 

কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার বরখাস্ত ও বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ করে। ’৫৫-এর ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‌‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগ সর্বধর্মের মানুষের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ’৫৬-তে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ’৫৭-এর ৮ আগস্ট মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তার কাছে দলের দায়িত্ব মন্ত্রিত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

’৫৮-এর ৭ অক্টোবর মধ্যরাতে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং রাজনীতিকদের কারাগারে নিক্ষেপ এবং রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন। একই বছরের ১২ অক্টোবর একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ’৬২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। 

রাজনীতিকদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে জেল-জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৫ জুলাই আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুবের শাসনের কঠোর সমালোচনা করেন। ’৬২-তে আমাদের স্লোগান ছিল- ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’। ’৬৪-এর ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করা হয়।

এই সভায় ‘প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে সংসদীয় সরকার’ ও ‘রাজনৈতিক অধিকার’ আদায়ের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছরের ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সময় দেশজুড়ে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠিত হয়। দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও।’ 

’৬৬-তে ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন ‘সাঁকো দিলাম, এই সাঁকো দিয়েই একদিন আমরা স্বাধীনতায় পৌঁছাব।’ ৮ মে নারায়ণগঞ্জে এক বিশাল সমাবেশে ভাষণদান শেষে রাত ১টায় বাসায় ফিরলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। 

গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘সাতই জুন’ হরতাল আহ্বান করা হয়। ৭ জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। সফল হরতালের পর বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন, ‘১২টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয় দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তিস্বাধীনতা চায়। 

শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়- এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।’ (পৃষ্ঠা-৬৯)। ছয় দফা দেওয়ায় সামরিক শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ তথা আগরতলা মামলার আসামি করে তাকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করে। 

জাগ্রত ছাত্রসমাজ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ৬ দফাকে ১১ দফায় হুবহু অন্তর্ভুক্ত করে আসাদ, মকবুল, রুস্তম, মতিউর, আনোয়ারা, আলমগীর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. শামসুজ্জোহাসহ নাম না জানা অগণিত শহিদের রক্তের বিনিময়ে ’৬৯-এ প্রবল গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে ২২ ফেব্রুয়ারি জাতির জনককে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক লোকের জনসমুদ্রে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। এর কিছুদিন পর স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। তখন আমাদের স্লোগান ছিল- ‘পাঞ্জাব না বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা’। 

’৭০-এর ২ জুন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের উপস্থিতিতে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ভোলা-দৌলতখাঁ-তজুমুদ্দী-মনপুরা আসন থেকে আমাকে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র ২৭ বছর ১ মাস ১৫ দিন বয়সে আমি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই ভোলা যাবি। সকল এরিয়া সফর করবি। আমি তোকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিব।’ 

এই কথাটা ভীষণভাবে আমার হৃদয়কে আলোড়িত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো ভোলা সফরে যাই এবং ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে- তখন ভোলায় রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না- ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাই। বঙ্গবন্ধু ১৭০০ টাকা দিয়ে আমাকে একটা মোটরবাইক কিনে দিয়েছিলেন। এই মোটরবাইক ছিল আমার বাহন। 

গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাবাকে জানালাম- বাবা, বঙ্গবন্ধু আমাকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এমএনএ পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমি বাবার দোয়া নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। মনে পড়ে ১২ নভেম্বর ’৭০-এর কথা। যখন জলোচ্ছ্বাস হয় তখন কত মানুষ সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যুবরণ করেছে। বঙ্গবন্ধু সেদিন বিধ্বস্ত ভোলায় গিয়েছেন। ভোলার পথে-ঘাটে মৃতদেহের স্তূপ দেখে তিনি তা সহ্য করতে না পেরে আমাদের অসহায় আর্তমানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। 

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘এই নির্বাচন ৬ দফার পক্ষে গণভোট।’ ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৬ দফা সমুন্নত রাখার শপথ গ্রহণ করান বঙ্গবন্ধু। 

সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তখন নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়; দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। লাখ লাখ লোক রাজপথে নেমে আসে। শুরু হয় ১ দফা তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম। 

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেন এবং বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ডাকে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হাতিয়ার তুলে নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমির বীর সন্তানরা ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষাধিক শহিদ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে বাংলাদেশ স্বাধীন করে।

দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেন। গোলাঘরে চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই। রাস্তাঘাট-পুল-কালভার্ট, রেল, প্লেন, স্টিমার কিছুই নেই। যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু অতি তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করেন। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো ধ্বংস করেছিল, সেগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। 

বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ’৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ’৭২-এর ৭-৮ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু পুনরায় সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর মাত্র ১০ মাসে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান প্রণয়ন ও ৭ মার্চ জাতীয় সংসদের সফল নির্বাচন করে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। 

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি এবং ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। 

বিশেষভাবে মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফরের দিনগুলোর কথা। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে তিনিই ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। মুক্তিযুদ্ধের পরম মিত্র প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের জনসমুদ্রে অসাধারণ বক্তৃতা করেন। 

তারপর ১ মার্চ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছিল। ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে কমনওয়েলথ সম্মেলনে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়। 

তন্মধ্যে জীবিত ২ জন নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু ও মার্শাল টিটো। প্রয়াত ৪ জন নেতা ছিলেন মিসরের নাসের, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ঘানার নক্রুমা এবং ভারতের জওহরলাল নেহরু। আলজেরিয়ার মঞ্চেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ ’৭৩-এর ৯ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জাপান সফরে যান। 

জাপান সফরের মধ্য দিয়ে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়, তা আজও অটুট রয়েছে। বিশেষভাবে মনে পড়ে ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করা হয়, ‘আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ 

এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের সঙ্গে বৈঠক করেন। ১ অক্টোবর ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে ৬ দিনের সফরে ’৭৪-এর ৩ অক্টোবর ইরাকের রাজধানী বাগদাদ পৌঁছান। সেখানে রাষ্ট্রপ্রধানসহ সবাই বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন। ’৭৫-এর ২৯ এপ্রিল থেকে ৬ মে জ্যামাইকার কিংস্টনে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে তার সরব উপস্থিতি সবাইকে মুগ্ধ করে।

বঙ্গবন্ধু যে মুহূর্তে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে স্বাভাবিক করেন, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি দেন, ঠিক তখনই ঘাতকের নির্মম বুলেটে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, বাংলার মীরজাফর বেইমানরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সেই পথ ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন। 

বহু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং আরও সমাপ্তির পথে। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার উদ্যোগেই ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প সমাপ্তির পথে। বিগত ১৬ বছরের পথপরিক্রমায় প্রমাণিত হয়েছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী উন্নয়ন দর্শন। এখন সরকারের লক্ষ্য- বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরিত করা। 

এ ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে যদি আমরা কর্মক্ষম জনসম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি, তা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সূচিত কর্মসূচি- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি- এই চারটি মূল ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আগামী ২০৪১-এর মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভবপর হবে মর্মে আমি আশাবাদী।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খুনি চক্র মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ’৮১-এর ১৭ মে স্বদেশের মাটি স্পর্শ করে শহিদের রক্তে ভেজা আওয়ামী লীগের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তথা অর্থনৈতিক মুক্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছেন। 

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে এ দেশের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। দুই যুগের অধিককাল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। 

জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বব্যাংক রক্তচক্ষু প্রদর্শন করে কায়েমি স্বার্থবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের দিয়ে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাধাগ্রস্ত চেয়েছিল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা ও অদম্য ইচ্ছার ফলে সে বাধা অপসারিত হয়েছে এবং পদ্মা সেতু আজ শুধু দক্ষিণাঞ্চলের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের অথনৈতিক উন্নয়নে গতি আনছে। জাতির পিতা দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। 

একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার সঙ্গে করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সব ধরনের প্রতিকূলতা জয় করে স্বাধীন বাংলাদেশ হবে মর্যাদাশালী ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক: সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ 
[email protected]