![স্বপ্নের ফেরিওয়ালা](uploads/2024/06/24/Messi-1719232116.jpg)
কেউ বলেন এলিয়েন, কেউবা ভিনগ্রহের ফুটবলার। বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্তুর লিওনেল মেসিকে নিয়ে বিশেষণের শেষ নেই। ক্লাব থেকে শুরু করে জাতীয় দল আর্জেন্টিনা, সবখানেই মেসির আলোকময় উপস্থিতি। কাঁড়ি কাঁড়ি গোল আরও রেকর্ডে মোড়ানো বর্ণিল ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সব শিরোপা জেতা লিওনেল মেসিকে তাই অনেকে বলেন, GOAT, গ্রেটেস্ট অব অল টাইম। আর্জেন্টিনার খুদে এই ফুটবল জাদুকরের আজ জন্মদিন। ৩৭-এ পা রাখা লিওনেল মেসিকে নিয়ে খবরের কাগজের দুই পর্বের বিশেষ আয়োজন। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
‘মেসিকে নিয়ে কিছু লিখো না। তাকে বর্ণনা করার চেষ্টাও করো না। শুধু তার খেলা দেখ এবং উপভোগ করে যাও’
-পেপ গার্দিওলা
বাঁ পায়ের জাদু। সেটা অপার্থিব নাকি মায়াবী বিভ্রম। কেউ বলে ঐশী দক্ষতা, কেউবা বলে অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা। সবুজ গালিচায় সর্পিল গতিতে তার আঁকাবাঁকা চলা মুগ্ধতার রেণু ছড়ায়। সঙ্গে ওলটপালট হয় রেকর্ড বুক। কত গোল, কত ট্রফি, কত কীর্তি, রোসারিও থেকে বার্সেলোনা, টিস্যু পেপারে সাইন করা থেকে ভুবন মাতানো এক ফুটবলার- লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপের আগে পর্যন্তও মেসির নামের পাশে ছিল নানা বিশেষণ। কিন্তু সবই ছিল অর্থহীন। সর্বকালের সেরার প্রশ্নে গুটিয়ে যেত তর্কে জড়ানো মেসি ভক্তরা। কারণ মেসির শোকেসে ছিল না আকাশি-নীল জার্সিতে একটি সোনালি ট্রফি। মেসির মনের উঠোনজুড়ে তাই ছিল বিশাল অঙ্কের আঁকিবুঁকি। হিসাবটা তাই তিনি মেলালেন মরুর বুকে কাতারের ঐতিহাসিক লুসাইল স্টেডিয়ামে। ভক্তদের মনে রোমাঞ্চের কাঁপন তুলে জিতলেন পরম আরাধ্যের বিশ্বকাপ। মেসির হাতে বিশ্বকাপ দিয়ে যেন দায়মুক্ত হলো ফুটবলও।
![](../../../image/2024/June-24/Messi-Champion.jpg)
একটি বিশ্বকাপের জন্য কত হাপিত্যেশ ছিল এই মেসির, তা সবারই জানা। ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ১৯৯০, মেসির কাঁধে চড়ে ২০১৪। দুই বিশ্বকাপের ফাইনালেই জার্মান মেশিনে বিকল হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর দুবার কোপা আমেরিকার খেতাব মিস। পেনাল্টি মিসে সূর্যাস্ত। অভিমান-দুঃখে অবসরও নিয়েছিলেন মেসি। তবে শেষ সেখানেই নয়। হেরে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে যারা চ্যাম্পিয়নের সরণিতে ফিরে আসেন, তারাই প্রকৃত লিজেন্ড। মেসিও যেমন তাই। কাতার বিশ্বকাপ জিতে মেসি প্রমাণ করেছেন, তিনি ভিনগ্রহের ফুটবলার। আধুনিক ফুটবলের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।
অথচ কে জানত, ভাগ্য আরেকটু বিরূপ হলেই মেসি নামের কোনো ফুটবলারকেই হয়তো চিনত না বিশ্ব। দশ বছর বয়সে গ্রোথ হরমোনজনিত সমস্যায় ধরা পড়া মেসি ছোট্ট দুটি পায়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাব। কিন্তু উচ্চতা না বাড়লে ফুটবল খেলতে পারবে না, তা নিয়ে শঙ্কা ছিল ঢের। এই রোগের যে চিকিৎসা ব্যয়ভার তা মেটাতে পারেনি নিওয়েলস বয়েজ কিংবা আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ক্লাব রিভারপ্লেটও। কারণ প্রতি মাসে মেসির চিকিৎসার জন্য দরকার হতো ৯০০ মার্কিন ডলার। একপর্যায়ে মেসিকে নিয়ে হালই ছেড়ে দিয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু যার কপালে বিশ্বজয়ের রাজটিকা, তাকে রুখতে পারে কে! এগিয়ে আসে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা। ২০০০ সালে ঐতিহাসিক ন্যাপকিন চুক্তিতে অসামান্য এই প্রতিভাকে নিজেদের করে নেয় বার্সা। সঙ্গে মেসির চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব। বাকিটা ইতিহাস।
কিন্তু মেসির এই ঝলমলে ক্যারিয়ারের পথ-পরিক্রমা মোটেও সহজ ছিল না। এসেছে নানা বাধা-বিপত্তি। তবে লক্ষ্য অটুট থাকলে সবকিছুই সম্ভব। মেসি তা প্রমাণ করেছেন। যেখানে ভাগ্যটাও পাশে পেয়েছেন তিনি, সঙ্গে ছিল বাঁ পায়ের ঐশ্বরিক জাদু। আর হার না মানার মানসিকতা। শুনুন মেসির মুখেই, ‘আর্জেন্টিনা থেকে একটা স্বভাব আমি আমার সঙ্গে এনেছিলাম, সেটা হলো পরাজয়ের প্রতি ঘৃণা। পরাজয়; সেটা যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, আমি মানতে পারি না। এখন মনে হয়, ছোটবেলায় আমরা যখন রাস্তায় ফুটবল খেলতাম, তখন ভাই-কাজিনরা মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে হেরে যেত। তারা আমাকে জিতিয়ে দিত। কারণ জানত, আমি হেরে গেলে তাদের কপালে দুঃখ আছে। ১৩ বছর বয়সে যখন এখানে (ন্যু ক্যাম্প) খেলা শুরু করলাম, তখনো আমি হার মানতে চাইতাম না। সতীর্থরা যখন হেরে গিয়েও মেনে নিত, আমার কাছে খুব অবাক লাগত।’
মেসি নামের শব্দটি শুনলেই এখন সবার চোখে ভাসে আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর রোসারিও। শহরের দক্ষিণে ব্যারিও লাস হেরাস পাড়া। ছিমছাম সবুজেঘেরা একটি বাড়ি। কিন্তু ফুটবল খেলার জায়গার অভাব। দুই বেড়ার মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় ফুটবল নিয়ে মেতে উঠত ছোট্ট এক ছেলে। কিন্তু সেখানে জমত না খেলা। শুকনো, কাঁচা রাস্তাই ছিল ভরসা। দুই পাশে গোলপোস্টের কোনো রকম চিহ্ন এঁকে চলত ফুটবল খেলা।
![](../../../image/2024/June-24/messi-chhildhood.jpg)
মেসির বয়স যখন তিন কিংবা চার বছর, জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলেন একটি ফুটবল। যে ফুটবল জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট শিশুটির। জন্মদিন এলেই মেসি অপেক্ষা করতেন নতুন ফুটবলের জন্য। এ প্রসঙ্গে একবার মেসি বলেছিলেন, ‘খুব ছোটবেলায় আমি আমার প্রথম ফুটবলটা পেয়েছিলাম। তখন কতই-বা বয়স, তিন বা চার। কে যেন উপহার দিয়েছিল। সেদিন থেকে যেকোনো উপলক্ষে আমি একটা উপহারই চাইতাম- ফুটবল, হোক সেটা বড়দিন বা জন্মদিন। আমি ফুটবল জমাতাম। ঘরের বাইরে নিতাম না, যদি কেউ নষ্ট করে ফেলে, সেই ভয়ে।’
বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি কাজ করতেন স্টিল ফ্যাক্টরিতে। মা সেলিয়া মারিয়া পার্ট টাইম ক্লিনার। বড় দুই ভাই রদ্রিগো ও মাতিয়াস, ছোট বোন মারিয়া সল। পাঁচ বছর বয়সে মেসি স্থানীয় ক্লাব গ্র্যান্দোলির হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন। মেসির কোচ ছিলেন তার বাবা হোর্হে। এই ক্লাবের হয়ে মেসির পরিবারের অনেকেই খেলেছেন। স্মৃতি বেশ সতেজ মেসির, ‘আমার বাবা ছিলেন ক্লাবের কোচ। রবিবার সারা দিন কাটত গ্র্যান্দোলির সঙ্গে। পুরো পরিবার মিলে খেলতাম। হয়তো আমি খেলছি, বিপক্ষ দলে বড়দের মধ্যে আমার চাচাও আছেন। এভাবেই কেটে যেত সারা দিন।’
একেক দলে তখন খেলত সাতজন করে। মেসির প্রথম ম্যাচ খেলার ঘটনা সবার জানা। মেসির মুখেই শুনন তা, ‘প্রথম ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম আমার দাদির কারণে। গ্র্যান্দোলির দলে আমার মতো ছোট্ট ছেলের জায়গা ছিল না। এক দিন বড় একজনকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে দাদি আমাকে এগিয়ে দিলেন। কোচ শুরুতে রাজি ছিলেন না, পরে আপত্তি করেননি।’ ছোট্ট মেসির ড্রিবলিং দেখে সেই কোচের চোখ ছানাবড়া। চোখের নিমিষেই মেসির অসাধারণ সব কারিকুরি নজর কেড়েছিল সবার।
![](../../../image/2024/June-24/Messi-Barcelona.jpg)
কোনো ফুটবলার মেসির নায়ক ছিলেন না। তবে ভক্ত ছিলেন ম্যারাডোনার। ভবিষ্যতে কী হতে চাও, এমন প্রশ্নে ছোট্ট মেসি একবার বলেছিলেন, ‘আমি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলতে চাই, সব আর্জেন্টাইনের মতো আমিও ম্যারাডোনার ভক্ত ছিলাম। মুগ্ধ হয়ে তার খেলার ভিডিও দেখতাম, সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। পাবলো আইমার যখন প্রথম এলেন, তার খেলাও খুব ভালো লাগত। কিন্তু তারা কেউ আমার আদর্শ ছিলেন না। ভাই আর কাজিনদের সঙ্গে রাস্তায় খেলে আমি বড় হয়েছি। তাদের দেখেই শিখেছি। আমার পরিবার আমাকে বাঁচার কৌশল শিখিয়েছে, কিন্তু ফুটবলের কৌশল আমি শিখেছি নিজে নিজে।’
গ্র্যান্দোলির সঙ্গে বছর দেড়েক থাকার পর নিওয়েলসের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন মেসি। সমস্যা বাধে সেখানেই। ১১ জনের দলে আর সবার চেয়ে মেসি ছিলেন অপেক্ষাকৃত ছোট। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ফুটবল, এই ঘাটতি কখনোই মেসিকে ভাবাত না। কিন্তু খেলা শুরুর আগে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা তাকিয়ে থাকতেন, তাতে অস্বস্তি বাড়ত তার। কিন্তু খেলা শুরু হলে মেসির পায়ে বল আসার পর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেত সবার।
ঠিক কী কারণে মেসির আকৃতি ছোট। নিওয়েলস তাই মেসিকে পাঠাল ক্লিনিকে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, মেসির শরীরে একটা অবর্ধনশীল হরমোন আছে। মেসি বেড়ে উঠছিলেন, তবে স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরগতিতে। ডাক্তার বললেন, চিকিৎসা নিলে মেসি অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতো বেড়ে উঠতে পারবে। যখন চিকিৎসা শুরু হলো, মেসির বয়স বড়োজোর ১১ কি ১২। প্রায় এক বছর চিকিৎসার ব্যয় মেসির বাবা বহন করেন। মাসে ৯০০ মার্কিন ডলারের খরচ কুলিয়ে উঠতে পারেনি মেসির পরিবার। দুঃসময়ের মুখোমুখি তখন হোর্হে। তখনই এগিয়ে আসে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা। ঐতিহাসিক ন্যাপকিন চুক্তিতে নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেন মেসি। রোসারিও ছেড়ে মেসির পরিবারের নতুন ঠিকানা বার্সেলোনার ন্যু ক্যাম্প।
চলবে....