ঢাকা ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪

বাংলাদেশে নগরায়ণ, প্রাইমেট সিটি ঢাকা এবং বিকেন্দ্রীকরণ চিন্তা

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
আপডেট: ২০ জুন ২০২৪, ১০:৫৬ এএম
বাংলাদেশে নগরায়ণ, প্রাইমেট সিটি ঢাকা এবং বিকেন্দ্রীকরণ চিন্তা
নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশে নগরায়ণের গতি ও ধরন দীর্ঘদিন ধরে দেশের ভূগোলবিদ এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের আলোচনার বিষয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরাও তাদের চিন্তাশীল বিশ্লেষণ এবং মতামত প্রদানের জন্য তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের নগরায়ণের ওপর সুচিন্তিত লেখার একজন অনুসরণকারী হিসেবে আমি সব সময় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক নাফিস আহমদের আকর প্রবন্ধটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করি। The Urban Pattern in East Pakistan শিরোনামের প্রবন্ধটি ১৯৫৭ সালে The Oriental Geographer-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নগরকেন্দ্রগুলোর স্থানিক বিন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়েছিল।

তারপর থেকে আমি এবং অধ্যাপক কে. মওদুদ এলাহী, অধ্যাপক সৈয়দ আবু হাসনাত এবং খুব সম্প্রতি অধ্যাপক নাসরীন রফিকের মতো ভূগোলবিদরা বাংলাদেশের নগরায়ণ-প্রক্রিয়া এবং নগরবিন্যাসের গঠনমূলক বিশ্লেষণ করেছি। আমরা সবাই নগরায়ণ এবং দ্রুত নগর বৃদ্ধির প্রসঙ্গ তুলে ধরেছি। আমরা বৃহৎ অঞ্চল (অর্থাৎ প্রশাসনিক বিভাগ ও জেলা) বা ক্ষুদ্র অঞ্চল (উপজেলাগুলোর মতো) উভয়েরই নগরায়ণ মাত্রার ধরনটি তুলে ধরেছি। নগরায়ণের আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টিও আমাদের লেখালেখিতে গুরুত্ব পেয়েছে। তা ছাড়া ঢাকাকে কেন্দ্র করে একটি নিয়ন্তা নগর বা প্রাইমেট সিটি বৃদ্ধির প্রশ্নটি ভূগোলবিদ এবং পরিকল্পনাবিদদের মতো এখন অর্থনীতিবিদরাও পর্যালোচনা করছেন। আমাদের নগরায়ণ বিশ্লেষণে বিকেন্দ্রীকরণের মতো বিষয়ও গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশে নগরায়ণ ধারা (অর্থাৎ গ্রামীণ থেকে শহুরে জনসংখ্যায় পরিবর্তনের প্রক্রিয়া) স্বাধীনতার পরবর্তী ৫ দশকে অত্যন্ত দ্রুত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে নগরায়ণ মাত্রা ছিল মাত্র ৭%; এখন ৩৩%-এর বেশি। বৃদ্ধিহার প্রায় ৪%। নগরে জনসংখ্যার আকার বিশাল- ৫০ মিলিয়ন বা ৫ কোটিরও বেশি। 

জাতীয় নীতিমালা, যেমন- পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩ সাল থেকে) বা জাতীয় হ্যাবিট্যট (মানববসতি) প্রতিবেদনসমূহেও (১৯৭৬ সালে শুরু) দ্রুত নগরায়ণ এবং ঢাকার উচ্চ প্রাধান্যের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে। সরকারের খসড়া জাতীয় নগরনীতি (২০১১ ও ২০২৪), প্রাইমেট সিটি সমস্যা এবং সেই সঙ্গে নগরায়ণে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে অবস্থিত ঢাকা বিভাগে/জেলায়, প্রান্তিক বিভাগ এবং জেলার তুলনায় উচ্চহারে নগরায়ণ হয়েছে। অবশ্য এদিকে নিয়ন্তা/মেগাসিটি ঢাকার পাশে অবস্থিত মানিকগঞ্জের মতো একটি জেলায় নগরায়ণের নিম্নহারের উপস্থিতির বিষয়টি আশ্চর্যজনক।

অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রথম, যিনি বাংলাদেশে নগরায়ণের বৈষম্য এবং উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় অপ্রধান শহরগুলোর ভূমিকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন। সম্প্রতি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) অর্থনীতিবিদ ড. আহমদ আহসান বাংলাদেশের নগরায়ণ ধারা এবং মেগাসিটি ঢাকার ‘অতিবৃদ্ধি’/ ‘ওভারগ্রোথ’ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নগরায়ণের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেন এবং রাজধানী শহরের অতিবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেন। আরেকজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ এবং পরিবেশবিদ ড. এস নজরুল ইসলাম (বাপা-বেন-এর) ড. আহমদ আহসানের কাজ অনুসরণ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন যে ঢাকার ‘অতিবৃদ্ধি’ বিপরীত উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে এবং দেশে আরও বৈষম্য তৈরি করতে পারে। এ বিষয়ে প্রতিকার হিসেবে তারা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। উল্লেখ্য, অতিবৃদ্ধি বা ‘ওভারগ্রোথ’ বলতে তারা মূলত ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন।

তবে দুই অর্থনীতিবিদ কীভাবে ‘ঢাকা’কে সংজ্ঞায়িত করেছেন তা স্পষ্ট নয়। এটি কি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সমন্বিতভাবে যে কেন্দ্রীয় মহানগর বা মেট্রোপলিটন শহর ঢাকা, যার আয়তন মাত্র ৩০৪ বর্গকিলোমিটার ও বর্তমান আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১২ মিলিয়ন, নাকি এটি ঢাকা মেগাসিটি অর্থাৎ রাজউকের রাজধানী মহানগর বা মেট্রোপলিটন অঞ্চল, যার আয়তন প্রায় ১৫৩০ বর্গকিলোমিটার এবং আনুমানিক জনসংখ্যা ২০ মিলিয়নেরও বেশি। এই মেগাসিটি অঞ্চলটিতে রয়েছে চারটি সিটি করপোরেশন (ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর) এবং সাভারের মতো বেশ কয়েকটি পৌরসভা এবং অসংখ্য ইউনিয়ন পরিষদ ও গ্রামীণ এলাকা। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন বা সাভার পৌরসভার অধিবাসীরা নিজেদের ঢাকাবাসী বা ঢাকার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে চাইবেন না, যদিও তারা ঢাকা মহানগর অঞ্চল তথা ঢাকা মেগাসিটির অধিবাসী। 

জাতীয় নগর ক্রমে/হাইআরকিতে দেশের বৃহত্তম শহর ঢাকার প্রাধান্য স্পষ্ট। ১৯৬১ সালেই ঢাকায় ছিল দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ২০%। ১৯৭৪ সালে দেশের ৬২.৭ লাখ নগর লোকসংখ্যার মধ্যে ১৭.৭ লাখ, যা দেশের মোট নগর লোকসংখ্যার ২৮.৩% বসবাস ছিল ঢাকা নগরে। এ সংখ্যা ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম অপেক্ষা ১.৯৯ গুণ বেশি। ১৯৮১ সালে ঢাকার প্রাধান্য তুলনামূলকভাবে কিছুটা কমে যায়। এ সময় ঢাকায় ছিল দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ২৫.৭%। ঢাকার প্রাধান্য পরবর্তী দশকে আবার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালে দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ৩০.৫% ছিল এই নগরে। ২০০১ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪% এবং ২০১১ সালে ৩৩% মোটামুটি একই উচ্চ প্রাধান্য ছিল। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরের তুলনায় ঢাকার প্রাধান্য ছিল স্পষ্ট। যথাক্রমে ৩.১৬ গুণ ও ৩.৮০ গুণ (BBS, ২০১১)। ২০২২ সালে (২০২১-এর শুমারি ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হয়) বাংলাদেশে নগর জনসংখ্যা ছিল ৫২ মিলিয়ন। এর মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকায় নগর জনসংখ্যা ছিল ১০.২ মিলিয়ন, যা দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ১৯.৬২%। অবশ্য বৃহত্তর ঢাকার আনুমানিক প্রায় ২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা হিসেবে মেগাসিটি ঢাকার নগর জনসংখ্যা দাঁড়ায় দেশের মোট নগর জনসংখ্যার  ৩৮.৪৬%, অর্থাৎ অতিমাত্রায় প্রাইমেট পরিস্থিতি। 

পরিকল্পনাবিদ, ভূগোলবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা সবাই মেগাসিটির দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেন। এ ধরনের অবস্থান যুক্তিযুক্ত এবং প্রশংসনীয়। তবে এর সঙ্গে নগর ব্যবস্থাপনা বা সুশাসনের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। উন্নত দেশ জাপানের রাজধানী বিপুলাকার মেগাসিটি টোকিও বসবাসযোগ্য। কারণ সে শহরে ব্যবস্থাপনা সুচারু। মধ্যম আয়ের দেশ থাইল্যান্ডের অতিমাত্রার প্রাইমেট মেগাসিটি ব্যাংককও বসবাসযোগ্য। কেননা সেখানে নগর পরিচালন বা ব্যবস্থাপনা উত্তম।

বাংলাদেশে আজ নিয়ন্তা নগর/প্রাইমেট সিটি এবং অন্যান্য মাঝারি কিংবা ছোট শহর উভয়ই বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ময়মনসিংহের মতো একটি মাঝারি শহরও মেগাসিটি ঢাকার মতো বসবাসের অযোগ্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে। মূল সমস্যা অবশ্যই শহরগুলোর ব্যবস্থাপনার গুণমান। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বা পরিচালন পরিকল্পিত নগর/শহর উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান হওয়া প্রয়োজন। যা-ই হোক, এই ধারণাটি অবশ্য নগরায়ণ-প্রক্রিয়া এবং উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ের গুরুত্বকে কোনোভাবেই কমিয়ে দেয় না।

জাতীয় নগর নীতিমালার (২০১১ ও পরিমার্জিত ২০২৪) খসড়াতে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়েছে। নীতিমালার অন্য ধারাগুলোও যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করে রচিত হয়েছে। আমরা সরকারকে অবিলম্বে নীতিটির অনুমোদন এবং বিশেষ করে বিকেন্দ্রীকরণ এবং শক্তিশালী নগর পরিচালনের ওপর জোর দিয়ে বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানাই। 

বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে দুটি প্রসঙ্গ আলোচিত হয়ে থাকে। প্রথমে বৃহৎ ও মাঝারি অঞ্চলভিত্তিক (অর্থাৎ বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে) বিকেন্দ্রীকরণ। দ্বিতীয়ত, নগর/শহরভিত্তিক (আরবান সেন্টার) বিকেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ইত্যাদি বিভাগীয় শহরে বিকেন্দ্রীকরণ।

বিকেন্দ্রীকরণ চিন্তায় ড. আহমদ আহসান বেশ চরম ধারণা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সব জেলাকে (৬৪) প্রদেশে উন্নীত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিকেন্দ্রীকরণের বাকশাল সময়ের জেলা গভর্নর নিয়োগের কথা স্মরণীয়। ড. এস নজরুল ইসলাম অবশ্য প্রদেশ চিন্তা করেননি। তিনি রাজধানীর সঙ্গে জেলা ও উপজেলায় উন্নত রেল যোগাযোগের সুপারিশ করেন। প্রস্তাবিত ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের যথাযথ উন্নয়নের কথা বলেন। তা ছাড়া মৌলিকভাবে জেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেন। এ ক্ষেত্রে আমি তার সমমনা। 

নগরায়ণ বিকেন্দ্রীকরণের অপর একটি ধারণা হলো In situ urbanization বা অকুস্থল নগরায়ণ তথা বিচ্ছুরিত নগরায়ণ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধারণা- ‘গ্রাম হবে শহর’ বা ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এক অর্থে ইন-সিটু আর্বানাইজেশনের সমরূপী ধারণা। অবশ্য মাঝারি বা বড় শহরে প্রবৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রেই থাকবে প্রকৃত বাস্তবতা। দেশের নগরায়ণ ধারায় বিভিন্ন কারণে কোনো কোনো নগর বা শহরে জনসংখ্য বৃদ্ধির স্থবিরতা, এমনকি সংখ্যা হ্রাসের মতো বাস্তবতাও ঘটে, যেমন ঘটেছে খুলনা শহরের ক্ষেত্রে।

দেশের জেলা শহর সমৃদ্ধিতে নানা রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিনিয়োগ কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। শিল্পায়ন ও উন্নত মানের হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অন্যতম উদাহরণ।

নগরায়ণ বিকেন্দ্রীকরণের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো, মেগাসিটি ঢাকাসহ অন্যান্য বড় ও মাঝারি শহরে প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কাজে বিকেন্দ্রীকরণ করা। জোনাল ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এ ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। পুনরায় উল্লেখ্য, বিকেন্দ্রীকরণ ধারণার সঙ্গে নগরের সার্বিক ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন অতি আবশ্যক।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাম্মানিক চেয়ারম্যান, নগর গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা

বাজেটে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা কতটুকু

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
বাজেটে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা কতটুকু
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

এবারের বাজেটে যেসব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য রয়েছে, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগের হার, মূল্যস্ফীতি হ্রাসের মাত্রা ইত্যাদি বিষয় বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে বলে মনে হয়। বর্তমানে দেশের বিনিয়োগ বাজার অনেকটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। শেয়ারবাজারে ক্রমাগত দরপতন হচ্ছে। সার্বিকভাবে ইনডেক্স অনেকটা নিচের দিকে নেমে এসেছে। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে অর্থনীতিতে একটি সংস্কার আবশ্যক হয়ে পড়েছিল আরও আগেই এবং তা জরুরি। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার। 

অর্থনীতির বড় এই খাতটিতে সুশাসনের যথেষ্ট অভাব আছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের কথা যদি বলা হয়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পথনির্দেশনা দেওয়া নেই। সম্প্রতি যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা এই খাতকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও পিছিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া যেসব সংস্কার ইতোমধ্যে হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায়নি। বেসরকারি বিনিয়োগও বেশ শ্লথগতিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কাজেই অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর বিকল্প নেই। 

দেশে সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হারের অঙ্কটি আরও অধিকমাত্রায় বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেওয়া ঝুঁকি তৈরি করে। কাজেই নীতিনির্ধারকদের মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছে এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট ব্যর্থতা আছে। 

এই মুহূর্তে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বৈষম্য বেড়ে যাওয়া। মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। এই সংখ্যা কত তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এ ছাড়া দেশে বৈষম্য এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ পরিস্থিতিকে এখনই মোকাবিলা করা না গেলে তাতে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রবাসী আয়, খেলাপি ঋণ, রপ্তানি আয়, লেনদেনে ভারসাম্যসহ অর্থনীতির সূচকগুলোও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই।

নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মান অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে পড়লে অস্থিরতা আরও বাড়বে। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে বা সিন্ডিকেট না ভেঙে সরাসরি আমদানি করতে চাইলে কৃষক বা উৎপাদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা বাজার ম্যানিপুলেশন করার জন্য সাধারণত কৃষক বা উৎপাদনকারী দায়ী নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়িক শ্রেণি। এরা সিন্ডিকেট করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে থাকে। মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমানো হবে, সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। 

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই অনৈতিক। এতে করে লোকজনের মধ্যে উৎসাহের অনেকটাই ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর ফলে তাদের মধ্যে একধরনের ধারণা তৈরি  হয়েছে যে, সে যদি কর না দিয়ে কালোটাকা বানায় তাহলে ভবিষ্যতে এর প্রেক্ষিতে কম হারে কর দেওয়া যাবে। সুতরাং এতে করে  কালোটাকার মাত্রাটা আরও বেড়ে যেতে পারে। 

দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর আইনি প্রয়োগে যথেষ্ট অবহেলা আছে। আইনগুলো শক্তিশালী হওয়া দরকার ছিল, কিন্তু হয়নি। এসব বিষয় অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও বেশি দুর্বল করেছে। ফলে অর্থনীতি একটা বড় রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি না হয়ে আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। যেটি মানুষের জীবনযাত্রার মানকে অনেক বেশি নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। 

এমতাবস্থায় সচেতনতার সঙ্গে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি আরও বেশি সমস্যাসংকুল হবে। মূল্যস্ফীতির ফলে আমাদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমগুলো ব্যাহত এবং একই সঙ্গে বিনিয়োগ ব্যাহত হলে যেসব সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান কঠিন হয়ে যাবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আমাদের পরিবেশ উন্নত এবং অনুকূল করতে হবে। তাই অর্থনীতির চলমান সমস্যাগুলো সমাধান করতে হলে জোরালো ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের মূল্য যাতে না বাড়ে, সে জন্য প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যেতে পারে। 

দেশের অর্থনীতি ঋণনির্ভর হলে চলবে না। এতে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক প্রবাহ কমে যাবে। আমাদের বিনিয়োগ বাজারের অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়। বিনিয়োগ বাজার যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দেওয়া ঠিক নয়। আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত ঋণনির্ভর না হয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে মনোযোগ বাড়ানো। 

আমাদের যে টার্গেট আছে সেটা কোনো অবস্থাতেই অর্জিত হয় না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। করের হার না বাড়িয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারা অনেকেই কর দেয় না। ইনকাম ট্যাক্স, অর্থাৎ যাদের টিন নম্বর আছে তারা অনেকেই রিটার্ন দেয় না। 

সর্বোপরি বাজেট কতটা জনবান্ধব হলো সেটিও দেখা দরকার। হঠাৎ পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হয়। এখন ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা হয়তো চাপে পড়বেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। দেরিতে হলেও আংশিকভাবে আমরা সেই পথে গেছি। তবে বিদ্যমান নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কাজেই সার্বিকভাবেই অস্থিতিশীল অর্থনীতির চাপ মোকাবিলায় একটি ভালো রকম সংস্কার প্রয়োজন আছে। ডলারসংকটসহ যেসব কারণে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে, সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। 

পণ্যের মূল্য যাতে না বাড়ে, সে জন্য প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা দরকার। বাজেট যেন সাধারণ মানুষের জন্য একপেশে হয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি। দেশে বিদ্যমান যেসব আইন আছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কঠোর আইন প্রয়োগের প্রতি বিশেষ জোর দিতে হবে। অর্থনীতির ভিত সুরক্ষায় এ বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে।

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

‘বিকশিত ভারত’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ যৌথ সহযোগিতায় গড়ে তোলার অঙ্গীকার

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪১ এএম
আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১১:৪১ এএম
‘বিকশিত ভারত’ ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ যৌথ সহযোগিতায় গড়ে তোলার অঙ্গীকার
সৈয়দ ফারুক হোসেন

দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২২ জুন দিল্লিতে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছিলেন। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফর। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড স্পর্শ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বপ্রথম ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। 

ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আঞ্চলিক অংশীদার। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত বিকশিত এবং দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প-২০৪১’-এর মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় এখন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জনগণের হাতে। দুই দেশই জনগণের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা বলতে গেলেই অনিবার্যভাবে সর্বপ্রথম একাত্তরের কথা চলে আসে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। 

যুদ্ধের মাঠে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা একসঙ্গে মিশে পাকবাহিনীর বিপক্ষে লড়াই করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট সম্পর্ককে বাংলাদেশ সব সময়ই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ভারতের অনেক বীর, যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে। 

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আগত সামরিক শাসক ও তাদের উত্তরসূরি রাজনৈতিক পক্ষের মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পথিমধ্যে সম্পর্ক ততটা এগোতে পারেনি। ২০০৯ সালের পর থেকে আবার দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের সুবাতাস শুরু হয়েছিল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় এসে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘একেবারে একান্ত ভারতের জাতীয় স্বার্থে সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ প্রয়োজন।’ 

একদম সঠিক কথাই তিনি বলেছেন। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে টেকসই করার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশের নৌ, স্থল ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা মানেই বাংলাদেশের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া। 

বাণিজ্য, সংযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকে দুই সরকারপ্রধান উভয় দেশের স্বার্থে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ডিজিটাল ও সবুজ অংশীদারির জন্য যৌথ দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্মত হয়েছেন। এর আগে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একাধিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে ঢাকা ও নয়াদিল্লি। বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলেও এই দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেয়েও জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কটা অনেক মজবুত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং যেসব বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, সে বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে এই সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় থাকতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল। 

পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে পূর্ব বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তখন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার যে সহায়তা করেছিল তা বাংলার মানুষ কখনো ভুলবে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক রক্ত দিয়ে লেখা। এ সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। এ সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের নয়, এ সম্পর্ক ভাইয়ের সম্পর্ক। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় গেছে তা অনুসরণ করার মতো। এ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। 

রক্তে লেখা সম্পর্ক অক্ষুণ্ন থাকবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদি ‘মৈত্রী চুক্তির’ মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্কের যে গোড়াপত্তন করে গেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তা আরও সুসংহত ও বহুমুখী করেছেন। তারই হাত ধরে গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, ট্রানজিট সুবিধা প্রদান ও সমুদ্রসীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। ভারতের সীমান্ত নীতির ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতির কারণে বাংলাদেশ এখন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। 

বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভ্রমণ, ব্যবসা এবং চিকিৎসার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গমন করে তার প্রধানতম প্রবেশদ্বার হচ্ছে বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবুজ অর্থনীতি, পারমাণবিক শক্তি, বিগ ডেটা, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সহযোগিতা স্থাপনে ভারতের রাষ্ট্রপতি জোর দিয়েছেন। 

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এমন বন্ধনে আবদ্ধ যে এর সঙ্গে অন্য কোনো দেশের সম্পর্কের তুলনা চলে না। আর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশ-মায়ানমার উভয় পক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশেরই ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত এবং শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির প্রতি আবেগ প্রায় সমরূপ এবং ওই বিষয়গুলোতে মিল রয়েছে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়সহ উচ্চপর্যায়ের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। ভারত বাংলাদেশ দুই পক্ষের মধ্যে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বৈঠকের মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে রাজনীতি ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও সংযোগ, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, জ্বালানি ও শক্তি এবং আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। উভয় দেশই একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে আমাদের পথ দেখানোর জন্য ‘রূপকল্প ঘোষণা’ অনুমোদন করেছে। 

ভবিষ্যতের জন্য ‘ডিজিটাল অংশীদারি’ এবং ‘সবুজ অংশীদারি’বিষয়ক দুটি সমন্বিত রূপকল্প সামনে রেখে কাজ করতে সম্মতি প্রকাশ করেছে দুই দেশ। দুই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক জোরদারে নতুন ৭টিসহ মোট ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের পর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সমুদ্র অর্থনীতি ও সামুদ্রিক সহযোগিতা, রেলওয়ে, দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে সহযোগিতা, মৎস্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক বিনিময় করা হয়। 

নতুন সাতটি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞান ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যৌথ গবেষণার জন্য বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) এবং ভারতের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (সিএসআইআর) মধ্যে সমঝোতা স্মারক। 

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল সংযোগ নিয়ে সমঝোতা স্মারক ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ ডিজিটাল পার্টনারশিপ এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সবুজ অংশীদারির বিষয়ে ‘শেয়ার্ড ভিশন’ স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ ভারতীয় রুপিতে লেনদেন শুরু করেছে। ভারতীয় গ্রিড ব্যবহার করে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে যাচ্ছে। 

দুই দেশ পদ্মা চুক্তি নবায়নে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের তিস্তা নদীর সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনা পরিদর্শনের জন্যও (ভারতের) একটি কারিগরি দল বাংলাদেশ সফর করবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উভয় দেশকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। তাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপরও নজর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা চালু করবে ভারত। 

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের সুবিধার্থে রংপুরে নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান, আমাদের স্বাধীনতা এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী। 

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার  শেষ দ্বিপক্ষীয় সফর করেছিলেন এবং পরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আমন্ত্রিত ‘অতিথি দেশ’ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে নয়াদিল্লিতে ভারতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  এই একই ‘জুন’ মাসে অভূতপূর্ব দ্বিতীয়বারের মতো নয়াদিল্লি সফর করেছেন। 

এর আগে শেখ হাসিনা ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং নবগঠিত মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আরও কয়েকজন বিশ্বনেতার সঙ্গে নয়াদিল্লি সফর করেন। এ সবই সুসম্পর্ক আমাদের এই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সঙ্গে কাজ করার প্রমাণ বহন করে।

লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

শেখ হাসিনার সফল ভারত সফর

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৫ এএম
আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৫ এএম
শেখ হাসিনার সফল ভারত সফর
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৮ ঘণ্টার সফরে দিল্লিতে এসেছিলেন। ভারতে হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে তার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। যেখানে প্রতিরক্ষা থেকে সীমান্ত সংযোগ, সন্ত্রাস মোকাবিলা থেকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যৌথ অংশীদারি ইত্যাদি সবই ছিল। ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ১০টি চুক্তি করে গেছেন। 

সেই চুক্তিতে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ ১৬ আনা নয়, ১৮ আনাই সফল হয়েছেন। ভারতে যারা এখনো বাংলাদেশ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার শেখ হাসিনার ভারত সফর প্রসঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মতে, এই চুক্তি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর শেখ হাসিনা ঢাকা ফিরে গিয়ে আওয়ামী লীগের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন করেছেন। সেখানেও যা খবর পাওয়া গেছে, তার দেশ এই চুক্তির মধ্যে যথেষ্ট আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।

এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মূল বিষয়গুলোর দিকে এবারে চোখ ফেরানো যাক: বাংলাদেশের অসুস্থদের জন্য ই-ভিসা, রাজশাহী-কলকাতা নতুন রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কলকাতা নতুন বাস সংযোগ, গেদে থেকে দলগাঁও মালবাহী রেল সংযোগ, রংপুরে নতুন সহকারী হাইকমিশন, ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ, সিরাজগঞ্জে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো তৈরি করা, গঙ্গা চুক্তি নবায়নে যৌথ কারিগরি দল, যৌথ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উদ্যোগ এবং তিস্তা সংরক্ষণ ও পরিচালন প্রকল্পের জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দলের বাংলাদেশ সফর।

এই নতুন সমঝোতাপত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিস্তা-সংক্রান্ত পদক্ষেপ। কারণ, ধাক্কা খেয়েছে চীন। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দলের মুখ্যমন্ত্রী মমতাও জোর ধাক্কা খেয়েছেন। এ খবর প্রকাশিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি করেছেন ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে কৈফিয়তও দাবি করেছেন। 

২৮ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বাবুর সঙ্গে কথা বলে ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছিল, যা শেষ হবে ২০২৬ সালে। ওই চুক্তি হয়েছিল জাতিপুঞ্জের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু এবং কংগ্রেস নেতা বরকত গনি খান চৌধুরী। এই ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর খুনি জিয়াউর রহমান ভারতের বিরুদ্ধে জাতিপুঞ্জে নালিশ জানিয়েছিলেন। 

সেই নালিশের জবাব দিতে ইন্দিরা গান্ধী জাতিপুঞ্জে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ ও সেচমন্ত্রী মালদার বরকত গনি খান চৌধুরীকে। বরকত সাহেব নিউইয়র্কে জাতিপুঞ্জে অন্তত ৫০টা দেশের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশকে মাত্র চার বছর হলো আমরাই স্বাধীন করে দিয়েছি, হঠাৎ পানির জন্য এখানে কেন? তিনি আরও বলেন, ‘রক্ত দিয়েছি, পানিও দেব, কিন্তু এখানে নয়। বাংলাদেশকে আসতে হবে ঢাকা, দিল্লি, কলকাতা এবং মালদায়।’ জাতিপুঞ্জের প্রেস গ্যালারিতে তখন আমিও বসেছিলাম। 

হঠাৎ ৩০ বছর পর মমতা কেন তিস্তা নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছেন? তিনি ভুলে গেছেন যে, তিনি একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী নন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরের আগে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে তিন-তিনবার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন মমতার সঙ্গে কথা বলতে। শেষবার মেনন তারই ব্যাচমেট মুখ্যসচিব প্রসাদ রায়কে মমতার সামনে বলে এলেন যে, আপনি দয়া করে আপনার মুখ্যমন্ত্রীকে ইংরেজি শেখান, উনি জানেন না, তাই আমার কোনো কথাই উনি বুঝতে পারছেন না। 

এবারে দেখা যাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সাফল্য। শেখ হাসিনার সফর নিয়ে আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি মনমোহন সিংয়ের আমলে সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেননের সঙ্গেও। তিনিও বলেছেন, এই চুক্তি হাসিনার অভিজ্ঞতা ও পরিণতমনস্কতা প্রমাণ করে। 

আশা করি, বাংলাদেশের মানুষও এতে খুশি হবেন। শোনা গিয়েছিল শুষ্ক  মৌসুমে জল ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ তিস্তার ওপর একটি বাঁধ তৈরি করবে, যার খরচ হবে ১ বিলিয়ন ডলার। এই টাকাটা অল্প সুদে ভারত বাংলাদেশকে দেবে। চীন এই সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। ভারত সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগের পর অভিযোগ ছিল যে, চীন আওয়ামী লীগের কিছু নেতার মাধ্যমে তদবির শুরু করেছিল।

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল- ভারতীয় ভিসা অফিস খোলা, এই চুক্তিতে তাও অনুমোদিত হয়েছে। দুই দেশের পর্যটনব্যবসা বৃদ্ধিতে এই চুক্তি অনেকটাই কার্যকরী হবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল, তবে তা নির্ভর করছে দুই দেশের ভিসা-সংক্রান্ত নিয়মের শিথিলতার ওপর।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মতে, গত এক বছরের মধ্যে এবারের বৈঠকটি ছিল একেবারেই আলাদা, কারণ তৃতীয়বার তারা সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই আমাদের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। হাসিনা মনে করেন, দুই দেশের সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই ঢাকা এবং দিল্লি নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছে।

ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির ১০টি বিষয়ই দুই দেশের অনেক সমস্যার সমাধান করবে, এ বিষয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কোনো দ্বিমত নেই। তারা সবাই খুশি।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৩ এএম
আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:২৩ এএম
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ
হীরেন পণ্ডিত

তৈরি পোশাক খাত বা আরএমজি খাত বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য একটি সফল মডেল। কিন্তু এখন সময় এসেছে চামড়া, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি এবং হালকা প্রকৌশলের মতো অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ফোকাস করার। জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর কীভাবে তার রপ্তানির পরিধি বৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা শুরু করেছে। 

এগুলোর মধ্যে রয়েছে কম খরচে এবং সহজে প্রবেশাধিকার, পর্যাপ্ত নীতি-সহায়তার পাশাপাশি পোশাকবহির্ভূত রপ্তানি খাতের জন্য আর্থিক এবং আর্থিক ছাড়া অন্য প্রণোদনা এবং সমান দক্ষতার বিকাশ নিশ্চিত করা। আমাদের উচিত ভালো রপ্তানির সম্ভাবনাসহ পোশাকবহির্ভূত খাতগুলোর প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া। দেশের রপ্তানিকে বৈচিত্র্যময় করা, যাতে ২০২৬ সালে এলডিসিতে উত্তরণের পর বিদ্যমান এবং নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে। 

বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ের জন্য একটি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এখন রপ্তানির ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাকের অংশ অন্যান্য শিল্প ও উৎপাদন উপাদানের সুস্থ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কবে নেমে আসবে তা কেউ জানে না। চামড়া ও জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিকস, আইটি ও সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, সংযোজন শিল্প, হস্তশিল্প, হিমায়িত খাদ্য, কৃষিভিত্তিক আইটেম এবং আরও কয়েকটি খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে পারে। 

আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি আরও সহজতর করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ পাট খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং টেকসই উনয়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাড়ানোর বিবেচনায় এই শিল্পটি ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে।

সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর উচিত দেশীয় প্রবিধানগুলো প্রয়োগ করা, যা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা অনুমোদিত শিল্পের প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটকে (বিএসটিআই) শক্তিশালী করা, যাতে স্থানীয় পণ্যগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করা যায়। 

দেশের আইনি সক্ষমতাও বাড়াতে হবে, কারণ বাণিজ্যিক বিরোধ এলডিসি উত্তরণ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পাট, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, আইসিটি এবং অন্যান্য উদীয়মান খাতের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সব ধরনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।

বাংলাদেশকে বিনিয়োগের পরিবেশ অর্জন করতে হবে। ব্যবসায়ীদের উচিত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং তাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য গবেষণায় মনোনিবেশ করা। প্রতিটি ব্যবসায় শিল্পের মালিক ও উদ্যোক্তারা পণ্যের চাহিদা ও গুণগত মান নির্ধারণ করে এবং রপ্তানির জন্য পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে তাদের দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার উদ্যোগ নেন। 

বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২৩টি দেশের ওপর একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। অন্য কথায় একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, আমরা আমাদের সামনে আসতে পারে- এমন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি।

অন্যান্য নন-গার্মেন্ট সেক্টরের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। পোশাকের নকশা, রং সবকিছুই পরিবর্তন করতে হয়। বিশ্ব পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। তবে বিশ্ববাজারের মাত্র ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার। তাই বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়াতে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। 

এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পোশাকশিল্পের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধিতে এবং বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত সর্বাগ্রে। তাই রপ্তানি বহুমুখীকরণে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্বব্যাপী দুটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত সূচক হলো ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, এনাবলিং ট্রেড ইনডেক্স এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ট্রেড লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই)। সব সেক্টরে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধা রয়েছে, কিন্তু দক্ষতার ঘাটতি, প্রযুক্তি আপগ্রেড করার প্রয়োজন, দুর্বল অবকাঠামো বা আন্তর্জাতিক মান ও সম্মতি পূরণে অসুবিধার মতো বাধার সম্মুখীন হয়। 

এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ খারাপ করে কিন্তু পরিবহন ও বিদ্যুতের স্কোর বিশেষত কম যা উৎপাদন খাতে গুরুতর বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে কম বেতনের অদক্ষ শ্রমের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে। কোনো দেশের রপ্তানির জন্য কোনো একটি উৎসের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া কখনোই ভালো নয়। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও টেকসই বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি পণ্যকে বহুমুখী করতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে একদিকে এক পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে মোট রপ্তানি আয় বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান। উপকৃত হবে নারীরাও। বাংলাদেশ থেকে ১৬০০ ধরনের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে রপ্তানি হয় জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, তৈরি পোশাকের ২৯২ ধরনের পণ্য থেকেই মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ ভাগ আসে। বাকি ১৩ শতাধিক পণ্য থেকে আসে মাত্র ১৫ শতাংশ আয়। 

কিন্তু এই ১ হাজার ৩০০ পণ্যের মধ্যে প্রচুর পণ্য রয়েছে, যেগুলোর বাজার অনেক বড় এবং প্রতিনিয়ত চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য ও ওষুধের বাজার বড় হচ্ছে। এসব খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক দেশের তুলনায় বেশি। ফলে সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা পেলে এসব খাত থেকে রপ্তানি আয় বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

একটি পণ্যের ওপর নির্ভর করে এগোনো যাবে না। রপ্তানির অন্যান্য খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভিয়েতনামের নিজস্ব চামড়া নেই। আবার জনসংখ্যাও কম। কিন্তু ভিয়েতনাম বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু বাংলাদেশের নিজস্ব চামড়া ও পর্যাপ্ত জনবল থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি হচ্ছে ১ বিলিয়ন ডলার। প্লাস্টিকের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। 

এ শিল্পের সম্ভাবনা অনেক। তবে সরকারের নীতি-সহায়তা বাড়াতে হবে। কোভিডের অভিঘাত কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি এখন চাঙা হচ্ছে। গতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। দেশের রপ্তানি খাতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে পণ্য রপ্তানি হয়েছে সরকারের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। রপ্তানির ঊর্ধ্বগতিতে বরাবরের মতো এবারও বড় ভূমিকা রেখে চলেছে তৈরি পোশাক খাত। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ আরও কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রেও রপ্তানির গতি ইতিবাচক। 

বাংলাদেশের কয়েকটি ব্র্যান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে; যা এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে। 

নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্পপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

‘প্রত্যয় স্কিম’ উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের অন্তরায়

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:১৯ এএম
আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪, ১০:১৯ এএম
‘প্রত্যয় স্কিম’ উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের অন্তরায়
মো. মাসুদ রানা কবির

পেনশন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যেকোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার আওতায় আনা হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান পেনশন ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা দেশের সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আগামী ১ জুলাই থেকে ‘প্রত্যয় স্কিম’ চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে কোনো আলোচনা-পর্যালোচনা ব্যতীত এমন সিদ্ধান্ত সর্বমহলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ‘প্রত্যয় স্কিমে’ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়ে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছে এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিতকরণের চেষ্টা করছে। 

পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী স্বশাসিত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে অবসর গ্রহণকারীদের অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অনাগ্রহী হয়ে পড়বেন। মজার বিষয় হলো, তথাকথিত প্রত্যয় স্কিমকে সর্বজনীন বলা হলেও বাস্তবে এটি সর্বজনীন নয়। কারণ সরকারের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকে এই স্কিমের আওতাভুক্ত করা হয়নি। 

একই সঙ্গে এটি স্বায়ত্তশাসন ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে। বর্তমানে প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রত্যয় স্কিমের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো-

১. বর্তমানে প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী অবসরভোগীদের প্রদেয় অর্থ প্রতিবছর শতকরা ৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাবে। প্রত্যয় স্কিম চালু হলে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা এই সুবিধাভোগী হবেন। চলমান পেনশন ব্যবস্থাপনায় অবসরোত্তর ভাতাকে প্রচলিত মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। 

২. প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী মূল বেতনের ১০ শতাংশ মাসিক হারে কর্তন করা হবে। অথচ প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থাপনায় মূল বেতন থেকে কর্তনের কোনো বিধান নেই। সেই সঙ্গে বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী একজন ব্যক্তি অবসরে এককালীন অর্থ সুবিধা ও মাসিক পেনশন পান। কিন্তু বৈষম্যমূলক প্রত্যয় স্কিমে এককালীন আনুতোষিকের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। 

৩. প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তির চাকরি সময়সীমা পাঁচ বছর হলে তার পরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত হারে মাসিক পেনশন সুবিধা প্রাপ্য হয়ে থাকেন, পক্ষান্তরে প্রত্যয় স্কিমের আওতায় একজন ব্যক্তির চাকরি সময়সীমা ১০ বছরের কম হলে শুধু জমা করা অর্থ ও এর মুনাফা পাবেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের পরিবার প্রচলিত নিয়মে সুবিধাভোগী হবেন, যা অত্যন্ত প্রহসনমূলক। 

৪. চলমান নিয়ম অনুযায়ী অবসরভোগীর অবর্তমানে তার স্ত্রী, স্বামী অথবা প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে অবসরভোগীর বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী অবসরভোগী কোনো ব্যক্তি ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবারের কোনো সদস্য পেনশন সুবিধার জন্য বিবেচিত হবেন না। 

৫. বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ বছর। কিন্তু প্রত্যয় স্কিল চালু হলে একজন শিক্ষক ৬০ বছর বয়সে পেনশনব্যবস্থার আওতাভুক্ত হবেন। ফলে তাদের শিক্ষা ও গবেষণার কার্যকাল হ্রাস পাবে; ফলে দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী চাকরিকালীন একজন ব্যক্তির অর্জিত কিন্তু অভোগকৃত ছুটির নগদায়ন সম্ভব নয়। 

ইউনেসকোর মানদণ্ড অনুযায়ী দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য মোট বাজেটের ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত। সাম্প্রতিক বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ছিল মোট বাজেটের ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এটি গভীর উদ্বেগের বিষয় প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিবেচনা না করেই যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাজুক অবস্থান আমাদের শিক্ষা খাতের দুর্বলতা এবং নীতিনির্ধারকদের অবহেলাকে নির্দেশ করে। 

দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে দেশ ও জাতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষকরা দেশ ও জাতি গঠনের কারিগর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য তাদের সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়েও অপ্রতুল। 

পরিশেষে বলতে চাই, মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে এবং শিক্ষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাদের দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবি ‘স্বতন্ত্র বেতন স্কেল’ বাস্তবায়ন করা হোক এবং একই সঙ্গে প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে বাতিল করা হোক ৷

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ