ছাগলকাণ্ড দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর আগে শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তার অবিশ্বাস্য সম্পদ, সেনাপ্রধানের ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে মানুষের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হয়েছিল। অনেকে বলেন, আমাদের স্মৃতিশক্তি নাকি খুবই কম। অনেকটা গোল্ডফিশের মতো। অ্যাকুরিয়ামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতেই ভুলে যায়। আমাদের নতুন ইস্যু এলে পুরোনো ইস্যু ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা প্রচণ্ড।
অবশ্য এ কারণেই কিছুটা সুস্থ আছি আমরা। তা না হলে রিজেন্ট সাহেদের ‘কারবার’, স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় ‘মিঠু চক্রের’ বিপুল দুর্নীতি, ক্যাসিনো সম্রাট খালেদের ক্ষমতা আর সম্পদ, নরসিংদীর পাপিয়াকাণ্ড, ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের হাজার কোটি টাকা পাচারের খবর, বালিশকাণ্ড, নানা ধরনের সরকারি ক্রয়কাণ্ড, নির্মাণকাজে লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশকাণ্ডসহ নানা কাণ্ড দেখে মানুষ পাগল হয়ে যেত। কিন্তু না, এত ভয়াবহ অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয় দেখে দেশের জনগণ আজ যেন অসাড় হয়ে গেছে। বরং মনে হয় তারা অপেক্ষায় আছে পরের খবরের জন্য।
সত্যের চেয়ে বিস্ময়কর কিছু নেই। দুর্নীতি নিয়ে সত্য কথা বললে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রথমত অস্বীকার, তারপর প্রতিবাদ এবং শেষে ষড়যন্ত্র খোঁজা হয়। কিন্তু দুর্নীতি হচ্ছে, এসব দেখেও যদি বিষয়টি অস্বীকার করা হতে থাকে তাহলে কি তাদের পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে?
কেননা দুর্নীতিকে অস্বীকার করার মানসিকতাই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য দায়ী। এ কথা সবাই মানেন যে, যেমন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হলে তার চেয়ে দেশের জন্য অগৌরবের আর কিছু হতে পারে না, তেমনি ব্যক্তি হিসেবেও দুর্নীতিবাজ কোনো সম্মানসূচক সম্বোধন নয়। তারপরও দেশে দুর্নীতি চলছে এবং ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতি করছেই। এটা তো জানা কথা- দুর্নীতি করার ক্ষমতা না থাকলে দুর্নীতি করা যায় না।
দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা এবং সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দেয়। তাই শুভবুদ্ধির মানুষ হরহামেশা বলতে থাকেন- দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দেশের বাইরে অর্থ পাচার ও চোরাচালান বন্ধ করতে হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে, সংসদে বিতর্ক ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, দেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে, দুদককে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর করতে হবে, বিচার বিভাগের সততা ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে লাখ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে, কারণ এই টাকার মালিক দেশের জনগণ। জনপ্রশাসনে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে, লুটপাটের অর্থনীতি ও রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি আমাদের সবার নজরে পড়ে, যেমন- নিয়োগ-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, সর্বশেষ অস্ত্র-বাণিজ্য বর্তমানে জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করেছে, ডলার ঘাটতি তৈরি হয়েছে আর প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে অশ্রদ্ধা তৈরি করেছে। একবার এক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে দুর্নীতি কমবে। সরকারি অফিসগুলোয় পাঁচ বছর আগে বেতন বাড়ানোর কারণে দুর্নীতি অনেক কমে গেছে।’ কিন্তু সাধারণ মানুষ তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারে না।
পত্রিকার শিরোনামগুলো পড়লে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রাটি বোঝা যায়। দুর্নীতির কথা উঠলে সরকারের মন্ত্রীরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে দুর্নীতি নেই? দুর্নীতি বিএনপি, জাতীয় পার্টির আমলেও হয়েছে। আপনারা সেসব নিয়ে কথা বলেন না। কেবল আওয়ামী লীগ আমলে কিছু ঘটলেই শোরগোল তোলেন।’ তখন আর কী করা! তবু মনে প্রশ্নটা থেকেই যায়, অতীতের দুর্নীতি কি বর্তমানের দুর্নীতিকে যুক্তিসংগত করবে?
এবার সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের দুজন সংসদ সদস্য। তাদের একজন বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে? চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর সরকারি কর্মচারীদের হলফনামা আকারে সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান করার দাবি জানান।
একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতিতে না জড়ান, সে জন্য আইন আরও কঠোর করতে পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারি দলের আরেক সংসদ সদস্য অভিযোগ করেন, সরকারি কর্মকর্তারা দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। কিন্তু দোষ হয় রাজনীতিবিদদের।
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় দুর্নীতি হয় উল্লেখ করে সংসদে বলা হয়, ‘সেখানে (উন্নয়ন ও কেনাকাটা) রাজনীতিবিদদের সুযোগ কোথায়, যদি সরকারি কর্মকর্তারা তার সঙ্গে জড়িত না থাকেন? ২০১৮ সালে জনপ্রশাসনে তথ্য এসেছিল, ১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছিল। এ রকম হাজার হাজার মতিউর (এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমান) আছেন।’
সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮ নিয়ে আবার ভাবার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে তাদের গ্রেপ্তারে অনুমতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হলে তাকে গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। এই আইন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করছে বলেও মনে করেন তিনি।
বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রে এত দ্রুততর সময়ে এবং এত সহজ উপায়ে অর্থশালী, বিত্তশালী, সম্পদশালী হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ অসম্ভবের সম্ভাবনাপূর্ণ বাংলাদেশে সেটা যে সম্ভব, সেটা তো আমরা স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎ দেখে আসছি। স্বাধীনতার পরবর্তী থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাংকে টাকা রাখা কোটিপতিদের পরিসংখ্যান থেকে একটু ধারণা পাওয়া যায়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। এরপর দুর্ভিক্ষ হলো, বিদেশিদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলো, কিন্তু সে সময়েও কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি থেমে থাকেনি। তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে কোটিপতি ছিলেন ৯৮ জন। ১০ বছর পরের হিসাবে দেখা যায় কোটিপতির সংখ্যা ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন। ২০০১ সালে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জনে।
২০০৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১৬৩ জনে। এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৫ সালে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৫১৬। এরপর ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের একটা উল্লম্ফন দেখা যায়। প্রতিবছর ৫ হাজারের বেশি সংখ্যায় কোটিপতি বাড়তে থাকে। যেমন ২০১৯ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩ হাজার ৮৩৯ জনে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০।
২০২১ সালে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬। করোনা মহামারি যেমন কোটিপতি বৃদ্ধি থামাতে পারেনি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতির সংকটেও কমেনি কোটিপতি বৃদ্ধি। ফলে সর্বশেষ ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৯০।
ব্যাংকের এই হিসাবের বাইরে কালোটাকার সমান্তরাল অর্থনীতির কথা অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন। আর এসব দেখে দেখে ইতোমধ্যে অভ্যস্ততাও গড়ে উঠেছে। কে, কীভাবে, কত দ্রুত হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি বনে গেলেন, এতে আর বিস্মিত হয় না। কেউ মনে করেন ক্ষমতার খেলা আবার অনেকেই এই হঠাৎ বিত্তবান হওয়াকে সৃষ্টিকর্তার অনুদান-কৃপাও বলে থাকেন। প্রভুর অসীম দয়ায় হঠাৎ বিত্তবানদের ভাগ্যবদলের ঘটনা ঘটেছে। বাস্তবে তারা চরম অনৈতিক ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করেই যে হঠাৎ বিত্তশালী হয়েছেন, সেই সত্যটি জানলেও কেউ বলে না।
২০২২ সালে টিআইবি তাদের এক জরিপে দেখিয়েছিল, ২০২১ সালে ১৭টি খাতের মধ্যে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (সে সময় পুলিশের আইজি বা মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ)। জরিপে ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ৭২ শতাংশ বলেছিলেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না।
টিআইবির হিসাবে সেই সময়ে দেওয়া মোট ঘুষের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এমনকি যা গত বছর উদ্বোধন হওয়া কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ খরচের চেয়েও বেশি। জনগণ ট্যাক্স দেয় উন্নয়নের জন্য আর ঘুষ দেয় সেবা পাওয়ার জন্য। তারা ঘুষ-দুর্নীতির এই ভার আর কতদিন বহন করবে?
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
[email protected]