বাংলাদেশে নগরায়ণের গতি ও ধরন দীর্ঘদিন ধরে দেশের ভূগোলবিদ এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের আলোচনার বিষয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরাও তাদের চিন্তাশীল বিশ্লেষণ এবং মতামত প্রদানের জন্য তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের নগরায়ণের ওপর সুচিন্তিত লেখার একজন অনুসরণকারী হিসেবে আমি সব সময় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক নাফিস আহমদের আকর প্রবন্ধটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করি। The Urban Pattern in East Pakistan শিরোনামের প্রবন্ধটি ১৯৫৭ সালে The Oriental Geographer-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নগরকেন্দ্রগুলোর স্থানিক বিন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়েছিল।
তারপর থেকে আমি এবং অধ্যাপক কে. মওদুদ এলাহী, অধ্যাপক সৈয়দ আবু হাসনাত এবং খুব সম্প্রতি অধ্যাপক নাসরীন রফিকের মতো ভূগোলবিদরা বাংলাদেশের নগরায়ণ-প্রক্রিয়া এবং নগরবিন্যাসের গঠনমূলক বিশ্লেষণ করেছি। আমরা সবাই নগরায়ণ এবং দ্রুত নগর বৃদ্ধির প্রসঙ্গ তুলে ধরেছি। আমরা বৃহৎ অঞ্চল (অর্থাৎ প্রশাসনিক বিভাগ ও জেলা) বা ক্ষুদ্র অঞ্চল (উপজেলাগুলোর মতো) উভয়েরই নগরায়ণ মাত্রার ধরনটি তুলে ধরেছি। নগরায়ণের আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টিও আমাদের লেখালেখিতে গুরুত্ব পেয়েছে। তা ছাড়া ঢাকাকে কেন্দ্র করে একটি নিয়ন্তা নগর বা প্রাইমেট সিটি বৃদ্ধির প্রশ্নটি ভূগোলবিদ এবং পরিকল্পনাবিদদের মতো এখন অর্থনীতিবিদরাও পর্যালোচনা করছেন। আমাদের নগরায়ণ বিশ্লেষণে বিকেন্দ্রীকরণের মতো বিষয়ও গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশে নগরায়ণ ধারা (অর্থাৎ গ্রামীণ থেকে শহুরে জনসংখ্যায় পরিবর্তনের প্রক্রিয়া) স্বাধীনতার পরবর্তী ৫ দশকে অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে নগরায়ণ মাত্রা ছিল মাত্র ৭%; এখন ৩৩%-এর বেশি। বৃদ্ধিহার প্রায় ৪%। নগরে জনসংখ্যার আকার বিশাল- ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটিরও বেশি।
জাতীয় নীতিমালা, যেমন- পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩ সাল থেকে) বা জাতীয় হ্যাবিট্যট (মানববসতি) প্রতিবেদনসমূহেও (১৯৭৬ সালে শুরু) দ্রুত নগরায়ণ এবং ঢাকার উচ্চ প্রাধান্যের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। সরকারের খসড়া জাতীয় নগরনীতি (২০১১ ও ২০২৪), প্রাইমেট সিটি সমস্যা এবং সেই সঙ্গে নগরায়ণে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত ঢাকা বিভাগে/জেলায়, প্রান্তিক বিভাগ এবং জেলার তুলনায় উচ্চহারে নগরায়ণ হয়েছে। অবশ্য এদিকে নিয়ন্তা/মেগাসিটি ঢাকার পাশে অবস্থিত মানিকগঞ্জের মতো একটি জেলায় নগরায়ণের নিম্নহারের উপস্থিতির বিষয়টি আশ্চর্যজনক।
অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রথম, যিনি বাংলাদেশে নগরায়ণের বৈষম্য এবং উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় অপ্রধান শহরগুলোর ভূমিকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন। সম্প্রতি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) অর্থনীতিবিদ ড. আহমদ আহসান বাংলাদেশের নগরায়ণ ধারা এবং মেগাসিটি ঢাকার ‘অতিবৃদ্ধি’/ ‘ওভারগ্রোথ’ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নগরায়ণের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেন এবং রাজধানী শহরের অতিবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেন। আরেকজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ এবং পরিবেশবিদ ড. এস নজরুল ইসলাম (বাপা-বেন-এর) ড. আহমদ আহসানের কাজ অনুসরণ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন যে ঢাকার ‘অতিবৃদ্ধি’ বিপরীত উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং দেশে আরও বৈষম্য তৈরি করতে পারে। এ বিষয়ে প্রতিকার হিসেবে তারা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। উল্লেখ্য, অতিবৃদ্ধি বা ‘ওভারগ্রোথ’ বলতে তারা মূলত ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন।
তবে দুই অর্থনীতিবিদ কীভাবে ‘ঢাকা’কে সংজ্ঞায়িত করেছেন তা স্পষ্ট নয়। এটি কি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সমন্বিতভাবে যে কেন্দ্রীয় মহানগর বা মেট্রোপলিটন শহর ঢাকা, যার আয়তন মাত্র ৩০৪ বর্গকিলোমিটার ও বর্তমান আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১২ মিলিয়ন, নাকি এটি ঢাকা মেগাসিটি অর্থাৎ রাজউকের রাজধানী মহানগর বা মেট্রোপলিটন অঞ্চল, যার আয়তন প্রায় ১৫৩০ বর্গকিলোমিটার এবং আনুমানিক জনসংখ্যা ২০ মিলিয়নেরও বেশি। এই মেগাসিটি অঞ্চলটিতে রয়েছে চারটি সিটি করপোরেশন (ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর) এবং সাভারের মতো বেশ কয়েকটি পৌরসভা এবং অসংখ্য ইউনিয়ন পরিষদ ও গ্রামীণ এলাকা। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন বা সাভার পৌরসভার অধিবাসীরা নিজেদের ঢাকাবাসী বা ঢাকার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে চাইবেন না, যদিও তারা ঢাকা মহানগর অঞ্চল তথা ঢাকা মেগাসিটির অধিবাসী।
জাতীয় নগর ক্রমে/হাইআরকিতে দেশের বৃহত্তম শহর ঢাকার প্রাধান্য স্পষ্ট। ১৯৬১ সালেই ঢাকায় ছিল দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ২০%। ১৯৭৪ সালে দেশের ৬২.৭ লাখ নগর লোকসংখ্যার মধ্যে ১৭.৭ লাখ, যা দেশের মোট নগর লোকসংখ্যার ২৮.৩% বসবাস ছিল ঢাকা নগরে। এ সংখ্যা ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম অপেক্ষা ১.৯৯ গুণ বেশি। ১৯৮১ সালে ঢাকার প্রাধান্য তুলনামূলকভাবে কিছুটা কমে যায়। এ সময় ঢাকায় ছিল দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ২৫.৭%। ঢাকার প্রাধান্য পরবর্তী দশকে আবার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালে দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ৩০.৫% ছিল এই নগরে। ২০০১ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪% এবং ২০১১ সালে ৩৩% মোটামুটি একই উচ্চ প্রাধান্য ছিল। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরের তুলনায় ঢাকার প্রাধান্য ছিল স্পষ্ট। যথাক্রমে ৩.১৬ গুণ ও ৩.৮০ গুণ (BBS, ২০১১)। ২০২২ সালে (২০২১-এর শুমারি ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হয়) বাংলাদেশে নগর জনসংখ্যা ছিল ৫২ মিলিয়ন। এর মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকায় নগর জনসংখ্যা ছিল ১০.২ মিলিয়ন, যা দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ১৯.৬২%। অবশ্য বৃহত্তর ঢাকার আনুমানিক প্রায় ২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা হিসেবে মেগাসিটি ঢাকার নগর জনসংখ্যা দাঁড়ায় দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ৩৮.৪৬%, অর্থাৎ অতিমাত্রায় প্রাইমেট পরিস্থিতি।
পরিকল্পনাবিদ, ভূগোলবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা সবাই মেগাসিটির দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেন। এ ধরনের অবস্থান যুক্তিযুক্ত এবং প্রশংসনীয়। তবে এর সঙ্গে নগর ব্যবস্থাপনা বা সুশাসনের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। উন্নত দেশ জাপানের রাজধানী বিপুলাকার মেগাসিটি টোকিও বসবাসযোগ্য। কারণ সে শহরে ব্যবস্থাপনা সুচারু। মধ্যম আয়ের দেশ থাইল্যান্ডের অতিমাত্রার প্রাইমেট মেগাসিটি ব্যাংককও বসবাসযোগ্য। কেননা সেখানে নগর পরিচালন বা ব্যবস্থাপনা উত্তম।
বাংলাদেশে আজ নিয়ন্তা নগর/প্রাইমেট সিটি এবং অন্যান্য মাঝারি কিংবা ছোট শহর উভয়ই বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ময়মনসিংহের মতো একটি মাঝারি শহরও মেগাসিটি ঢাকার মতো বসবাসের অযোগ্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে। মূল সমস্যা অবশ্যই শহরগুলোর ব্যবস্থাপনার গুণমান। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বা পরিচালন পরিকল্পিত নগর/শহর উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান হওয়া প্রয়োজন। যা-ই হোক, এই ধারণাটি অবশ্য নগরায়ণ-প্রক্রিয়া এবং উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ের গুরুত্বকে কোনোভাবেই কমিয়ে দেয় না।
জাতীয় নগর নীতিমালার (২০১১ ও পরিমার্জিত ২০২৪) খসড়াতে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়েছে। নীতিমালার অন্য ধারাগুলোও যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করে রচিত হয়েছে। আমরা সরকারকে অবিলম্বে নীতিটির অনুমোদন এবং বিশেষ করে বিকেন্দ্রীকরণ এবং শক্তিশালী নগর পরিচালনের ওপর জোর দিয়ে বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানাই।
বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে দুটি প্রসঙ্গ আলোচিত হয়ে থাকে। প্রথমে বৃহৎ ও মাঝারি অঞ্চলভিত্তিক (অর্থাৎ বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে) বিকেন্দ্রীকরণ। দ্বিতীয়ত, নগর/শহরভিত্তিক (আরবান সেন্টার) বিকেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ইত্যাদি বিভাগীয় শহরে বিকেন্দ্রীকরণ।
বিকেন্দ্রীকরণ চিন্তায় ড. আহমদ আহসান বেশ চরম ধারণা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সব জেলাকে (৬৪) প্রদেশে উন্নীত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণের বাকশাল সময়ের জেলা গভর্নর নিয়োগের কথা স্মরণীয়। ড. এস নজরুল ইসলাম অবশ্য প্রদেশ চিন্তা করেননি। তিনি রাজধানীর সঙ্গে জেলা ও উপজেলায় উন্নত রেল যোগাযোগের সুপারিশ করেন। প্রস্তাবিত ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের যথাযথ উন্নয়নের কথা বলেন। তা ছাড়া মৌলিকভাবে জেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেন। এ ক্ষেত্রে আমি তার সমমনা।
নগরায়ণ বিকেন্দ্রীকরণের অপর একটি ধারণা হলো In situ urbanization বা অকুস্থল নগরায়ণ তথা বিচ্ছুরিত নগরায়ণ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারণা- ‘গ্রাম হবে শহর’ বা ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এক অর্থে ইন-সিটু আর্বানাইজেশনের সমরূপী ধারণা। অবশ্য মাঝারি বা বড় শহরে প্রবৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রেই থাকবে প্রকৃত বাস্তবতা। দেশের নগরায়ণ ধারায় বিভিন্ন কারণে কোনো কোনো নগর বা শহরে জনসংখ্য বৃদ্ধির স্থবিরতা, এমনকি সংখ্যা হ্রাসের মতো বাস্তবতাও ঘটে, যেমন ঘটেছে খুলনা শহরের ক্ষেত্রে।
দেশের জেলা শহর সমৃদ্ধিতে নানা রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিনিয়োগ কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। শিল্পায়ন ও উন্নত মানের হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অন্যতম উদাহরণ।
নগরায়ণ বিকেন্দ্রীকরণের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো, মেগাসিটি ঢাকাসহ অন্যান্য বড় ও মাঝারি শহরে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কাজে বিকেন্দ্রীকরণ করা। জোনাল ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এ ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। পুনরায় উল্লেখ্য, বিকেন্দ্রীকরণ ধারণার সঙ্গে নগরের সার্বিক ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন অতি আবশ্যক।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাম্মানিক চেয়ারম্যান, নগর গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা