প্রথমেই বলে রাখি, আমি পেশাদার চলচ্চিত্র সমালোচক নই, ফলে সিনেমার শিল্পগত উৎকর্ষ নিয়ে বলবার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু কোনো ছবি দেখে যদি ভালো লাগে, বিশেষত এই ছবিটা, তা হলে সে কথা পাঠকদের জানাতে ইচ্ছে হয়। সম্প্রতি কলকাতার বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের আমন্ত্রণে নন্দনে গিয়ে শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মুজিব, এ নেশন ইন দ্য মেকিং’ ছবিটি দেখার সুযোগ হলো।
এটি সম্বন্ধে অনেক শুনেছি। শুনেছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিজি স্বয়ং প্রস্তাব করেছিলেন যে, ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় শেখ মুজিবের একটি জীবনচিত্র তৈরি করা হোক। সুখের বিষয় যে, ফিল্ম করপোরেশন অব ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে এই তিন ঘণ্টার ছবিটি তৈরি হয়েছে। দুই দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার এ এক উজ্জ্বল নিদর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতার চেতনা এভাবে অব্যাহত থাকা খুব জরুরি।
শ্যাম বেনেগাল অবশ্যই ভারতের বর্ষীয়ান আর খ্যাতিমান পরিচালক, তবু তথ্যচিত্র বলতেই দর্শকের মনে একটা ভয় জাগে। এই রে, নিশ্চয়ই একগাদা খবর, স্থিরচিত্র, বক্তৃতা, বাণী এসব থাকবে। আর তিন ঘণ্টার মতো দৈর্ঘ্য, সেটাও মনে একটু ভয় ধরায়।
কিন্তু এই বৃদ্ধের যেটা দেখে ভালো লাগল যে, বেনেগাল পুরো ছবিটাকে একটা সুগঠিত চলচ্চিত্র বা ফিচার ফিল্মের মতোই নির্মাণ করেছেন। আর তাকে সাহায্য করেছে মুজিবের স্বভাবত বিচিত্রকর্ম ও উত্থান-পতনময় নাটকীয় জীবন, যা একই সঙ্গে নানা সময়ে বিপুল মহত্ত্বকে স্পর্শ করেছে, সেই সঙ্গে মর্মান্তিক বেদনাকেও। আমার মতো অপেশাদার সমালোচকদের মতের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে।
বলা বাহুল্য, এখনকার আখ্যান, তা লিখিতই হোক, নাটকে বা চলচ্চিত্রেই হোক, সময়ক্রম মেনে তৈরি হয় না। সেখানেই ইতিহাস আর গল্পের তফাত, বিবরণ আর প্লটের তফাত। বেনেগাল শুরুই করেছেন বিজয়ী মুজিবকে দিয়ে, যিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন হয়ে দেশ ফিরছেন একটি বিশাল বিমানে।
বিমানটি আকাশে দর্শকের মুখে উড়ে আসছে বিশাল আকাশের পটভূমিকায়, মধ্যে যাত্রী মুজিব ও তার সঙ্গীরা। স্বাধীন বাংলাদেশর স্রষ্টা ফিরছেন মুক্ত স্বদেশে, পাকিস্তানের কারাগার তাকে ধ্বংস করতে সাহস পায়নি, ফলে পূর্ণ মহিমায় তাকে প্রথমেই পাই।
তার ভূমিকাভিনেতা আরিফিন শুভ তার ব্যক্তিত্বের এই নানা মাত্রা, ছাত্রদের মুখপাত্র থেকে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী অনুচর (যাকে তিনি ‘লিডার’ বলতেন), মওলানা ভাসানীর সহযোগী থেকে নিজের বাংলাদেশের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠার ধাপগুলো সযত্নে নির্মাণ করেছেন।
পাশাপাশি চলেছে তার ব্যক্তিগত জীবনের নির্মাণ। বাড়িতে আশ্রিতা ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে তার বিবাহ ও সংসার, যে সংসার পরে আর ব্যক্তিগত থাকবে না, তার জাতীয় ভূমিকার সঙ্গে মিশে যাবে। ফজিলতের অতি মিষ্টি কিশোরী মুখটা পরবর্তী নময়ে পরিণত ফজিলতেও সঞ্চারিত হয়েছে এবং বিবাহের দৃশ্যটিও অতি চিত্তাকর্ষক। এখানে বাংলাদেশের গ্রাম-প্রকৃতির অতি মনোরম দৃশ্যাবলিকে কাজে লাগিয়েছেন পরিচালক, বিশেষ করে নদীতে নৌকা করে তার নির্বাচনি প্রচারের বিষয়টি।
কোনো আখ্যানকেই অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ করেননি, কিন্তু ‘স্পেকটাকল’-এর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সহজ জীবনযাত্রাকে চমৎকার গ্রন্থন করেছেন। মুজিবের জনসভাগুলোতে লোকের ভিড় ক্রমশ বিশাল আকার ধারণ করেছে এবং ’৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণটি তার পূর্ণ মহিমায় চিত্রায়িত হয়েছে। আজকাল হয়তো নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় এগুলো করা তত কঠিন নয়।
মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে যাদের বৃহৎ ভূমিকা ছিল, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান, সব চরিত্রেই অভিনেতার নির্বাচন চমৎকার, অর্থাৎ সবাই তাদের চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।
একটি দৃশ্যে বেলেঘাটায় গান্ধীজির আবির্ভাবও ছাপ রেখে যায়, ইন্দিরা গান্ধীর মুহূর্ত কয়েকের ক্লোজআপও। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী একটু আলাদা হয়ে আসেন, তার ব্যক্তিত্বের কোমল-কঠিনের নানাস্তরীয় বিন্যাসে এবং মুজিবের প্রতি তার অকৃত্রিম স্নেহে।
মৃত্যুর আগে লন্ডনে মুজিবকে তার সিগারেট খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য একটি পাইপ উপহার দেওয়ার ঘটনাটি খুবই হৃদয়গ্রাহী। তেমনই হৃদয়গ্রাহী বাংলার গ্রামে স্বাধীনতার প্রচারের সময় এক গ্রামবৃদ্ধার রান্নাঘরে মুজিবের হাতে কিছু পয়সা তুলে দেওয়া, তা নিতে মুজিবের দ্বিধা কিন্তু বৃদ্ধার আহত বেদনা দেখে তা গ্রহণ করা।
তার গার্হস্থ্য জীবনের স্নেহমমতাময় একটি প্রবল বন্ধনকেও পরিচালক খুব সুন্দরভাবে গেঁথেছেন, সন্তানদের সঙ্গে খেলা ও খুনসুটি আর এই গাঢ়বদ্ধতা অন্তিমের বীভৎস হত্যাকাণ্ডকে আরও দুঃসহ ও মর্মান্তিক করে তোলে। শেখ হাসিনার বিয়ের উপাখ্যানটিও সুন্দর, তার ড. ওয়াজেদের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব ‘কবুল’ করা থেকে।
একটি কল্পিত ছোট এপিসোড, স্ত্রী-কন্যার আশ্রয়স্থলে এক পাঠান সৈনিকের ঘটনা, ছবিতে মানবিক আবেদন যোগ করেছে। শান্তনু মৈত্রের সংগীত পরিচালনা ও গানগুলো ছবিটির আবেদনে শক্তি দিয়েছে।
পরিচালক বা দুই চিত্রনাট্যকার কাউকে বিশুদ্ধ ভিলেইন করে দেখাননি, ইয়াহিয়া খানকেও না। অতিনাটকীয়তা তিনি এড়িয়েছেন, কারণ তিনি জানতেন, আখ্যানেই যথেষ্ট নাটক তৈরি হবে এবং যুদ্ধের ‘স্পেক্টাক্ল... নিচে যুদ্ধ, গেরিলাদের ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, আকাশে পরপর ফাইটার প্লেন ধ্বংস, নিচে ট্যাংক ধ্বংস, আগে কিছু দাঙ্গার দৃশ্য, গণহত্যা আর অগ্নিকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনার বর্বরোচিত ধ্বংসলীলা, বিশ্বস্ততার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে।
অবশ্যই শেষে জিয়া আর তার বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা ও অবিশ্বাস্যতা অন্য সব ঘটনাকে তুচ্ছ করে দেয়। যে মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, কোনো বাঙলি আমাকে মারতে এগিয়ে আসবে না’ বা এ ধরনের কিছু, তাকেও মরতে হলো শুধু বাঙালি নয়, তার বিশ্বস্ত সহকর্মীদের হাতে। শুধু তাকে নয়।
গর্ভবতী নারী থেকে একাধিক নারী, শিশু সন্তান, সন্তান আর আত্মীয় বন্ধু, গৃহকর্মী- সবাইকে একে একে নৃশংস গুলির সামনে লুটিয়ে পড়তে হলো, এই দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। জানি না, জেলখানায় তার সহকর্মীদের হত্যা আর মিরপুরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা দেখানো হলো না কেন? সম্ভবত একই ধরনের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হতো বলে?
এই উপমহাদেশে একই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি ঘটল। নিরস্ত্র মানুষকে মারছে মানুষ, কখনো তার অতি ‘বিশ্বস্ত’ অনুচররা। গান্ধীজি, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিব। এর মধ্যে শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রাণ গেল তার স্ত্রী-পুত্রদের, আরও বহু লোকের। রবীন্দ্রনাথের ‘নারীঘাতী শিশুঘাতী কুৎসিত বীভৎসা’ কথাটা বারবার মনে পড়ে।
আমি আমার বৃদ্ধ বয়সে তিন ঘণ্টা এই ছবি থেকে অন্যমনস্ক হতে পারিনি। ভারতে ও অন্যত্র, সাধারণ মানুষের জন্য কি এটিকে দেখানোর ব্যবস্থা করা যায় না?
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়