ঢাকা ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪

রক্তদান সুস্থ সক্ষম মানুষের নৈতিক দায়িত্ব

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৪, ১১:২৫ এএম
আপডেট: ১৪ জুন ২০২৪, ১১:২৫ এএম
রক্তদান সুস্থ সক্ষম মানুষের নৈতিক দায়িত্ব
শামীমা নাসরিন মুন্নী

রক্তদান মহৎ এক সৎকর্ম। আপনি যে সুস্থ আছেন এর শুকরিয়ার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রক্ত দান করুন। অনেকে আছেন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রক্ত দান করার সুযোগ পান না। কারণ শারীরিক নানা জটিলতা তাকে রক্ত দান করতে অনুমোদন দেয় না। একবার ভাবুন, আপনি রক্ত দিতে পারছেন, এটি আপনার জন্য কত বড় সৌভাগ্যের। আপনাকে রক্তগ্রহীতা হতে হয়নি। অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্রতি মাসে রক্ত সংগ্রহ করতে হয়। 

এসব রোগীর রক্ত সংগ্রহ করতে দেরি হলে খাবারে অরুচি, মাথা ঘোরা, ঝিমঝিম ভাবসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। একটু চিন্তা করুন তাদের কথা। সে হিসেবে আমরা কত ভালো আছি!

আল্লাহ বলেছেন, ‘যখন কেউ নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যখন কেউ কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করল।’ 

রক্তদানের শারীরিক উপকারিতা বহুবিধ। যারা নিয়মিত রক্ত দান করেন, তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ৮৮ ভাগ কম এবং স্ট্রোকসহ অন্যান্য মারাত্মক রোগের ঝুঁকি ৩৩ ভাগ কম। নিয়মিত রক্ত দিলে ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যানসারের ঝুঁকি। 

রক্তদানের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বোন ম্যারো নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। রক্ত দান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। আর লোহিত কণিকার ঘাটতি পূরণ হতে সময় লাগে চার থেকে আট সপ্তাহ। এই পুরো প্রক্রিয়া দেহের সার্বিক সুস্থতা, প্রাণবন্ততা আর কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। 

কেউ যদি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন এবং তার বয়স যদি ১৮-৬০ বছরের মধ্যে হয়, ওজন যদি ঠিক থাকে এবং তিনি যদি সুস্থ থাকেন, যদি কোনো সংক্রামক বা অসংক্রামক ব্যাধি না থাকে, যদি আয়রনের ঘাটতি না থাকে, তাহলেই তিনি প্রতি চার মাস পর পর রক্ত দিতে পারেন। 

আমাদের দেশে রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণ ও রোগীদের সেবা দিতে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে বহু সংগঠন। এর মধ্যে রাজধানীর শান্তিনগরের কোয়ান্টাম ল্যাবের কথা উল্লেখ করা যায়। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সেবাদানকারী এই ল্যাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মেনে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর সেই পরিমাণ রক্তই নেওয়া হয়, যা রক্তদাতার দেহ থেকে এমনিই বর্জ্য হিসেবে বেরিয়ে যায়। তাই রক্তদানের ফলে দাতার শারীরিক কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। বরং এমন ল্যাবে রক্ত উপাদান পৃথক করার মাধ্যমে এক ব্যাগ রক্ত থেকে চারজন মুমূর্ষুর জীবন বাঁচানো সম্ভব হতে পারে।

অনেক সময় মনে হতে পারে যে, আমি একা রক্ত দিলে কী হবে? আপনি যখন একা করবেন আপনাকে করতে দেখে আরেকজন অনুপ্রাণিত হবেন, তাকে দেখে আরেকজন। এভাবে সবাই মিলে রক্তের যে চাহিদা সেটি পূরণ করা সম্ভব। ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে যারা রক্ত দিয়েছি ভাষার জন্য, যারা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই দেশের মানুষ রক্তের অভাবে মারা যাবে, এটি হতে পারে না। এ জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে তরুণদেরই। 

১৪ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। দিবস উদযাপনের এই প্রাক্কালে যাদেরই শারীরিক সক্ষমতা আছে এবং রক্তদানের সময় হয়েছে তারা ল্যাবে গিয়ে রক্ত দান করুন। আজই ছোট্ট একটি সিদ্ধান্ত নিন, ‘আমি রক্ত দেব’। মনে রাখবেন, রক্ত কেনা যায় না, রক্তের বিকল্প শুধু রক্তই। 

লেখক: সংগঠক, স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

বাজেটে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা কতটুকু

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
বাজেটে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা কতটুকু
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

এবারের বাজেটে যেসব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য রয়েছে, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগের হার, মূল্যস্ফীতি হ্রাসের মাত্রা ইত্যাদি বিষয় বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে বলে মনে হয়। বর্তমানে দেশের বিনিয়োগ বাজার অনেকটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। সার্বিকভাবে ইনডেক্স অনেকটা নিচের দিকে নেমে এসেছে। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে অর্থনীতিতে একটি সংস্কার আবশ্যক হয়ে পড়েছিল আরও আগেই এবং তা জরুরি। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার। 

অর্থনীতির বড় এই খাতটিতে সুশাসনের যথেষ্ট অভাব আছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের কথা যদি বলা হয়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পথনির্দেশনা দেওয়া নেই। সম্প্রতি যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এই খাতকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও পিছিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া যেসব সংস্কার ইতোমধ্যে হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায়নি। বেসরকারি বিনিয়োগও বেশ শ্লথগতিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কাজেই অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর বিকল্প নেই। 

দেশে সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হারের অঙ্কটি আরও অধিকমাত্রায় বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেওয়া ঝুঁকি তৈরি করে। কাজেই নীতিনির্ধারকদের মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছে এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট ব্যর্থতা আছে। 

এই মুহূর্তে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বৈষম্য বেড়ে যাওয়া। মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এই সংখ্যা কত তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এ ছাড়া দেশে বৈষম্য এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ পরিস্থিতিকে এখনই মোকাবিলা করা না গেলে তাতে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রবাসী আয়, খেলাপি ঋণ, রপ্তানি আয়, লেনদেনে ভারসাম্যসহ অর্থনীতির সূচকগুলোও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই।

নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মান অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে পড়লে অস্থিরতা আরও বাড়বে। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে বা সিন্ডিকেট না ভেঙে সরাসরি আমদানি করতে চাইলে কৃষক বা উৎপাদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা বাজার ম্যানিপুলেশন করার জন্য সাধারণত কৃষক বা উৎপাদনকারী দায়ী নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়িক শ্রেণি। এরা সিন্ডিকেট করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে থাকে। মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমানো হবে, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। 

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই অনৈতিক। এতে করে লোকজনের মধ্যে উৎসাহের অনেকটাই ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর ফলে তাদের মধ্যে একধরনের ধারণা তৈরি  হয়েছে যে, সে যদি কর না দিয়ে কালোটাকা বানায় তাহলে ভবিষ্যতে এর প্রেক্ষিতে কম হারে কর দেওয়া যাবে। সুতরাং এতে করে  কালোটাকার মাত্রাটা আরও বেড়ে যেতে পারে। 

দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর আইনি প্রয়োগে যথেষ্ট অবহেলা আছে। আইনগুলো শক্তিশালী হওয়া দরকার ছিল, কিন্তু হয়নি। এসব বিষয় অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও বেশি দুর্বল করেছে। ফলে অর্থনীতি একটা বড় রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি না হয়ে আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। যেটি মানুষের জীবনযাত্রার মানকে অনেক বেশি নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। 

এমতাবস্থায় সচেতনতার সঙ্গে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি আরও বেশি সমস্যাসংকুল হবে। মূল্যস্ফীতির ফলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমগুলো ব্যাহত এবং একই সঙ্গে বিনিয়োগ ব্যাহত হলে যেসব সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান কঠিন হয়ে যাবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আমাদের পরিবেশ উন্নত এবং অনুকূল করতে হবে। তাই অর্থনীতির চলমান সমস্যাগুলো সমাধান করতে হলে জোরালো ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের মূল্য যাতে না বাড়ে, সে জন্য প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যেতে পারে। 

দেশের অর্থনীতি ঋণনির্ভর হলে চলবে না। এতে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক প্রবাহ কমে যাবে। আমাদের বিনিয়োগ বাজারের অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়। বিনিয়োগ বাজার যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দেওয়া ঠিক নয়। আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত ঋণনির্ভর না হয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে মনোযোগ বাড়ানো। 

আমাদের যে টার্গেট আছে সেটা কোনো অবস্থাতেই অর্জিত হয় না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। করের হার না বাড়িয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারা অনেকেই কর দেয় না। ইনকাম ট্যাক্স, অর্থাৎ যাদের টিন নম্বর আছে তারা অনেকেই রিটার্ন দেয় না। 

সর্বোপরি বাজেট কতটা জনবান্ধব হলো সেটিও দেখা দরকার। হঠাৎ পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হয়। এখন ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা হয়তো চাপে পড়বেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। দেরিতে হলেও আংশিকভাবে আমরা সেই পথে গেছি। তবে বিদ্যমান নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কাজেই সার্বিকভাবেই অস্থিতিশীল অর্থনীতির চাপ মোকাবিলায় একটি ভালো রকম সংস্কার প্রয়োজন আছে। ডলারসংকটসহ যেসব কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে, সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। 

পণ্যের মূল্য যাতে না বাড়ে, সে জন্য প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা দরকার। বাজেট যেন সাধারণ মানুষের জন্য একপেশে হয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। দেশে বিদ্যমান যেসব আইন আছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কঠোর আইন প্রয়োগের প্রতি বিশেষ জোর দিতে হবে। অর্থনীতির ভিত সুরক্ষায় এ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে।

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

‘বিকশিত ভারত’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ যৌথ সহযোগিতায় গড়ে তোলার অঙ্গীকার

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪১ এএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪১ এএম
‘বিকশিত ভারত’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ যৌথ সহযোগিতায় গড়ে তোলার অঙ্গীকার
সৈয়দ ফারুক হোসেন

দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২২ জুন দিল্লিতে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছিলেন। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফর। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড স্পর্শ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বপ্রথম ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। 

ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত বিকশিত এবং দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প-২০৪১’-এর মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় এখন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জনগণের হাতে। দুই দেশই জনগণের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা বলতে গেলেই অনিবার্যভাবে সর্বপ্রথম একাত্তরের কথা চলে আসে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। 

যুদ্ধের মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা একসঙ্গে মিশে পাকবাহিনীর বিপক্ষে লড়াই করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সম্পর্ককে বাংলাদেশ সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ভারতের অনেক বীর, যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে। 

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আগত সামরিক শাসক ও তাদের উত্তরসূরি রাজনৈতিক পক্ষের মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পথিমধ্যে সম্পর্ক ততটা এগোতে পারেনি। ২০০৯ সালের পর থেকে আবার দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের সুবাতাস শুরু হয়েছিল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় এসে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘একেবারে একান্ত ভারতের জাতীয় স্বার্থে সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রয়োজন।’ 

একদম সঠিক কথাই তিনি বলেছেন। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে টেকসই করার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের নৌ, স্থল ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা মানেই বাংলাদেশের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া। 

বাণিজ্য, সংযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকে দুই সরকারপ্রধান উভয় দেশের স্বার্থে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল ও সবুজ অংশীদারির জন্য যৌথ দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্মত হয়েছেন। এর আগে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একাধিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে ঢাকা ও নয়াদিল্লি। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও এই দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়েও জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কটা অনেক মজবুত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং যেসব বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, সে বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে এই সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় থাকতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল। 

পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তখন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার যে সহায়তা করেছিল তা বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক রক্ত দিয়ে লেখা। এ সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। এ সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের নয়, এ সম্পর্ক ভাইয়ের সম্পর্ক। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় গেছে তা অনুসরণ করার মতো। এ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। 

রক্তে লেখা সম্পর্ক অক্ষুণ্ন থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদি ‘মৈত্রী চুক্তির’ মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের যে গোড়াপত্তন করে গেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তা আরও সুসংহত ও বহুমুখী করেছেন। তারই হাত ধরে গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, ট্রানজিট সুবিধা প্রদান ও সমুদ্রসীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের সীমান্ত নীতির ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতির কারণে বাংলাদেশ এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। 

বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভ্রমণ, ব্যবসা এবং চিকিৎসার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গমন করে তার প্রধানতম প্রবেশদ্বার হচ্ছে বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবুজ অর্থনীতি, পারমাণবিক শক্তি, বিগ ডেটা, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সহযোগিতা স্থাপনে ভারতের রাষ্ট্রপতি জোর দিয়েছেন। 

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এমন বন্ধনে আবদ্ধ যে এর সঙ্গে অন্য কোনো দেশের সম্পর্কের তুলনা চলে না। আর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ-মায়ানমার উভয় পক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশেরই ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত এবং শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির প্রতি আবেগ প্রায় সমরূপ এবং ওই বিষয়গুলোতে মিল রয়েছে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়সহ উচ্চপর্যায়ের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। ভারত বাংলাদেশ দুই পক্ষের মধ্যে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বৈঠকের মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, জ্বালানি ও শক্তি এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। উভয় দেশই একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে আমাদের পথ দেখানোর জন্য ‘রূপকল্প ঘোষণা’ অনুমোদন করেছে। 

ভবিষ্যতের জন্য ‘ডিজিটাল অংশীদারি’ এবং ‘সবুজ অংশীদারি’বিষয়ক দুটি সমন্বিত রূপকল্প সামনে রেখে কাজ করতে সম্মতি প্রকাশ করেছে দুই দেশ। দুই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক জোরদারে নতুন ৭টিসহ মোট ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সহযোগিতা, রেলওয়ে, দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে সহযোগিতা, মৎস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক বিনিময় করা হয়। 

নতুন সাতটি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞান ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যৌথ গবেষণার জন্য বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) এবং ভারতের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (সিএসআইআর) মধ্যে সমঝোতা স্মারক। 

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল সংযোগ নিয়ে সমঝোতা স্মারক ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ ডিজিটাল পার্টনারশিপ এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সবুজ অংশীদারির বিষয়ে ‘শেয়ার্ড ভিশন’ স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ ভারতীয় রুপিতে লেনদেন শুরু করেছে। ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে যাচ্ছে। 

দুই দেশ পদ্মা চুক্তি নবায়নে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের তিস্তা নদীর সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনের জন্যও (ভারতের) একটি কারিগরি দল বাংলাদেশ সফর করবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উভয় দেশকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। তাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপরও নজর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা চালু করবে ভারত। 

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সুবিধার্থে রংপুরে নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান, আমাদের স্বাধীনতা এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী। 

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার  শেষ দ্বিপক্ষীয় সফর করেছিলেন এবং পরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আমন্ত্রিত ‘অতিথি দেশ’ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে নয়াদিল্লিতে ভারতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  এই একই ‘জুন’ মাসে অভূতপূর্ব দ্বিতীয়বারের মতো নয়াদিল্লি সফর করেছেন। 

এর আগে শেখ হাসিনা ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং নবগঠিত মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আরও কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে নয়াদিল্লি সফর করেন। এ সবই সুসম্পর্ক আমাদের এই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সঙ্গে কাজ করার প্রমাণ বহন করে।

লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

শেখ হাসিনার সফল ভারত সফর

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৫ এএম
আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৫ এএম
শেখ হাসিনার সফল ভারত সফর
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৮ ঘণ্টার সফরে দিল্লিতে এসেছিলেন। ভারতে হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে তার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। যেখানে প্রতিরক্ষা থেকে সীমান্ত সংযোগ, সন্ত্রাস মোকাবিলা থেকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যৌথ অংশীদারি ইত্যাদি সবই ছিল। ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ১০টি চুক্তি করে গেছেন। 

সেই চুক্তিতে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ ১৬ আনা নয়, ১৮ আনাই সফল হয়েছেন। ভারতে যারা এখনো বাংলাদেশ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার শেখ হাসিনার ভারত সফর প্রসঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মতে, এই চুক্তি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর শেখ হাসিনা ঢাকা ফিরে গিয়ে আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন করেছেন। সেখানেও যা খবর পাওয়া গেছে, তার দেশ এই চুক্তির মধ্যে যথেষ্ট আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।

এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মূল বিষয়গুলোর দিকে এবারে চোখ ফেরানো যাক: বাংলাদেশের অসুস্থদের জন্য ই-ভিসা, রাজশাহী-কলকাতা নতুন রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কলকাতা নতুন বাস সংযোগ, গেদে থেকে দলগাঁও মালবাহী রেল সংযোগ, রংপুরে নতুন সহকারী হাইকমিশন, ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ, সিরাজগঞ্জে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো তৈরি করা, গঙ্গা চুক্তি নবায়নে যৌথ কারিগরি দল, যৌথ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উদ্যোগ এবং তিস্তা সংরক্ষণ ও পরিচালন প্রকল্পের জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দলের বাংলাদেশ সফর।

এই নতুন সমঝোতাপত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিস্তা-সংক্রান্ত পদক্ষেপ। কারণ, ধাক্কা খেয়েছে চীন। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দলের মুখ্যমন্ত্রী মমতাও জোর ধাক্কা খেয়েছেন। এ খবর প্রকাশিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি করেছেন ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে কৈফিয়তও দাবি করেছেন। 

২৮ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবুর সঙ্গে কথা বলে ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছিল, যা শেষ হবে ২০২৬ সালে। ওই চুক্তি হয়েছিল জাতিপুঞ্জের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু এবং কংগ্রেস নেতা বরকত গনি খান চৌধুরী। এই ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর খুনি জিয়াউর রহমান ভারতের বিরুদ্ধে জাতিপুঞ্জে নালিশ জানিয়েছিলেন। 

সেই নালিশের জবাব দিতে ইন্দিরা গান্ধী জাতিপুঞ্জে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ ও সেচমন্ত্রী মালদার বরকত গনি খান চৌধুরীকে। বরকত সাহেব নিউইয়র্কে জাতিপুঞ্জে অন্তত ৫০টা দেশের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশকে মাত্র চার বছর হলো আমরাই স্বাধীন করে দিয়েছি, হঠাৎ পানির জন্য এখানে কেন? তিনি আরও বলেন, ‘রক্ত দিয়েছি, পানিও দেব, কিন্তু এখানে নয়। বাংলাদেশকে আসতে হবে ঢাকা, দিল্লি, কলকাতা এবং মালদায়।’ জাতিপুঞ্জের প্রেস গ্যালারিতে তখন আমিও বসেছিলাম। 

হঠাৎ ৩০ বছর পর মমতা কেন তিস্তা নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন? তিনি ভুলে গেছেন যে, তিনি একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী নন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরের আগে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে তিন-তিনবার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন মমতার সঙ্গে কথা বলতে। শেষবার মেনন তারই ব্যাচমেট মুখ্যসচিব প্রসাদ রায়কে মমতার সামনে বলে এলেন যে, আপনি দয়া করে আপনার মুখ্যমন্ত্রীকে ইংরেজি শেখান, উনি জানেন না, তাই আমার কোনো কথাই উনি বুঝতে পারছেন না। 

এবারে দেখা যাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সাফল্য। শেখ হাসিনার সফর নিয়ে আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি মনমোহন সিংয়ের আমলে সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেননের সঙ্গেও। তিনিও বলেছেন, এই চুক্তি হাসিনার অভিজ্ঞতা ও পরিণতমনস্কতা প্রমাণ করে। 

আশা করি, বাংলাদেশের মানুষও এতে খুশি হবেন। শোনা গিয়েছিল শুষ্ক  মৌসুমে জল ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ তিস্তার ওপর একটি বাঁধ তৈরি করবে, যার খরচ হবে ১ বিলিয়ন ডলার। এই টাকাটা অল্প সুদে ভারত বাংলাদেশকে দেবে। চীন এই সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। ভারত সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগের পর অভিযোগ ছিল যে, চীন আওয়ামী লীগের কিছু নেতার মাধ্যমে তদবির শুরু করেছিল।

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল- ভারতীয় ভিসা অফিস খোলা, এই চুক্তিতে তাও অনুমোদিত হয়েছে। দুই দেশের পর্যটনব্যবসা বৃদ্ধিতে এই চুক্তি অনেকটাই কার্যকরী হবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল, তবে তা নির্ভর করছে দুই দেশের ভিসা-সংক্রান্ত নিয়মের শিথিলতার ওপর।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মতে, গত এক বছরের মধ্যে এবারের বৈঠকটি ছিল একেবারেই আলাদা, কারণ তৃতীয়বার তারা সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই আমাদের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। হাসিনা মনে করেন, দুই দেশের সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই ঢাকা এবং দিল্লি নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছে।

ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির ১০টি বিষয়ই দুই দেশের অনেক সমস্যার সমাধান করবে, এ বিষয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কোনো দ্বিমত নেই। তারা সবাই খুশি।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৩ এএম
আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৩ এএম
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ
হীরেন পণ্ডিত

তৈরি পোশাক খাত বা আরএমজি খাত বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য একটি সফল মডেল। কিন্তু এখন সময় এসেছে চামড়া, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি এবং হালকা প্রকৌশলের মতো অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ফোকাস করার। জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর কীভাবে তার রপ্তানির পরিধি বৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা শুরু করেছে। 

এগুলোর মধ্যে রয়েছে কম খরচে এবং সহজে প্রবেশাধিকার, পর্যাপ্ত নীতি-সহায়তার পাশাপাশি পোশাকবহির্ভূত রপ্তানি খাতের জন্য আর্থিক এবং আর্থিক ছাড়া অন্য প্রণোদনা এবং সমান দক্ষতার বিকাশ নিশ্চিত করা। আমাদের উচিত ভালো রপ্তানির সম্ভাবনাসহ পোশাকবহির্ভূত খাতগুলোর প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া। দেশের রপ্তানিকে বৈচিত্র্যময় করা, যাতে ২০২৬ সালে এলডিসিতে উত্তরণের পর বিদ্যমান এবং নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে। 

বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ের জন্য একটি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এখন রপ্তানির ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাকের অংশ অন্যান্য শিল্প ও উৎপাদন উপাদানের সুস্থ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কবে নেমে আসবে তা কেউ জানে না। চামড়া ও জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিকস, আইটি ও সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, সংযোজন শিল্প, হস্তশিল্প, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিভিত্তিক আইটেম এবং আরও কয়েকটি খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে পারে। 

আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি আরও সহজতর করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ পাট খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই উনয়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাড়ানোর বিবেচনায় এই শিল্পটি ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর উচিত দেশীয় প্রবিধানগুলো প্রয়োগ করা, যা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা অনুমোদিত শিল্পের প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটকে (বিএসটিআই) শক্তিশালী করা, যাতে স্থানীয় পণ্যগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করা যায়। 

দেশের আইনি সক্ষমতাও বাড়াতে হবে, কারণ বাণিজ্যিক বিরোধ এলডিসি উত্তরণ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পাট, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, আইসিটি এবং অন্যান্য উদীয়মান খাতের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সব ধরনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।

বাংলাদেশকে বিনিয়োগের পরিবেশ অর্জন করতে হবে। ব্যবসায়ীদের উচিত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং তাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য গবেষণায় মনোনিবেশ করা। প্রতিটি ব্যবসায় শিল্পের মালিক ও উদ্যোক্তারা পণ্যের চাহিদা ও গুণগত মান নির্ধারণ করে এবং রপ্তানির জন্য পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে তাদের দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার উদ্যোগ নেন। 

বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২৩টি দেশের ওপর একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। অন্য কথায় একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, আমরা আমাদের সামনে আসতে পারে- এমন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি।

অন্যান্য নন-গার্মেন্ট সেক্টরের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। পোশাকের নকশা, রং সবকিছুই পরিবর্তন করতে হয়। বিশ্ব পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে বিশ্ববাজারের মাত্র ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার। তাই বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়াতে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। 

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পোশাকশিল্পের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধিতে এবং বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত সর্বাগ্রে। তাই রপ্তানি বহুমুখীকরণে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্বব্যাপী দুটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত সূচক হলো ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, এনাবলিং ট্রেড ইনডেক্স এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ট্রেড লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই)। সব সেক্টরে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে, কিন্তু দক্ষতার ঘাটতি, প্রযুক্তি আপগ্রেড করার প্রয়োজন, দুর্বল অবকাঠামো বা আন্তর্জাতিক মান ও সম্মতি পূরণে অসুবিধার মতো বাধার সম্মুখীন হয়। 

এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ খারাপ করে কিন্তু পরিবহন ও বিদ্যুতের স্কোর বিশেষত কম যা উৎপাদন খাতে গুরুতর বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে কম বেতনের অদক্ষ শ্রমের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে। কোনো দেশের রপ্তানির জন্য কোনো একটি উৎসের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া কখনোই ভালো নয়। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও টেকসই বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি পণ্যকে বহুমুখী করতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে একদিকে এক পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে মোট রপ্তানি আয় বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান। উপকৃত হবে নারীরাও। বাংলাদেশ থেকে ১৬০০ ধরনের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে রপ্তানি হয় জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তৈরি পোশাকের ২৯২ ধরনের পণ্য থেকেই মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ ভাগ আসে। বাকি ১৩ শতাধিক পণ্য থেকে আসে মাত্র ১৫ শতাংশ আয়। 

কিন্তু এই ১ হাজার ৩০০ পণ্যের মধ্যে প্রচুর পণ্য রয়েছে, যেগুলোর বাজার অনেক বড় এবং প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য ও ওষুধের বাজার বড় হচ্ছে। এসব খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক দেশের তুলনায় বেশি। ফলে সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা পেলে এসব খাত থেকে রপ্তানি আয় বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

একটি পণ্যের ওপর নির্ভর করে এগোনো যাবে না। রপ্তানির অন্যান্য খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভিয়েতনামের নিজস্ব চামড়া নেই। আবার জনসংখ্যাও কম। কিন্তু ভিয়েতনাম বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু বাংলাদেশের নিজস্ব চামড়া ও পর্যাপ্ত জনবল থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি হচ্ছে ১ বিলিয়ন ডলার। প্লাস্টিকের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। 

এ শিল্পের সম্ভাবনা অনেক। তবে সরকারের নীতি-সহায়তা বাড়াতে হবে। কোভিডের অভিঘাত কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি এখন চাঙা হচ্ছে। গতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। দেশের রপ্তানি খাতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে পণ্য রপ্তানি হয়েছে সরকারের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। রপ্তানির ঊর্ধ্বগতিতে বরাবরের মতো এবারও বড় ভূমিকা রেখে চলেছে তৈরি পোশাক খাত। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ আরও কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রেও রপ্তানির গতি ইতিবাচক। 

বাংলাদেশের কয়েকটি ব্র্যান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে; যা এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে। 

নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্পপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

উৎপাদন প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১১:২৮ এএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ১১:২৮ এএম
উৎপাদন প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ প্রসঙ্গে
ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ

অর্থনীতির শাস্ত্র অনুযায়ী চারটি বিষয়ের ওপর উৎপাদন নির্ভরশীল। পুঁজি, জমি, শ্রম ও ব্যবসায়ী উদ্যোগ। পুঁজি অপেক্ষাকৃত অতি প্রয়োজনীয়। পুঁজি ব্যবহারের প্রক্রিয়ার মধ্যে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাকে আমরা সাধারণত ইনভেস্টমেন্ট বলি। বিনিয়োগটা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে করা হয়ে থাকে। ভৌত অবকাঠামোয় বিনিয়োগ হয়, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ হয়, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ হয়। এই বিনিয়োগটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আমরা জানি, বিনিয়োগটা প্রবৃদ্ধি (গ্রোথ), কর্মসংস্থান এবং বিভিন্ন কিছুর সঙ্গে জড়িত। 

ইদানীং বিনিয়োগের বিষয়টা আরও সামনে চলে আসছে। আমরা এখন দেখছি, আমাদের অর্থের সংকুলান হচ্ছে না। ব্যাংকে তারল্যসংকট। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। এফডিআই আসছে না। পোর্টফোলিও বিনিয়োগ খুবই কম। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বড় একটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। ধারাবাহিকভাবে আমরা দেখে এসেছি, মোট দেশজ উৎপাদনের বিনিয়োগ এখন আমাদের ২৮-২৯ শতাংশ মাত্র। 

এটাকে যদি আমরা ন্যূনতম ৩০ থেকে ৩২ শতাংশে নিয়ে যেতে না পারি, তাহলে আশানুরূপ গ্রোথ আমরা পাব না। যেমন- অর্থনীতির একটা সংজ্ঞা আছে, ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও, অর্থাৎ এক ইউনিট কোনো পণ্য উৎপাদন করতে সাধারণত কতটুকু ক্যাপিটাল লাগে। ‘ফোর ইসটু ওয়ান রেশিও’ অর্থাৎ চার টাকা বিনিয়োগ করলে এক টাকা পরিমাণ জিনিস পাওয়া যাবে।

একটি দেশে বিনিয়োগ সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটি হলো অভ্যন্তরীণ, আরেকটি হলো বৈদেশিক। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে আছে আমাদের সঞ্চয়পত্র, সেভিংস সার্টিফিকেট, প্রাইজ বন্ডের মাধ্যমে, অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাংকে টাকা-পয়সা রাখে যারা, যেসব ডিপোজিট ব্যাংক ক্রিয়েট করে, সেটা হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের একটি উৎস। আমাদের বিদেশ থেকে কিছু বিনিয়োগ আসে, সেটা হলো ডলার বন্ড কেনে। ইনভেস্টমেন্ট বন্ড কেনে আমাদের যারা বিদেশে আছে, তারা। 

এটা হলো আমাদের, যেটাকে আমরা বলতে পারি, ডমিস্টিক সোর্স তথা বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে বিনিয়োগের পরিমাণ। আরেকটি হলো বৈদেশিক বিনিয়োগ। আমরা যাকে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফবিআই) বলি। বহু বিদেশি কোম্পানি দেশে বিনিয়োগ করে থাকে। এই বিনিয়োগটা হয় তাদের বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (ব্যাংকসহ) মাধ্যমে। আরেকটা হলো ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট; সেটা হলো শেয়ার মার্কেটে। যেমন- আমাদের নাগরিক বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনে। সেখানে বাইরের লোকও কিছু শেয়ার কেনে। বৈদেশিক বিনিয়োগের দিক সেদিক দিয়ে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। 

বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যবসার পরিস্থিতি। ২০২০ সালে গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স বলে একটা রিপোর্টে আছে, যেখানে ১৩০ দেশে কী কী সুবিধা আছে, তা বলা আছে। সেখানে দেখা গেছে, সবচেয়ে শীর্ষে সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ইউএস এবং ইউকে আছে। আমাদের আশপাশের মধ্যে ইন্ডিয়া একটা বিরাট বিনিয়োগের কেন্দ্র। ইন্ডিয়ার ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট বেশ বেশি। 

এমনকি ইন্ডিয়া এখন শেয়ার মার্কেটে ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে; মুম্বাইয়ের শেয়ার মার্কেটের ক্যাপিটাল। তারপর সাউথ আফ্রিকা আছে, সিঙ্গাপুর আছে, ভিয়েতনাম আছে। এদিকে চীন তো আছেই। এই ক্যাটাগরিতে ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১২৪। এটি নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন সেটা প্রকাশ করছে। এডিবির রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমাদের বড় কোম্পানিগুলোর ২৫ শতাংশের বেশি প্রশিক্ষণের ব্যাপারে মোটেও উৎসাহী নয়। এই যে বড় বড় কোম্পানি আছে দেশে, যারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে সামান্যও ভাবে না।

আমাদের দুর্বলতা কোথায়? আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে। রাজনৈতিক বেশ কিছু ইস্যু আছে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার দুর্বলতা আছে। বিজনেস এনভায়রনমেন্ট, যাকে বলে ডুয়িং বিজনেস, ব্যবসা করার যে সুবিধা, সেটা আমাদের সন্তোষজনক নয়। আরেকটা দুর্বলতা আমাদের হিউম্যান ক্যাপিটাল কম। স্কিল ট্রেনিং বাংলাদেশে অনেক কম। হিউম্যান ক্যাপিটালে ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৯। কিন্তু ওদিকে আবার ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা ভৌত অবকাঠামো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো- ৯২। কিন্তু হিউম্যান ক্যাপিটাল ও ইনোভেশনে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।

দক্ষতা এবং চাকরির ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে এডিবি ২০২০ সালে একটি রিপোর্ট বের করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের এডুকেশন লেভেল লো, কোয়ালিটি ভালো নয়, স্কিল লেভেল লো, শ্রমিকদের দক্ষতা অনেক কম। জাপানের এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন বলেছে, বাংলাদেশের লেবার প্রোডাক্টিভিটি কম। আমরা যে গার্মেন্টসে দেখি বা বিভিন্ন জায়গায় দেখি, অন্য দেশে মজুরি বেশি দেয়। কারণ প্রোডাক্টিভিটি উঁচু। যারা মজুরি বেশি পায়, তাদের দক্ষতা বেশি। আমাদের এখানে দ্বিমুখী সমস্যা। একটি হলো, আমাদের শ্রমিকদের বেতন কম এবং তাদের থাকা-খাওয়ার আবহ ভালো নয়। সুতরাং তারা এর চেয়ে বেশি কী দক্ষ হবে? দক্ষতা বাড়ালে মজুরি বাড়াতে হবে। মজুরি বাড়াতে হলে খরচ বেড়ে যাবে। প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে হলে টাকাপয়সা খরচ করতে হবে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগের ব্যাপারে প্রচুর কথা বলেছেন। এটা সঠিক, বিনিয়োগটা না বাড়ালে তথা বৈদেশিক বিনিয়োগ না এলে রিজার্ভও বাড়বে না।

এখন আমাদের কী করতে হবে? সামনের দিকে যেতে হলে কী করার আগে কী প্রয়োজন? যেটাকে আমরা বলি ইনভেস্টমেন্ট এনভায়রনমেন্ট বিনিয়োগের আবহ তৈরি করতে হবে। এর জন্য পাঁচটি জিনিসের ওপর জোর দিতে হবে। এক. আইন। আমাদের কোম্পানি আইন বলুন, কম্পিটিশন ল বলুন, মজুতদারি আইন বলুন বেশির ভাগই মোটামুটি কাগজে-কলমে ভালো। কিন্তু এগুলোর প্রয়োগ দুর্বল। এ জন্য বাইরে থেকে যে কোম্পানি আসে, তারা ভয় পায়। আইনের আওতায় কোর্টে যাবে, এডিআর করবে- কোর্টে তো দীর্ঘসূত্রতা। 

কত কোম্পানির মামলা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কোর্টে ঝুলে আছে। ব্যবসায়ীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আরেকটা জিনিস হলো ল্যান্ড রেজিস্ট্রেশন আইন। বাইরে থেকে যারা আসে, তারা যখন ল্যান্ড রেজিস্ট্রেশন করতে যায় বা কোনো কিছু রেজিস্ট্রেশন করতে যায়, কত রকম ঝুঁকি তাদের পোহাতে হয়। কত রকম দুর্নীতি, কত রকম কাগজপত্র, কত জায়গায় যেতে হয়। এটা তো অকল্পনীয় ব্যাপার। সম্প্রতি সরকার কতগুলো স্পেশাল ইকোনমিক জোন করেছে। কিন্তু অনেক স্পেশাল ইকোনমিক জোন মুখ থুবড়ে আছে। সেগুলো খুব বেশি ভালো করতে পারছে না। কয়েকটা ভালো করেছে। আইন বিষয়টা সবচেয়ে জরুরি। এমনকি কোম্পানি আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইনে সার্বিকভাবে অনেক দুর্বলতা আছে।

দুই. নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক আছে, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন আছে, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আছে, এগুলোকে আমরা বলি রেগুলেটরি বডি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। এদের দক্ষতা ও কর্মসম্পাদনের উন্নতি করতে হবে। ব্যাংকিং অবস্থা কী, পুঁজিবাজারের অবস্থা কী? কোনো এনার্জি পলিসি নেই। এক দিন এটার দাম বাড়ায়, অন্য দিন আরেকটার দাম বাড়ায়। কমে না। পেট্রলের দাম বাড়ায়, গ্যাসের দাম বাড়ায়। এদিকে আবার যা ভালো আইনকানুন আছে, সেগুলোরও প্রয়োগ নেই।

তিন. প্রমোটিং বডি তথা ব্যবসা সহায়তাকারী সংস্থা। এখানে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো আছে, বাংলাদেশ রপ্তানি অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) আছে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখানে আছে, যারা প্রমোটিং বডি। তাদের অবস্থা কেমন? প্রথম সরকারি যেসব সহায়তাকারী সংস্থা আছে, তাদের পারফরম্যান্স কেমন? খুব ভালো নয়। 

আর যদি ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিশন ধরা হয়, সেখানকার অবস্থাও খারাপ। ব্যবসায়ীরা কোথায় যাবেন? তাদের তো সাপোর্ট লাগবে। বিদেশিরা কার কাছে যাবে? কীভাবে সহায়তা পাবে? আসলে যথাযথ স্থানে দক্ষ লোকের অভাব। ইনোভেশনের অভাব। এডুকেশন কম বা দুর্বল। কাজেই বাইরে থেকে লোকজন টাকাপয়সা দিয়ে তো বিপদে পড়বে।

চার. গুড গভর্ন্যান্স। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নেই। যেখানে যাওয়া হয়, সেখানেই টাকাপয়সার লেনদেন ছাড়া কিছুই হয় না। যাদের টাকাপয়সা আছে, যারা ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে পারে, যাদের আমলাতান্ত্রিক যোগাযোগ আছে; তারা ব্যবসা পাবে, বাকিরা পাবে না। যত ইনোভেশনই হোক। এখানে একটি উদাহরণ দিই, অনেক উদ্যোক্তা আছে, যাদের ইকুইটি ফিন্যান্স দরকার, অনেক তরুণ ছোট ছোট আইটি ইন্ডাস্ট্রি করে, সেখানে তাদের ইকুইটি ফিন্যান্স দরকার। 

তাদের ১০ লাখ টাকা লাগলে কেউ তিন লাখ টাকা দিয়ে তাদের সঙ্গে অংশীদার হতে পারে। ইকুইটি ফিন্যান্সিং, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা স্টার্ট আপ ফান্ড এগুলোর তো অবস্থা খারাপ বাংলাদেশে। সৃজনশীল উদ্যোক্তা যারা, তাদের তো তেমন সুযোগ নেই। তাদের জন্য যে আবহ দরকার, যে সহযোগিতা দরকার, সেগুলো বাংলাদেশে নেই। তরুণরা এগিয়ে আসবে, নবীন উদ্যোক্তারা ব্যবসা করবে- সবার তো চাকরি করার প্রয়োজন নেই, সবাইকে তো চাকরি দেওয়া সম্ভবও নয়। এদিকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

পাঁচ. করাপশন তথা দুর্নীতি। দুর্নীতি যদি দূর করা না যায়, তবে কোনো কিছুই করা যাবে না এখানে। অ্যাফিশিয়েন্সি বাড়ানো যাবে না। প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো যাবে না। লভ্যাংশ বাড়ানো যাবে না। সব খেয়ে ফেলবে দুর্নীতি। সৃজনশীল বা উদ্যোগী লোকজন নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে ব্যবসায় আসবে, এটা সম্ভব হবে না। দুর্নীতির সবচেয়ে বড় খারাপ বিষয় হলো মানি লন্ডারিং। দুর্নীতির টাকা বেশির ভাগ পাচার হয়ে যায়। কষ্টের টাকা তো কেউ পাচার করবে না। 

এটা মানুষ সঠিকভাবে ভোগ করতে চায়। বৈধভাবে ব্যবহার করতে চায়। বাইরে নিলে বৈধভাবে নিতে চায়। দুর্নীতির টাকা তো পাচার হয়ে যায়। মানি লন্ডারিং, করাপশন রুখতে না পারলে দেশের দ্রুত উন্নয়ন হবে না। বিনিয়োগ বাড়বে না। অতএব, সামনে যেতে হলে এই জিনিসগুলো আমাদের বিবেচনা করতেই হবে। সব শেষে কয়েকটা জিনিস দরকার। প্রথমত, আমাদের বাজেটে, পলিসিতে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইনভেস্টমেন্টটা আমরা প্রায়োরিটি দেব। প্রোডাক্টিভিটি বাড়াব, যাতে লোকজনের কর্মসংস্থান হয়। অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রজেক্ট, লোক- দেখানো প্রজেক্টে ইনভেস্ট করা যাবে না। মোদ্দাকথা, বিনিয়োগের মাধ্যমে অপচয় বা অপচয়ের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না।

দ্বিতীয়ত, আমাদের যেসব ট্যাক্স আইন আছে, প্রণোদনা আছে, বিভিন্ন রকম ব্যাংক থেকে লোন, ফান্ড- এগুলো খুব সাবধানতার সঙ্গে দিতে হবে। কোন বিনিয়োগটা আমাদের জন্য ভালো, কোন বিনিয়োগটা আমাদের জন্য প্রফিটেবল, কোন বিনিয়োগটা সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের ব্যবসায়িক উন্নতি হবে, জনগণের উন্নতি হবে- সেটা দেখতে হবে।

সর্বোপরি, আমাদের নলেজ বেজড ইকোনমি, স্কিল বেজড ইকোনমি তথা বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও দক্ষতাভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য-প্রোডাকশন এগুলোর দিকে যেতে হবে। এগুলো যদি না করি, আধুনিক স্কিল, প্রযুক্তি ও দক্ষতাভিত্তিক ব্যবসা যদি আমরা না করি, তাহলে এগিয়ে যেতে পারব না। যেসব দেশ এগিয়ে গেছে, তারা এসব জিনিসের ওপর নজর বেশি দিয়েছে। বিনিয়োগের সহায়ক হচ্ছে প্রযুক্তি, গবেষণা ও দক্ষতা পরে সবর্ণিত উদ্যোগ যেমন, আর্থিক কার্যক্রম, আইনি পদক্ষেপ, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি অত্যাবশ্যক। 

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়