![বাজেট ও অর্থনীতি: কার লাভ কার বিপদ](uploads/2024/06/21/anu-muhammad-1718947658.jpg)
বাজেট একটি সরকারের সামগ্রিক নীতি-কাঠামোর অংশ। যেমন বাংলাদেশ সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আছে, বিভিন্ন নীতি, প্রকল্প, সিদ্ধান্ত, অগ্রাধিকার ইত্যাদির ধারাবাহিকতাতেই এ বছরের বাজেট প্রণীত হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার অনেক মেগা প্রকল্প নিয়েছে, ঋণের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে, ঋণখেলাপি আর প্রতারণার কবলে ব্যাংকিং খাত, পুঁজি পাচার অনেক বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছেই। বাছবিচারহীন অতিব্যয়ের প্রকল্প এবং অব্যাহত ডলার পাচার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি করেছে। অর্থনীতি যেভাবে চলছে তাতে বড় সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি তার একটি নমুনা। এগুলো ঘটছে সরকারের নীতিনির্ধারণী অবস্থান, প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা, কতিপয় গোষ্ঠীর প্রতি প্রশ্রয়-পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি কারণে। এ বাজেট সেই ধারাবাহিকতাই রক্ষা করছে। অর্থনীতি যেভাবে চলছে তার আইনি বৈধতা দেওয়ার জন্য বর্তমান বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। অর্থনীতির সংকটের কারণগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে ফলাফল নিয়ে কথাবার্তা চলছে। লোক দেখানো কিছু পাঠ্যপুস্তকে সমাধান দেখানো হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সংকট কমবে বলা হলেও যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেগুলোতে ফলাফল উল্টো হবে। অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাজার যেভাবে চলে তাতে আমরা জানি শুল্ক যেগুলোতে কমানো হয় যেগুলোর দাম কমবে, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। আবার শুল্ক যেগুলোতে বাড়ানো হয় সেগুলো যত পরিমাণে বাড়ানো হয়, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে দাম বাড়ে। এর কারণ কী? কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি পাঠ্যপুস্তকের বাজার অর্থনীতির নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয় না। চাহিদা ও জোগানের সূত্র দিয়ে এগুলো ব্যাখ্যা করা যাবে না। দেখতে হবে যে অর্থনীতি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে অর্থনীতি সুনির্দিষ্ট কয়েকটা গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা ইচ্ছেমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়, সরবরাহব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, জিনিসপত্রের সংকট তৈরি করে, ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করে, সম্পদ পাচার করে- তাদের কোনো সমস্যা হয় না।
এদের কারণে বাংলাদেশে চিনি, চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় বেশি। আবার বাংলাদেশের মানুষের যে বেতন বা মজুরি সেটা দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, বহু দেশের তুলনায় অনেক কম। আয় বা মজুরি অন্য দেশের তুলনায় কম আর অন্য দেশের তুলনায় জিনিসপত্রের দাম বেশি। এই হলো বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিদিনের জীবনের লড়াই।
অর্থনীতি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তার কারণে বাংলাদেশে অতি ধনী বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এর পেছনে সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ ভূমিকা রাখে। যেমন একটা উদাহরণ দিই- বাংলাদেশের গ্যাস উত্তোলনের জন্য দেশি প্রতিষ্ঠান আছে, একই সঙ্গে বিদেশি প্রতিষ্ঠানও আছে। পাশাপাশি সেই গ্যাস এলএনজি হিসেবে আমদানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ গ্যাস তোলার জন্য খরচ করে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, সেই একই পরিমাণ গ্যাস সরকার এলএনজির মাধ্যমে আমদানি করে ৩২ হাজার কোটি টাকা দিয়ে। দেশীয় মুদ্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা খরচ করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যায়, সেই পরিমাণ গ্যাস এলএনজির মাধ্যমে আমদানির জন্য খরচ হয় বিদেশি মুদ্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। খেয়াল করতে হবে প্রথমটা হলো দেশীয় মুদ্রায় আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে বিদেশি মুদ্রায়। তার মানে এত গুণ বেশি টাকায় বিদেশি মুদ্রা দিয়ে গ্যাস আনা হচ্ছে। ফলে গ্যাস-বিদ্যুৎ সবকিছুর দাম বাড়ছে, ঋণ বাড়ছে, বিদেশি মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্যাসের জন্য নাকি কয়েকটা দেশি-বিদেশি কোম্পানিকে ব্যবসা দেওয়ার জন্য, এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তার সঙ্গে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার মতো চুক্তি তো আছেই। যারা এতে লাভবান হলো তাদের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এখন সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনী। কিন্তু সেই শীর্ষ ধনী হওয়ার জন্য আমাদের গ্যাসের দাম বাড়ছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।
আইএমএফ পরামর্শ দিচ্ছে ভর্তুকি কমাতে হবে। এদিকে সরকারও খুশি হয়ে ভর্তুকি কমানোর নামে দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। কিন্তু তার মূল কারণ নিয়ে সরকার বা আইএমএফের মাথাব্যথা নেই। কারণ এ ব্যবস্থায় যারা লাভবান হচ্ছে তারা সবাই সরকারের ঘনিষ্ঠ। সে জন্য ব্যাংকিং খাত যখন সংকটে, তখন ঋণখেলাপিদের সুবিধা আরও বাড়ানো হচ্ছে। তারাই এখন দেশের নীতিনির্ধারক। আর্থিক খাতে সংকটটা কীভাবে তৈরি হচ্ছে? প্রথমত, সরাসরি জালিয়াতি করে লুটপাট করা, আরেকটা হলো ঋণ করে সেটা পরিশোধ না করা। এর বাইরে শেয়ারবাজার, মুদ্রাবাজারে নানা জালিয়াতি আছে।
বহুভাবেই ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী লুটপাট করছে। তাদের কারণে রিজার্ভে সংকট তৈরি হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, বিদেশে সম্পদ পাচার হচ্ছে। আমাদের জনগণের জীবনে সংকট বাড়ছে। গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে, ঘর ভাড়া বাড়ছে, অনিশ্চয়তা বাড়ছে, পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে অসুস্থতা বাড়ছে।
নির্দিষ্ট গোষ্ঠী যারা লাভবান হয়, তাদের লবিংয়ের কারণে একেকটা সিদ্ধান্ত হয়। দেখা যাচ্ছে যে, যে খাতে বা প্রকল্পে লবিং শক্তিশালী বা যেখানে কমিশন বেশি বা যেখানে দুর্নীতি বেশি, দেখা যাচ্ছে সেখানে কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়া তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত হচ্ছে। এসবের ফলাফল আমরা দেখতেই পাচ্ছি। অর্থনীতি আরও বড় সংকটের দিকে, সামগ্রিক চাপ জনগণের ওপর।
শিক্ষা এবং চিকিৎসা এই দুই খাত বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও অবহেলিত আছে। গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি খাতে বরাদ্দ এমনিতেই কম। দক্ষিণ এশিয়ায় তো সবচেয়ে কম বটেই, পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসা বরাদ্দ একেবারে নিচের সারিতে। এবারও দেখা গেছে যে, এই বাজেটে নিম্ন বরাদ্দ অব্যাহত আছে। আবার বরাদ্দ যতটুকু দেওয়া হচ্ছে সেই বরাদ্দ নানা রকম অপচয়, দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শিকার হচ্ছে। উপরন্তু এবারের বাজেটে চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর শুল্ক বসানো হয়েছে।
শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেই বরাদ্দ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সকল পর্যায়ে শিক্ষকসংকট। সরকার বলছে, আমরা কম্পিউটার মাল্টিমিডিয়া দিয়েছি স্কুলগুলোতে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো চালানোর লোক নেই। অনেক জায়গায় বাক্সে পড়ে আছে। তার মানে যা খরচ করা হচ্ছে তার কোনো দিশা বা দায়দায়িত্ব নেই। এ রকম ঘটনাই বেশি। অন্যদিকে খুব কম স্কুল-কলেজেই বিজ্ঞান গবেষণাগার লাইব্রেরি আছে।
অথচ অপ্রয়োজনীয় ভবন, অপ্রয়োজনীয় নির্মাণকাজে বরাদ্দ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণে। যেখানে বরাদ্দগুলো দেওয়া হয় বড় বড় ঠিকাদারের প্রভাবে, তাদের লাভ বাড়াতে। তার মানে যে বরাদ্দ আছে সেটাও অপরিকল্পিত, অযৌক্তিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিকর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাহলে শিক্ষা ও চিকিৎসা জনগণের প্রধান দুটো সেবা খাত একদিকে দিনে দিনে ব্যয়বহুল হচ্ছে, অন্যদিকে নৈরাজ্য তৈরি হচ্ছে। মানে জনগণ তার প্রাপ্য সেবা পাচ্ছে না।
কতিপয় গোষ্ঠীর অস্বাভাবিক সুবিধা আর জনগণের জন্য অতিরিক্ত বোঝা- এই পরস্পরবিরোধী বিষয় সমন্বয় করেই বাজেট করা হয়েছে। এ রকম সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাস থেকেই আসে। সে জন্য বর্তমান অর্থনীতির সংকট আসলে পুরোপুরি অর্থনীতির বিষয় নয়। অর্থনীতির বর্তমান সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে জবাবদিহিহীন, স্বচ্ছতাহীন, কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াবিহীন একটা ব্যবস্থা এবং কতিপয় গোষ্ঠীর আধিপত্য। এটি হচ্ছে বর্তমান অর্থনীতির সংকটের প্রধান কারণ। বাজেটে সেটাই অব্যাহত রাখা হয়েছে।
মানুষ তো সরকারকে নানাভাবে কর দিচ্ছে এবং এবারে কর আরও বাড়ানো হচ্ছে, ভ্যাটের সীমা অনেক সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কিন্তু একটি দেশের নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সার্ভিস পাওয়ার জন্য, নির্দিষ্ট প্রতিদান পাওয়ার জন্য কর দেওয়ার কথা। এর বিপরীতে শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, পরিবেশ সব বিষয়ে কাজ করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সব খাতেই সরকার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। উল্টো ওয়াসার পানি এখন পর্যন্ত পরিষ্কার হলো না। কিন্তু পানির দাম বেড়েই যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সন্ত্রাস-দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে, বায়ুদূষিত, শিক্ষা ও চিকিৎসায় নৈরাজ্য। তাহলে মানুষ কী কারণে কর দেবে? মানুষ তো কর দেয় তার একটা সেবা পাওয়ার জন্য। সেবা যদি না পায় তাহলে মানুষ কর দেবে কেন? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাজেট আলোচনায় এটাই এখন বড় করে তুলতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ