ঢাকা ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪

‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২২ এএম
আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২২ এএম
‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল প্রসঙ্গে
মো. শাহ্‌ আলম

সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা তিনটি দাবি নিয়ে মোট ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের দাবিগুলো হলো: ১. প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, ২. সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি ও ৩. শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একমাত্র দাবি হলো প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এতদিন তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসব দাবির প্রতি সরকারের অবহেলা এবং শিক্ষকদের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কারণে তারা এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা আন্দোলনে নেমেছেন।

২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট প্রবাসী, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা- এই চারটি প্রকল্প নিয়ে সর্বজনীন পেনশন প্রকল্প যাত্রা শুরু করে। পরে সব স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে একটি নতুন স্কিম চালু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৩ মার্চ প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। 

স্কিমটি প্রত্যাহারের দাবিতে বেশ কিছু কর্মসূচি পালনের পর গত ৪ জুন প্রথম অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। এর পরও দাবির বিষয়ে সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় গত সপ্তাহে টানা তিন দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। একই দাবিতে গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটেও শিক্ষকনেতারা জোরালো বক্তব্য দেন। ১ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দেন তারা। ফলে বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক 
শিক্ষা কার্যক্রম।

গত ২০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে জানানো হয়, ২০২৪ সালের ১ জুলাই বা তার পরে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নতুন যোগদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের আওতায় আসবেন। 

‘প্রত্যয়’ স্কিমে অংশ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হবে এবং প্রতিষ্ঠানও সমপরিমাণ অর্থ দেবে। এই অর্থ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করা হবে এবং পেনশন ফান্ড গঠিত হবে। ১৭ আগস্ট ২০২৩ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন, প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা স্কিম চালু। ১৩ মার্চ ২০২৪ তারিখে এসআরও নম্বর ৪৭-আইন/২০২৪-এর মাধ্যমে ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রণয়ন।

‘প্রত্যয়’ স্কিমের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ 

১. কর রেয়াত: মাসিক জমার বিপরীতে কর রেয়াত ও পেনশন আয়করমুক্ত।

২. নমিনির পেনশন: ৭৫ বছরের আগে পেনশনারের মৃত্যু হলে নমিনি অবশিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত মাসিক পেনশন পাবেন।

৩. মাসিক চাঁদা: কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের মাসিক চাঁদা পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে।

৪. ইএফটি (EFT): পেনশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেনশনারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে।

৫. মৃত্যুকালীন ফেরত: পেনশনযোগ্য বয়সের আগে মৃত্যু হলে জমাকৃত অর্থ নমিনি বা নমিনিদের এককালীন ফেরত।

৬. বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ: ১ জুলাই ২০২৪ থেকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীর বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ।

৭. বর্তমান কর্মচারীর অংশগ্রহণ: ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ১০ বছরের বেশি চাকরির মেয়াদ থাকা বর্তমান কর্মচারীদের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণ।

৮. চাঁদার পরিমাণ: মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা কর্তন ও সমপরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদান।

৯. আজীবন পেনশন: পেনশনার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন।

‘প্রত্যয়’ স্কিমের আওতায় রয়েছে: বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, আইডিআরএ, আইসিবি, সব রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংক, সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ বিমা করপোরেশনসহ সব করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, ইপিবি, বিএসটিআইসহ প্রায় ৪০০ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। পদ্মা অয়েল, যমুনা অয়েলসহ সরকারের হাতে ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিকানা থাকা কোম্পানিগুলোর নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আর বিদ্যমান নিয়মে পেনশন পাবেন না।

‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে সংশয়

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একই নিয়মে পেনশন প্রাপ্য হলেও তাদের সেই সুবিধা থেকে বের করে ‘প্রত্যয়’ স্কিমে যুক্ত করাকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ষড়যন্ত্র মনে করা হচ্ছে। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অনেকেই বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা স্কিম এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ অন্যদের জন্য আলাদা কেন হবে? এতদিন তো একই ধারায় চলে আসছিল, তাহলে এখন হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এই আলাদা স্কিমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘ষড়যন্ত্র’ মনে করছেন। অশান্ত হলে সরকারবিরোধীদের জন্য সুযোগ তৈরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

২০১৫ সালে শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক পে-স্কেল কার্যকর করার পর এবার ‘প্রত্যয়’ নামক আরেকটি বৈষম্যমূলক পেনশনব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেখিয়েছেন, কীভাবে নতুন পেনশনব্যবস্থা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং শিক্ষকদের সুবিধা কমিয়ে দেয়। 

এই পেনশনব্যবস্থা শুধু আর্থিক দিক থেকে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য নয়, এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও বৈষম্যমূলক। কারণ, একই স্কেলে একই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন নিয়ে শিক্ষকদের আলাদাভাবে পেনশন দেওয়া উচিত নয়। বরং শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিত অন্যদের চেয়ে বেশি এবং আলাদা।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত সংস্থায় যারা ১ জুলাই থেকে নতুন চাকরিতে যোগ দেবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ‘প্রত্যয়’ পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দিতে হবে। এসব সংস্থার নতুন চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর প্রচলিত পদ্ধতিতে পেনশন পাবেন না। এই নিয়মের সঙ্গে একমত হতে না পেরে শিক্ষকরা কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছেন। 

তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় ১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী গত সোমবার থেকে শিক্ষকরা কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন এবং সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলছে। কারণ, এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য।

আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, এই নিয়মের ফলে ভালো শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নতুন নিয়োগের ফলে আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই স্কিমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ‘বৈষম্যমূলক’ বলে উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবি করেছেন।

অভিভাবকদের শিক্ষকদের কাছ থেকে আকাশসম প্রত্যাশা থাকে এবং একজন আদর্শ শিক্ষক তার সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেন। আদর্শ শিক্ষক মানবসৃষ্টির শৈল্পিক কারিগর, যার দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। তার মান, মর্যাদা ও সম্মান সর্বব্যাপী এবং সবার শীর্ষে থাকার কথা। উল্টো তাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে আপনি কীভাবে আশা করছেন আপনার সন্তান সঠিকভাবে মানুষ হবে। আজকে কী কারণে জাতি গড়ার কারিগররা রাস্তায় মিটিং-মিছিল করছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার জন্য এটি লজ্জার ও অপমানের। 

তাই বলব, শিক্ষকরা আমাদের সমাজ ও জাতির মূল স্তম্ভ, তাদের সঠিক মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। শিক্ষকরা যে ধোয়া তুলসী পাতা, তা দাবি করছি না। আমাদের ভুল থাকলে রাষ্ট্রের উচিত তা শুধরে নেওয়া, আমাদের রুটি-রুজির ওপর আঘাত করা নয়। 

প্রত্যয় স্কিম নিয়ে অচলাবস্থার সমাধানে কিছু কার্যকর পরামর্শ হতে পারে-

১. সংলাপ ও পরামর্শ সভা: শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে সংলাপ: শিক্ষকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বৈঠক করা উচিত, যাতে তাদের উদ্বেগ ও প্রস্তাবনা সরাসরি শোনা ও সমাধান করা যায়।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ: পেনশন এবং আর্থিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে শিক্ষকদের জন্য একটি সুষম ও ন্যায্য স্কিম প্রণয়ন করা উচিত।

২. সমন্বিত পেনশনব্যবস্থা: মিশ্র পেনশনব্যবস্থা: শিক্ষকদের জন্য একটি মিশ্র পেনশনব্যবস্থা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা সরকারি কর্মকর্তাদের মতোই সুবিধা দেয় এবং একই সঙ্গে প্রত্যয় স্কিমের কিছু ইতিবাচক দিকও অন্তর্ভুক্ত করে।
স্বতন্ত্র পেনশন স্কিম: শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি পেনশন স্কিম তৈরি করা যেতে পারে, যা তাদের কাজের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী বিশেষ সুবিধা প্রদান করে।

৩. প্রয়োজনীয় সমন্বয়: নিয়ম ও শর্তাবলি পর্যালোচনা: শিক্ষকদের জন্য প্রণীত পেনশন স্কিমের নিয়ম ও শর্তাবলি পর্যালোচনা করে তার মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা উচিত, যাতে তারা সুবিধাবঞ্চিত না হন।
সুবিধা বৃদ্ধি: নতুন পেনশন স্কিমে শিক্ষকদের জন্য আর্থিক সুবিধা এবং অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি করা উচিত।

৪. শিক্ষকদের ভূমিকা ও মর্যাদার স্বীকৃতি: শিক্ষকদের গুরুত্ব: শিক্ষকদের গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝে তাদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
উৎসাহ ও প্রণোদনা: শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে তারা তাদের পেশায় আরও উৎসাহিত হন।

৫. সময়সূচি নির্ধারণ: সময়সীমা: সমস্যা সমাধানের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা উচিত, যাতে দ্রুত সমাধান সম্ভব হয় এবং শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে যেতে পারেন খুব দ্রুত সময়ে।

কার্যকর পর্যবেক্ষণ: প্রক্রিয়ার কার্যকর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করার জন্য একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেনশন নীতি শুধু আর্থিক দিক থেকে নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও সমতামূলক হওয়া উচিত। এক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে একই স্কেলে কাজ করা ব্যক্তিদের পেনশন অসম হওয়া অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক। 

বরং শিক্ষকদের বেতন ও পেনশন হতে হবে বিশেষ এবং যথাযথভাবে সম্মানজনক, কারণ তারা সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাদের অবদানের যথাযোগ্য মূল্যায়ন এবং সম্মান দেওয়া প্রয়োজন, যা প্রাপ্ত পেনশনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। শিক্ষকদের পেনশন পদ্ধতিতে একটি পরিবর্তন আনতে হবে এবং এই পরিবর্তনটি হওয়া উচিত একটি উন্নত এবং আপগ্রেডেড পদ্ধতির মাধ্যমে। যাতে করে শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম এবং সমাজে তাদের অবদানের যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়।

সরকার এবং শিক্ষক উভয়ের মধ্যে সঠিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে ‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে অচলাবস্থা সমাধান করা সম্ভব হবে। মনে রাখবেন আগামী প্রজন্মকে সঠিকভাবে যুগোপযোগী মানুষ বানাতে হলে শিক্ষকদের রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে হবে এবং তাদের সুপার গ্রেডে উন্নীত করা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। মনে রাখবেন, মহান জাতি গঠনের কারিগর এই শিক্ষকরা রাষ্ট্রের কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। তার পরও এই শিক্ষকসমাজ কেন বৈষম্যের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে বারবার?
 
লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, আইআইইউএম, মালয়েশিয়া

সমষ্টিগতভাবে দেশ এগোচ্ছে কি?

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১১:০৮ এএম
আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১১:০৮ এএম
সমষ্টিগতভাবে দেশ এগোচ্ছে কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমার শৈশবের সুখস্মৃতিগুলোর একটি হচ্ছে আঁড়িয়ল বিলে নৌকা ভ্রমণ। বর্ষায় পানি থইথই করত। সে বয়সে সমুদ্র দেখিনি, কিন্তু আমাদের টইটম্বুর আঁড়িয়ল বিলকে দেখে মনে হতো সমুদ্র দেখতে পাচ্ছি। শরৎকালে পানি কিছু কমত, সেটাই ছিল বেড়ানোর কাল। নৌকায় চেপে পরিবারের সবাই মিলে রওনা হতাম নানাবাড়িতে, বিলের পথে। তখন নীরব কর্তৃত্ব ছিল আমার মায়ের। পিতা থাকতেন, সর্বদা তিনিই প্রধান; কিন্তু নৌকা ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত সময়টাতে মা হয়ে উঠতেন কর্তা। খাবার-দাবারের আয়োজন, আত্মীয়দের জন্য উপহার সংগ্রহ, সহযাত্রীদের ভালোমন্দের তত্ত্বাবধান, সবকিছু মিলে চলত তার বিশেষ সংসারিত্ব। 

না, জীবনের ওই দিনগুলোকে আদর্শায়িত করব না। অভাব ছিল, আয়োজন ছিল অকিঞ্চিৎকর। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার নামত ঝুপ করে, চাঁদনি রাতেও চারপাশের গাছপালায় ভূতের ছায়া কল্পনা করে গা ছমছম করত, কিন্তু প্রাণ ছিল। উগ্র নয়, শান্ত। ওই প্রাণ বিশেষভাবেই সজীব হয়ে উঠত বর্ষা শুরু হলেই। আকাশ থেকে বর্ষণ, মাটিতে পানির ছোটাছুটি। খাল উপচে পানি এসে পড়ত পুকুরে, চলে যেত ধানের খেতে, মিলত গিয়ে বিলের সঙ্গে। ওই সজীবতাটা ভালো লাগত; কিন্তু ভয়ও পেতাম। 

অন্ধকারকে তো অবশ্যই, ভয় পেতাম এমনকি আঁড়িয়ল বিলকেও, তার বিশালতার জন্য। রাত হয়ে গেলে বিলের মাঝিরাও ভয় পেত দিক হারিয়ে ফেলবে ভেবে।

ভয় মানুষের নিত্যসঙ্গী। এখন গ্রামে গেলে দেখি অবিশ্বাস্য রকমের উন্নতি ঘটেছে। শহর চলে এসেছে গ্রামের ভেতর। বাসে, অটোরিকশায় যাতায়াত, বিদ্যুৎ, সিলিন্ডারের গ্যাস, দোকানে শহরের পণ্য, ঘরে ঘরে শহুরে চ্যানেল, সবকিছুর চমৎকার সমারোহ। ভালো লাগে কিন্তু ভয়ও পাই। ভয় পাই পানির অভাব দেখে। খাল রূপ নিয়েছে এবড়োখেবড়ো পথের, বাড়ির সামনের পুকুরটা মৃতপ্রায়, অদূরে আঁড়িয়ল বিল কোনোমতে টিকে আছে (বহুবিধ আক্রমণ সহ্য করে) পানি তো প্রাণ। সজীবতা না থাকলে উন্নতি তো ভীতিকর। 

পারিবারিকভাবে গ্রামে আমরা ধারাবাহিকভাবে থাকতে পারিনি। তবে মনে পড়ে তিনবার কাটাতে হয়েছে বেশ কিছু সময়, তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। প্রথমটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয়টি সাতচল্লিশের দেশভাগ, তৃতীয়টি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওই তিন ঘটনাপ্রবাহে আমরা গ্রামে চলে এসেছি, গ্রাম আমাদের আশ্রয় দিয়েছে মা-খালার মতো। চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে যখন বিশ্বব্যাপী এক যুদ্ধ চলছিল, তখন কলকাতায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল জাপানি বোমার। ভয় পেয়ে মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে। 

আমার পিতাও এসেছিলেন গ্রামে, পরিবারকে সেখানে রেখে চলে গেছেন তার স্থানান্তরিত কর্মস্থল রাজশাহীতে। তখন আমি শিশু, সেটাই আমার প্রথম গ্রামকে দেখা। আঁড়িয়ল বিল দেখলাম, প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম, সাঁতার কাটা শিখলাম পুকুরে। কিছুদিন পরে রাজশাহীতে চলে যাওয়া। কয়েক বছর পরে আবার ফিরে আসতে হয়েছিল গ্রামের আশ্রয়ে। সাতচল্লিশ সালে, দেশভাগের কারণে। তখন স্বপ্নের মায়াবী ঘোর মানুষের চোখেমুখে। 

বিষয়টি নিয়ে আমার বাবার সঙ্গে কথা হয়নি, কিন্তু নিশ্চয়ই তিনি আশা করতেন বুড়িগঙ্গার ওপরে দু-তিনটি ব্রিজ হবে, গ্রামের সঙ্গে নতুন রাজধানী ঢাকার যোগাযোগটা হবে সহজ, যেমনটা কলকাতায় ছিল তার আশপাশের এলাকার সঙ্গে। হয়তো ভাবতেন অবসর জীবনটা গ্রামেই কাটাবেন, স্বাভাবিক পরিবেশে। ওই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আশা নেই দেখে শেষমেশ তিনি ছোট একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন পুরান ঢাকায়, নাম দিয়েছিলেন শেল্টার, আশ্রয়। 

একাত্তরে তিনি জীবিত ছিলেন না, থাকলে দেখতেন পিলখানার কাছে ওই শেল্টারটা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। আমার মা টের পেয়েছেন, তিনি প্রথম ধাক্কাতেই ঢাকা ছেড়েছেন, সন্তানসন্তুতি নিয়ে। ওই বিপদে কর্তা তিনিই, রওনা দিয়েছেন অনেকটা সেভাবেই, যেভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে আঁড়িয়ল বিল পাড়ি দিয়ে নৌকায় করে আমাদের নানাবাড়িতে যেতেন, সংসারকে সঙ্গে নিয়ে। 

আমি তখন নানা ঠিকানায় থাকি, গ্রামেও এসেছিলাম একপর্যায়ে। দেখি অনেকেই এসেছেন। পাকিস্তানের তেইশ বছরে এরা কিছু কিছু উন্নতি করেছেন, এবার ভাবছেন প্রয়োজনে গ্রামেই থাকবেন অনেক দিন। বাড়িঘর গোছাচ্ছেন, জমিজমার খোঁজখবর নিচ্ছেন, পুকুরটাকে নিচ্ছেন সংস্কার করে, ফলবান গাছ কোথায় কয়টা আছে হিসাব কষছেন। বিপদের ছায়ার নিচে নতুন জীবন গড়বার আশা। ওই চিন্তায় আমরা যে যোগ দিইনি এমন নয়। দিয়েছি। 

কিন্তু ষোলোই ডিসেম্বরের পরে দেখা গেল কোথায়, কী, সবাই পড়ি তো মরি করে ছুটেছেন, কার আগে কে গিয়ে পৌঁছবেন শহরে। তবে একাত্তরের পরের গ্রাম তো আগের মতো নেই। থাকা সম্ভব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের ছেলেরা কোনো না কোনোভাবে অংশ নিয়েছে। মেয়েরাও জড়িয়ে গেছে মনেপ্রাণে। যুদ্ধ শেষে যুবকরা গ্রামেই রইল। ভাবল গ্রামকে উন্নত করবে। কিন্তু গ্রামকে তো আলাদা করে গড়া সম্ভব নয়, শহরের সাহায্য ছাড়া। তা ছাড়া তাদের জন্য তো পথও জানা ছিল না। দেশে এখন ছেলেদের সুবিধা হয়েছে, মেয়েদের আরও বেশি; তারা গ্রামে থেকেই গ্র্যাজুয়েশন করতে পারছে। 

মেয়েদের উৎসাহই অধিক। ছেলেরা তবু ঝরে পড়ে। মেয়েরা টিকে থাকে। ঝড়-বাদলে ছাতা মাথায় কলেজে যায়। খরার সময়েও দমে না। কেউ কেউ সাইকেল পর্যন্ত চালায়। ছেলেদের জন্য সুযোগ এল চাকরি করতে বিদেশে যাওয়ার। সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। কত যুবক চলে গেছে বিদেশে। কষ্ট করছে, ভয়াবহ কষ্ট, কিন্তু টাকা পাঠাচ্ছে দেশে। সেই টাকায় বাড়িঘরের চেহারা ফিরেছে, ভাইবোনরা পড়াশোনা করছে, দোকানপাট হয়েছে, জামাকাপড় আগের মতো মলিন নয়। উন্নতি দৃশ্যমান। 

দেখে ভালো লাগে, কিন্তু ভয়ও হয়। ভয় হয় এটা ভেবে যে, এই উন্নতির ভেতরে প্রাণের প্রাচুর্য নেই। পানির অভাব। পানি তো কেবল জীবনের রক্ষক ও প্রতীক নয়, পানি সামাজিক যোগাযোগ ও পারস্পরিক সহানুভূতির রূপক। পানির প্রবাহ যদি স্বাভাবিক না থাকে, সেখানে যদি দেখা দেয় খরা ও প্লাবন, তাহলে সেটা তো বিপদের ইশারা। মানবিক বিপর্যয়েরও। প্রকৃতি যেমন পানি চায় মানুষও তেমনি চায় যোগাযোগ ও সহানুভূতি। 

উন্নতি হচ্ছে কিন্তু মানুষের জীবন যে স্বাভাবিক থাকবে তেমনটা ঘটছে না। মেয়েরা পড়াশোনা করে মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু তারপর? তারা আটকা পড়ে যাবে। বাইরে তাদের জন্য কাজের ক্ষেত্র কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিস্তৃত নয়। পথে বের হলে বেকার যুবকরা তাদের উত্ত্যক্ত করে। অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে, ঘটনা জানা আছে আমাদের। বাবা-মা অস্থির হন মেয়েটিকে বিয়ে দিতে। বিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যান। মেয়েদের অগ্রযাত্রার সীমানা এর বেশি প্রসারিত হয় না। 

ছেলেরাই-বা কী করবে? তাদেরও তো কোনো কাজ নেই করার মতো। চ্যালেঞ্জ নেই সামনে। বুঝতে পারে তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। বড় ভাই টাকা পাঠায়, ছোট ভাই খরচ করে। এরা বাইরে কী করবে? কী আছে করার? টাকা খরচ একটা ক্ষমতা বটে; কিন্তু তাতে আর কতটা সন্তোষ? কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতা খোঁজে, নেতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্ষমতা দেখায়। কেউবা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, সেটাও ক্ষমতার একটা প্রদর্শন বটে। কাউকে নেশায় পায়। 

সেখানেও ক্ষমতা রয়েছে, নিষেধ অমান্য করার। অনেকে ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। সবাইকে মনে হয় বিষণ্ন, কম আর বেশি। দোষ যুবকদের নয়, দোষ ব্যবস্থার। ধারাবাহিকভাবে উন্নতি ঘটছে, কিন্তু সে উন্নতি তালগাছের মতো খাড়াখাড়ি ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, নদীর মতো ভূমিতে বিস্তৃত হয়ে উর্বরতা তৈরি করছে না। এ উন্নতি মানবিক নয়। সামাজিকও নয়; নিতান্ত ব্যক্তিগত বটে। যে আদর্শ দ্বারা এটি পরিচালিত তার নাম পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদই আমাদের প্রধান শত্রু। 

আমরা মুক্তির জন্য লড়েছিলাম। আজকের বা গতকালের নয়, দীর্ঘদিনের সংগ্রাম সেটা। সেই সংগ্রামে আমরা জয়ী হয়েছি ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছি, কিন্তু আসলে জয়ী হয়েছে পুঁজিবাদ। দৈত্যটি মুক্ত হয়ে আমাদের প্রাণের ওপর আঘাত হানছে। 

দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা ভাবেন তাদের কর্তব্য হলো মানুষ যাতে সামাজিক হয় সেটা দেখা। সে জন্য কর্মের সংস্থান প্রয়োজন। কাজ না থাকলে কৃষক শহরে ছোটে কুলি-মজুর হওয়ার জন্য, যুবক পরিণত হয় বখাটে ও মস্তানে। কাজের জন্য বিনিয়োগ দরকার কৃষিতে, কুটির শিল্পে, মৎস্য চাষে, বনায়নে এবং বড় শিল্পে তো অবশ্যই। কিন্তু সেটা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না, কারণ যারা ধন সংগ্রহ করেছে তাদের সিংহভাগই বিনিয়োগ বোঝে না। প্রায় সবকিছু হয়ে আছে একটা বৃত্তবন্দি। 

বৃত্ত অনেক সম্ভাবনা ধ্বংস করে দিচ্ছে। বৃত্ত ভাবুক। এই বৃত্তটাকে ভাঙা দরকার। কাজটা অবশ্যই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। ইতোমধ্যে আমরা যা করতে পারি তা হলো মানুষের ভেতর সাংস্কৃতিক সচেতনতা ও প্রাণবন্ততা তৈরি করা। গ্রামে পাঠাগার দরকার, প্রয়োজন সমিতি গড়ে তোলার। সমিতি আয়োজন করবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ও প্রতিযোগিতার এবং সেই সঙ্গে খেলাধুলার। বিতর্ক, নাটক, গান, ছবি আঁকা, আবৃত্তি সবকিছুর আয়োজন চাই। নিয়মিত ও ধারাবাহিক আয়োজন। 

শহর এখন বসবাসের জন্য অনুকূল স্থান নয়। ঢাকা শহর তো পৃথিবীর মধ্যে নিকৃষ্টতমদের একটি। যারা অবসর নিয়েছেন তারা অনেকেই ভাবেন গ্রামে ফিরে যাওয়া ভালো, কিন্তু একাকী তো থাকা সম্ভব নয়, প্রয়োজন সমষ্টিগত উদ্যোগ। যারা শহরে থাকতে বাধ্য হন তারাও অবকাশে গ্রামে আসতে চান। বিদেশে বসবাসকারীরাও স্বপ্ন দেখেন গ্রামে গিয়ে সময় কাটানোর। গ্রামকে তাই সামাজিকভাবে উন্নত করা দরকার। 

আবারও বলতে হয় যে, তার জন্য সমষ্টিগত উদ্যোগ আবশ্যক, কিন্তু সে উদ্যোগ খুব বেশি দূর এগোবে না মূল শত্রুকে যদি চিহ্নিত করতে না পারি। শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ। আমাদের সব উদ্যোগের কেন্দ্রে থাকা দরকার এই উপলব্ধি যে, পুঁজিবাদ হচ্ছে সেই দৈত্য, যে আমাদের আত্মস্বার্থমগ্ন, পরস্পরবিচ্ছিন্ন এবং ভোগবাদী করছে। আমাদের হওয়া দরকার সামাজিক। অতীতের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোতে ওই সামাজিকতাটা ছিল। 

সেসব আন্দোলন আমাদের একত্র করেছে, মিত্র করেছে পরস্পরের, ঐক্যবদ্ধ করেছে শত্রুর বিরুদ্ধে। শত্রু হিসেবে সামনে এসেছে ব্যক্তি, দল ও বাহিনী, পেছনে চালকের আসনে কিন্তু ছিল পুঁজিবাদী দৈত্য। যাকে পরাভূত করা দূরের কথা, সঠিকভাবে চিহ্নিত করতেই পারিনি। ভয় ওই ভ্রান্তিতেই। বর্ষাকালে আঁড়িয়ল বিলের মাঝিরা রাত্রির অন্ধকারকে ভয় পেত পথ হারাবে বলে। এখন আমরা ফুটফুটে আলোর মধ্যে আছি, কিন্তু অগ্রগতির পথটা যে জানি তার প্রমাণ তো দিতে পারছি না। 

অগ্রগতির আসল অর্থটা হচ্ছে সমষ্টিগতভাবে এগোনো। একজনের অগ্রগতি যদি হয় বাকি নয়জনকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার, তাহলে তো এগোনো হলো না। পেছনের লোক তো টেনে ধরবে অগ্রবর্তীকে এবং সেটা যে করছে না তাও নয়। আমরা চলছি ঠিকই কিন্তু এগোচ্ছি কি?
 

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঘুমকাণ্ড এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাস্তবতা

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১১:০৩ এএম
আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১১:১১ এএম
ঘুমকাণ্ড এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাস্তবতা
রেজানুর রহমান

আপনি যদি ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চান সেটাও সম্ভব। এই দেশে কত কিছুই তো ঘটছে। সবকিছু নিয়ে কি আলোচনা হয়? আলোচনা হলেও সব ঘটনারই কি আদৌ কোনো বিচার হয়? সেখানে ঘুম নিয়ে সামান্য একটি ঘটনা কি আলোচনার দাবি রাখে? বাঁচতে হলে ভালো ঘুম দরকার। আইরিশ উপকথায় ঘুমকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এক মুখ হাসি ও লম্বা এক ঘুম সব রোগের সেরা ওষুধ। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন, আমি ঘুমাতে ভালোবাসি। 

কেননা জেগে থাকলে জীবনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকে। হোমার বলেছেন, কিছু কথা বলার কিছু সময় থাকে। ঠিক তেমনি ঘুমেরও থাকে। চিকিৎসকদের মতে, প্রতি রাতে ছয় ঘণ্টার ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ঘুমের এত উপকারিতা। সেখানে আমাদের ক্রিকেট দলের সহ-অধিনায়ক তাসকিনের ঘুমকাণ্ড নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তার কি কোনো প্রয়োজন আছে? তাসকিন যদি বলেন, আরে ভাই, আমি তো ঘুমিয়েছি, কারও তো কোনো ক্ষতি করিনি। কাজেই সামান্য ঘুম নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন? এই ছোট্ট প্রশ্নেরও একটি বিশাল উত্তর আছে। তার আগে আসুন জেনে নিই তাসকিনের ঘুম নিয়ে কেন এত কথা বলা হচ্ছে?

তাসকিন কে? সহজ উত্তর বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সহ-অধিনায়ক। সাংগঠনিক দিক থেকে ভালো খেলার পাশাপাশি অনেক দায়িত্ব তার। নিজের পারফরম্যান্স ঠিক রেখে দলের বিভিন্ন কাজে ক্যাপ্টেনকে সহযোগিতা করা তার কাজ। বিশেষ করে দল যখন দেশের বাইরে বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্ট খেলতে যায়, তখন দলের সদস্য, কোচ, ক্যাপ্টেন, সহ-ক্যাপ্টেনসহ সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কখন ঘুম থেকে উঠতে হবে, কখন অনুশীলনে যেতে হবে, কখন টিম বাসে উঠতে হবে- সব ক্ষেত্রেই একটা নিয়ম মানতে হয়। এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন, সহ-ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব অনেক। 

অথচ তারাই যদি উদাসীন থাকেন, তাহলে কাজের কাজ তো কিছুই হবে না। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে তাসকিনের ঘুমকাণ্ড অন্যতম। বাংলাদেশ দল সুপার এইটে ওঠার পর ভারতের সঙ্গে খেলার দিন দলের সদস্যরা টিম বাসে ওঠার সময় খেয়াল করেন তাসকিন নেই। তাকে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাসকিনকে ছাড়াই বাধ্য হয়ে দলের সব সদস্য টিম বাসে উঠে মাঠে চলে যান। 

তাসকিনকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একজনকে হোটেলে রাখা হয়। পরে তার সঙ্গে তাসকিন পৃথকভাবে মাঠে উপস্থিত হন। খেলা শুরুর আগে জাতীয় সংগীত পর্বে তাসকিনকে দেখা গেলেও প্রধান কোচ হাথুরু সিংহ তাকে মাঠে নামার অনুমতি দেননি। প্রধান কোচ একজন খেলোয়াড়কে তার অপরাধের জন্য এমন শাস্তি দিতেই পারেন। কিন্তু ঘটনাটা কেন ঘটল? এ ক্ষেত্রে তাসকিন ছাড়া অন্য কারও দায় আছে কি না, এই প্রশ্নের জবাব কি আদৌ মিলেছে? 

ক্রিকেট পরাশক্তি ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। টেনশনে তো রাতে ভালো ঘুম হওয়ারই কথা নয়। তাসকিনের ঘুম হয়েছে এটা ভালো লক্ষণ। ভাবটা এমন ভারতকে আমরা ডরাই নাকি? কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার তো কোনো মিল পাওয়া গেল না। তাসকিন এমন ঘুম ঘুমালেন পরের দিন যে মাঠে ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে হবে সে কথা তার মনেই ছিল না। এই যে তাসকিন ঘুমকাণ্ড ঘটিয়ে টিম বাস মিস করলেন এ জন্য অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া দরকার। 

তার আগে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াও জরুরি। দলের খেলোয়াড়রা যাতে সঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠতে পারেন, সঠিক সময়ে নাশতা খেয়ে অনুশীলনে যেতে পারেন, সঠিক সময়ে দুপুর এবং রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে পারেন, এসব দেখার জন্য নিশ্চয়ই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন তাসকিনকে কোনো পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তার উচিত ছিল হোটেলের নির্ধারিত রুমে গিয়ে তাসকিনের খোঁজ করা। এই দায়িত্ব কি তিনি পালন করেছেন? ক্যাপ্টেনেরও তো এ ব্যাপারে দায়িত্ব ছিল? প্রধান কোচও কি এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়াতে পারবেন? 

তাসকিনের ঘুমকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে ঘিরে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে নিয়ম না মানার সংস্কৃতি বেশ প্রকট। ভারতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রকাশ্যে নিয়ম না মানার সংস্কৃতি চালু হয়। যার প্রভাব এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাপক ভরাডুবি হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কারও কোনো শাস্তি হয়নি। 

দায়ীদের সতর্ক করে দেওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দলের মধ্যে কারও কারও ক্ষেত্রে অহমিকাবোধ জাগ্রত হয়েছে। ভাবটাই এমন- আমাকে ছাড়া দল চলবে না। কাজেই আমি যতই দোষ করি, অনিয়ম করি দলে আমার জায়গা ঠিক থাকবেই। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। 

কারও কারও ইগোকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে যোগ্যদের অনেকে জাতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন না। টপ অর্ডারের ব্যর্থতা জেনেও সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপ খেলতে যায়। একই কারণে মেহেদী হাসান মিরাজের মতো নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় দল থেকে বাদ পড়েন। তামিম ইকবালের মতো বিশ্বসেরা ক্রিকেটার দলে সুযোগ পান না। 

প্রসঙ্গক্রমে আমার এক ক্রিকেটভক্ত বন্ধু জানতে চাইলেন তাসকিন যে অপরাধ করেছেন, তার চেয়ে তামিম ইকবালের অপরাধের মাত্রা কি বড়? টপ অর্ডারের ব্যর্থতা জেনেও কেন মেহেদী হাসান মিরাজকে দলে নেওয়া হলো না। সুপার এইটে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের লড়াইয়ের সময় মাঠে দলের সদস্যদের মধ্যে সীমাহীন অস্থিরতা ও গা ছাড়া ভাব লক্ষ করা গেছে। দলের অন্যতম খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান শূন্য রানে আউট হয়ে একা গ্যালারিতে বসে যেভাবে দলের ভরাডুবি প্রত্যক্ষ করছিলেন, তা ছিল বেশ হতাশার। 

মাঠে সাকিবের এই ছবি ফেসবুকে আপলোড করে একজন লিখেছেন, রোম যখন পোড়ে... মাঠে বাংলাদেশের তুলনায় আফগানিস্তানের খেলোয়াড়দের দলীয় ঐক্যের দ্যুতি সবার নজর কেড়েছে। 

বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা দেশে ফিরেছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একটি সভায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বোর্ড সভাপতি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য দলের সিনিয়র সদস্যরা এবারের বিশ্বকাপে ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। কথা কি এতটুকুই? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তান পারলে বাংলাদেশ কেন পারে না? এর জবাব কার কাছে খুঁজব?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার
সম্পাদক, আনন্দ আলো

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের তাৎপর্য

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১:২৮ এএম
আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১:২৮ এএম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের তাৎপর্য
এম. হুমায়ুন কবির

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর। চীন তাদের দিক থেকে এ সফরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখবে বলেই মনে হয়। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিং পিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে ধরনের কৌশলগত সহযোগিতার ব্যাপারে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় গত ৮ বছর ধরে বাংলাদেশ এবং চীন তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমাগত সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে। 

যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালে একটা মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছবে, তাই চীনও দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে পুরোনো বিষয় যেগুলো আছে, সেগুলো ছাড়াও নতুন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষই আলাপ-আলোচনা করতে পারে এবং সে ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। যে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে অথবা আগে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করার মতো। 

চীন এবং বাংলাদেশ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চিন্তা করে। সে ক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকে আমদানি করা আয় ২৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর আর রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারের কম। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট বাংলাদেশের হয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে চীনা মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল। 

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হচ্ছে, সেই বাণিজ্য তথা লেনদেন চীনা মুদ্রায় হওয়ার একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে আগামী বৈঠকে। যদিও ইতোমধ্যে প্রাথমিক একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার পরও সরকারপ্রধান পর্যায়ে যদি আলোচনা হয় তাহলে হয়তো এটা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হতে পারে। আর একটা বিষয় হচ্ছে এসটিএ, যেটা কিনা আমরা মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বলি। বাংলাদেশ ও চীন দুই দেশের পক্ষ থেকেই এ বিষয়ে আগ্রহ দেখানো হচ্ছে। 

দুই বছর পর বাংলাদেশ যখন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হবে, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বর্তমানে আমরা চীনের বাজার থেকে যে ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাই, তখন আর তা থাকবে না। ২৬ সালের পর মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে এ দেশের বাণিজ্যকে যতটা সুসম করা যায়, সে লক্ষ্য সামনে রেখে সম্ভবত দুই দেশের নেগোসিয়েশন শুরু করার জন্য নির্দেশনা আসতে পারে। 

এটা একটা সম্ভাব্য জায়গা, ইতোমধ্যে আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মিলে খানিকটা প্রস্তুতিমূলক কাজও শুরু করেছে। সেটা যদি হয় তাহলে এটা উল্লেখযোগ্য একটা বিষয়। চীন আমাদের বড় বাণিজ্য অংশীদার। আগামী দিনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এ ধরনের চুক্তিতে বাংলাদেশ গেলে দুই পক্ষই লাভবান হবে। এ ছাড়া চীনা বাজারে আমাদের প্রবেশ করা বা চীনা বাজারের সুবিধা নেওয়া ২০২৬ সালের পর খুব একটা সম্ভব হবে না।

কাজেই একটা নতুন সম্ভাবনাময় উপাদান হিসেবে এই সরকারের সময়ে ভালো একটা সিদ্ধান্ত হয়তো আসতে পারে। আরেকটা অর্থনৈতিক বিষয় হলো, চীনের কাছ থেকে বাজেট সাপোর্ট অর্থাৎ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে টান আছে, সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে হয়তো বাজেট সাপোর্টের জন্য চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য চাওয়া হতে পারে। 

এ ছাড়া ২০১৬ সালে বিআরআইতে চীনের প্রকল্পের সঙ্গে আমরা যুক্ত হয়েছিলাম এবং এর আওতায় কিছু কিছু প্রকল্প চলমান আছে। সেগুলো কীভাবে আরও ত্বরান্বিত করা যায় বা সম্প্রসারিত করা যায়, সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে। এটা নিয়েও তারা বিচার-বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করবেন। পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলে একটা বড় ধরনের কর্মযজ্ঞ তৈরি করা যায় কি না, তাতে চীনাদের সহযোগিতা পাওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে আগ্রহ আছে।

চীন যদি রাজি হয় তাহলে এই পায়রা বন্দরকেন্দ্রিক একটা উন্নয়ন কাঠমো গড়ে উঠতে পারে এবং সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের  মধ্যে এমআরটির একটা লাইন তৈরি করার জন্য চীনের সাহায্য চাওয়া হতে পারে। এখনকার যে লাইন সেটা জাপানি সহায়তায় হয়েছে। 

চীনের সহায়তায় আরেকটি লাইন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে নেওয়া যায় কি না, সেটা হয়তো ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হবে। নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় প্রকল্প, কাজেই এই প্রকল্পে চীনের সাহায্য চাওয়া হতে পারে এবং চীন যদি সমর্থন দেয়, তাহলে এটা একটা উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনার জায়গা হিসেবে মনে করতে পারি। 

সম্প্রতি তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটছে, সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কাছ থেকে চীন একধরনের প্রকাশ্য ঘোষণা বা সমর্থন আশা করবে। বাংলাদেশ যদিও জিডিআইতে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, সেখানেও একটা প্রকাশ্য ঘোষণা আসতে পারে। সেটা যদি হয় তাহলে দুই দেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে আরও কাছাকাছি আসার একটা সুযোগ পাবে। 

আরেকটা বিষয় আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গা ইস্যু এই মুহূর্তে জটিলতার মধ্যে আটকে আছে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সামরিক সংঘাতের কারণে। এ ব্যাপারে যেহেতু চীন এবং বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক দিন ধরে এবং এখনো বাংলাদেশ মনে করে, চীন এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। 

সে ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব এই প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চীনের কাছে বাংলাদেশ একটা ঘোষণা আশা করবে এবং চীনের পক্ষ থেকে খানিকটা ঘোষণাও আসতে পারে। এর পাশাপাশি মায়ানমারের অভ্যন্তরে এখন যে সামরিক সংঘাত চলছে, এটা বাংলাদেশ ও চীনের জন্য একটা শঙ্কার কারণ এবং সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ও চীন কীভাবে কাজ করতে পারে, সেটা নিয়েও নেতারা আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। 

আগামী বছর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হবে। দুই দেশ বেশ বড় আকারে এটাকে উদযাপন করার জন্য আগ্রহী হবে। বাংলাদেশ ও চীন গত ৫০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। সেটা ব্যবসা-বাণিজ্য, সামরিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, মানুষে মানুষে যোগাযোগ, অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে। 

সেই জায়গায় চীনাদের দিক থেকে ইতোমধ্যে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন রকম সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়েছে। তারই আলোকে হয়তো আরও কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র খোলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কোন্নয়নে আরও বেশি ছাত্রছাত্রী যদি চীনা ভাষা শিখতে পারে, সেটা দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক হবে।

আরেকটা বিষয়, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে সম্প্রতি চীন কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। ফিলিপাইনের দিক থেকে মার্কিনি উপস্থিতি নিয়ে তারা চিন্তিত। সেই জায়গায় তারা হয়তো বাংলাদেশকে তাদের পাশে চাইবে এবং তাদের অবস্থানের প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন রাখার চেষ্টা করবে। এখন বাংলাদেশ সেটাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেবে কি না, দিলেও সেটা কীভাবে দেবে তা স্পষ্ট নয়।

সে ক্ষেত্রে চীন বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশের একটা সমর্থন চাইতে পারে এবং সেই জায়গায় আমাদের অবস্থান কী হবে, সেটাও ভেবে দেখার দরকার আছে। সামগ্রিক বিবেচনায় আমি মনে করি, বাংলাদেশের দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ক কূটনৈতিকভাবে বলিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরেকটু সমৃদ্ধ করার জন্য দুই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বোঝাপড়া গুরুত্বপূর্ণ। 

এখনকার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে চীনারা হয়তো চাইবে বাংলাদেশ তাদের অবস্থানকে সমর্থন করুক। যেমনটা আমরা সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় দেখেছি। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় গভীর সম্পর্ক আছে, সেটাকে পুঁজি করেই আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক জটিলতাগুলোর সমাধান করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক ক্রমাগত আরও বলিষ্ঠ হবে এবং সফরটি সফল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

চিকিৎসক দিবস

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১:২৩ এএম
আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১:২৩ এএম
চিকিৎসক দিবস
ড. পবিত্র সরকার

আজ পশ্চিম বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রীই বলা হতো) ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের একই সঙ্গে জন্মদিন ও মৃত্যুদিন। আজ ভারতের ‘চিকিৎসক দিবস’। কলকাতার একাধিক বাংলা দৈনিক আজ অসুখ-বিসুখ ডাক্তারির ওপর একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। তা শুধু বিজ্ঞাপনে নয়, চিকিৎসা-সংক্রান্ত নানা খবরে, পরামর্শে ভর্তি। এখন মানুষের সভ্যতার প্রধান অসুখগুলো ধরে ধরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের আলোচনা ও উপদেশ, আবালবৃদ্ধবনিতাকে ধরে ধরে। এবং অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ- সব পন্থারই কমবেশি স্থান দেওয়া হয়েছে। 

শুধু পশুপাখিদের চিকিৎসার ব্যাপারটা কোথাও খুঁজে পেলাম না। আমার যদিও এখন কোনো গৃহপালিত পশুপাখি নেই, তবু তাদের হয়ে আমার একটু অভিমান হলো। আচ্ছা, তারাও তো এখন মানবসংসারের অংশ, নাকি? তবে জানি না, পশুপাখিদের চিকিৎসার জন্য হয়তো অন্য কোনো ‘দিবস’ নির্দিষ্ট আছে, সেদিন এ নিয়ে আলাদা পুস্তিকা না হোক, অন্তত একটা অতিপত্র বা সাপ্লিমেন্ট বেরোবে। 

আমি এ জীবনে অনেক অসুখ-বিসুখ পেরিয়ে এসেছি, এখন অসুখ-বিসুখহীন অস্তিত্বের বা অন্তিম ‘অনস্তিত্বে’র সিংহদ্বারে উপস্থিত। প্রচুর ওষুধপত্র খেতে হয়, ইনসুলিন নিতে হয়। মাঝে মাঝেই রক্তের মাপজোখ নেওয়া, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং আরও কঠিন কঠিন নামের অনেক কিছুর পরীক্ষা করতে হয়, হৃৎপিণ্ড ঠিকঠাক চলছে কি না, তার হিসাব রাখতে হয়। 

হাঁটাচলা একটু টলমলে হয়েছে, ৮৭ পেরিয়ে ৮৮-তে তা যদি না হবে, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আর কবে হবে? লাঠি নিতে হয়নি, চারতলা পর্যন্ত সিঁড়ি দিয়ে, রেলিং ধরে ওঠানামা করতে পারি, হাঁটতে গেলে কাউকে ধরতে হয় না। এখানে-ওখানে যাওয়া ছাড়িনি। আমার অভিভাবিকা এখন আমার দুই মেয়ে। তারা বলে, ‘তুমি যদি ভাবো পারবে, তা হলে যাও, আমরা বাধা দেব না।’

এমন যে পারছি, তা মূলত আমার ডাক্তারদের জন্য। এমনিতে এ উপমহাদেশের গড় আয়ুষ্কাল বেড়েছে, তা জানি। আমার যৌবনে যা ২৭ বছরের মতো ছিল, এখন সেই গড় ৭২ বছরের মতো হয়েছে বলে শুনেছি। আমি সেই গড়ের মধ্যে যেমন পড়ি, তেমনি ব্যক্তি হিসেবেও আমার এতদূর দৌড়োবার কথা ছিল কি না সন্দেহ। আমার জন্মদাতা চলে গেছেন আটচল্লিশে, বংশে আগের প্রজন্মের পুরুষরা কেউ দীর্ঘজীবী হয়নি। আমি প্রজন্ম ব্যবধানের সওয়ার হয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছি।

আমি ওই পুস্তিকা দুটি পড়ছিলাম আজ সকালবেলায় মন দিয়ে। না, পাঠক আমাকে ইংরেজ লেখক জেরোম কে জেরোমের ‘থ্রি মেন ইন আ বোট’ বইয়ের সেই লেখকের মতো ভাববেন না, যে লাইব্রেরিতে গিয়ে ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া পড়তে শুরু করেছিল বর্ণানুক্রমে- তাতে যে রোগেরই বর্ণনা পড়ে ভাবে সেই রোগই তার হয়েছে। এক ‘হাউসমেইডস নি’ অসুখটা তার হয়নি বলে মনে হলো, তখন সে আবার ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ল- আগের সব অসুখই তার আছে বলে মনে হচ্ছে, এই বিশেষ অসুখটা তার হলো না কেন? 

আমাদের কাছে ব্যাখ্যাটা খুবই সহজ, কারণ ও অসুখটা শুধু ইংরেজবাড়িতে যেসব গৃহসহায়িকা কাজ করে, ঘর মোছবার সময় তাদের হাঁটু মেঝেতে ঠেকিয়ে ঘষে ঘষে কাজ করতে হতো, শুধু তাদেরই হতো। কিন্তু লেখক সেটা না বুঝতে পেরে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। যা-ই হোক, এই সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার তাকে দিনে খাবার পর কয়েক পেগ হুইস্কি খেতে এবং কয়েক মাইল হাঁটার নির্দেশ দেন আর ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া তার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। 

বুড়ো বয়সে লোকের মাথা ঘুলিয়ে যায়, কিন্তু আমার সম্ভবত তা যায়নি, ফলে পুস্তিকা দুটি আমি ধীরেসুস্থেই পড়লাম আর শেষ করলাম। যত অসুখ আলোচিত হয়েছে, দেহের আর মনের, তার অনেক কিছুই আমার হয়নি আর নেই, এটা কোনো অহংকার করার বিষয় নয়। আমার আশপাশের মানুষের হয়েছে, প্রিয়জনের হয়েছে, আমি তাদের আর তাদের আত্মজনদের বিষণ্ন মুখ দেখেছি, আবার মরণান্তিক অসুস্থ কারও কারও নিজের অসুখকে নিয়ে মুখে রসিকতা আর চোখে মৃত্যুঞ্জয় হাসিও দেখেছি। তারা কেউ আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, কেউ বড়- তাদের কাছে জীবনের মানে আমি খানিকটা শিখেছি। 

আর আগে যেমন বলেছি, আমার ডাক্তাররা আমাকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছেন এতটা দূর, তাতে আমার ছাড়া বাকি পৃথিবীর কোন উপকার হয়েছে কে জানে? না, প্রথম দিকে আমার যে খুব প্রাণঘাতী অসুখ হয়েছিল তা নয়, আমি সে রকম কোনো বাহাদুরি নিতেও চাই না। একটা হয়েছিল একটু বিদঘুটে অসুখ- যার না পলিপাস। 

সে বস্তুটি কী? না, নাকের ভেতরে একটা মাংসপিণ্ড তৈরি হয়ে নাকের ফুটো বন্ধ হয়ে যাওয়া। তা আমাকে ধরেছিল আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমি চৌদ্দপুরুষে ও রকম অসুখের নাম শুনিনি, আর সেটাই কিনা আমার হলো? মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছি, খেতে গিয়ে বিষম খাচ্ছি, শরীর শুকিয়ে প্যাকাটি হয়ে যাচ্ছে- এ কী রে বাবা! চল চল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বললেন এর নাম পলিপাস। কী করতে হবে, না অপারেশন। করো অপারেশন। 

কিন্তু সে এক নাছোড়বান্দা অসুখ, একবার অপারেশন হয় তো আবার গজায়। অজ্ঞান করা হলো বার পাঁচেক, অজ্ঞান না করে হলো বার তিনেক। ক্লাস এইট (১৯৫১) থেকে বিএ পরীক্ষা (১৯৫৯) পর্যন্ত। এর মধ্যে বছর তিনেক পাশাপাশি কলকাতার সবচেয়ে নামকরা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের ওষুধ খেয়েছি। তিনি প্রত্যেকবার ওষুধের পুরিয়ার প্যাকেট মা-কালী আর তার শিষ্য-প্রশিষ্যদের ছবির নিচে ঠেকিয়ে, নিজের মাথায় ঠেকিয়ে আমাকে দিতেন। কিছুতেই কিছু হয়নি। শেষে ভেলোরে আমেরিকান ডাক্তার তাকে সারায় শেষ অপারেশন করে। 

জীবনে অপারেশনের কোটা তাতেই শেষ হয়নি। ২০০০ সালে পেসমেকার বসেছে, ২০০৬ আর ২০১৭ সালে তা দুবার বদল হয়েছে। আর বদল করার সময় পাব কি না জানি না। তবু অভিযোগ করি না। আমার তো ঠাকুরদেবতা জাতীয় কোনো অবলম্বন নেই, জীবনকে বলি না যে, Why me? এত লোক থাকতে আমাকে কেন? জীবন আমাকে সব দুর্যোগ-দুর্ঘট থেকে রক্ষা করতে করতে এত দূর নিয়ে এসেছে। কত লোক আমার চেয়ে দরিদ্র জীবন পায়, অসম্পূর্ণ, অকৃতার্থ জীবন পায়। আমি অভিযোগ করার কে?

বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমার ডাক্তারদের প্রতি। আমার ‘মৃত্যু জীবনের প্রথম পাঠ’ বইটি আমি আমার ডাক্তারদের উৎসর্গ করেছি। সে উৎসর্গে একজনের নাম লিখতে পারিনি। যিনি আমার শেষ সার্টিফিকেটে সই করবেন সেই ডাক্তারের নাম। 

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

অন্যায় ও অবিচারের কাছে বিশ্ব আজ নিষ্ক্রিয় দর্শক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১:২১ এএম
আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১:২১ এএম
অন্যায় ও অবিচারের কাছে বিশ্ব আজ নিষ্ক্রিয় দর্শক
দিয়া এদ্দিন সাঈদ বামাখরামা

গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েল গাজার বিপক্ষে যুদ্ধ শুরু করেছিল। সেই যুদ্ধে প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটেছে; যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্ববাসী এ সংঘাত বন্ধ এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তি অর্জনের প্রচেষ্টা জোরদারের দাবি জানিয়েছে। যুদ্ধের ফলে মানবিক ও বৈষয়িক অনেক ক্ষতি হয়েছে, যার বেদনাদায়ক ও নেতিবাচক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

সমগ্র বিশ্ব আজ যুদ্ধবাজদের সামনে শক্তিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর বিরূপ প্রভাব বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ যুদ্ধ ইসরায়েলের দখলদারত্ব ও বর্বরতাকে উন্মোচিত করেছে। ফিলিস্তিনকে গণতন্ত্রের মরূদ্যান বলে ইসরায়েলের দাবিকে বিশ্ববাসী অস্বীকার করেছে। গাজায় নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক হত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অনেক শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের মাধ্যমে ইসরায়েলের এই মিথ্যা দাবিকে তুলে ধরা হয়েছে। 

এটা লজ্জাজনক যে, আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালিয়ে গেলেও বিশ্ববাসী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এমন বৈশ্বিক নীরবতায়ও আমরা স্পেন, নরওয়ে এবং আয়ারল্যান্ডকে ফিলিস্তিনের জন্য আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ নিতে দেখি। এই তিন ইউরোপীয় দেশের সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে। কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ভূমি অবৈধ দখল ও তাদের বাস্তুচ্যুতির কারণে বিশ্ব পরিমণ্ডলে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। 

গত নভেম্বরে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আরব-ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনের সময় প্রতিষ্ঠিত ‘আরব-ইসলামিক কমিটি’র প্রচেষ্টারও আমাদের প্রশংসা করা উচিত। এ প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি, সাহায্য বিতরণ এবং ১৯৬৭ সালের সীমান্ত আইনের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জন। 

ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা করে এমন যেকোনো শান্তি পরিকল্পনার বিরোধিতা করে ইসরায়েল সরকার। ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি সাধিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসরায়েলের রাজনৈতিক শক্তি আধিপত্যের ধারণা পরিত্যাগ করবে। গাজার এমন নৃশংস ঘটনা সত্ত্বেও প্রমাণ হয়েছে যে, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে ইসরায়েলের কাঙ্ক্ষিত সমাধান সম্ভব নয়। 

দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনের জন্য ন্যায্য এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজতে বিভিন্ন স্তরে হাত মেলানো খুবই দরকার। সহিংসতা এবং অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ প্রমাণ করছে যে, টেকসই শান্তি ছাড়া কোনো স্থিতিশীলতা আসতে পারে না। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ফিলিস্তিনিরা তাদের শক্তিকে সুসংহত করতে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য গুরুতর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। 

ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি অর্জনের জন্য দরকার সব পক্ষের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং টেকসই প্রচেষ্টা। যদিও অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তবু আন্তরিক ইচ্ছা এবং ন্যায়বিচার ও সমতার প্রতি অঙ্গীকার থাকলে এটি করা সম্ভব। 

বিশ্বের এই স্পর্শকাতর অঞ্চলে শান্তিই হলো স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র উপায়। এ বিষয়ে শান্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে- এমন দেশের কথা স্মরণ করতে পারি। যেমন সৌদি আরব; যা ইসলামি বিশ্বে অতুলনীয় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের জন্য অনেক শান্তি আলোচনায় পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমিকা রেখেছে সৌদি আরব।

সবাই বুঝতে পারছে যে, ফিলিস্তিন জনগণের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি না দিলে ইসরায়েলে কখনো শান্তি ফিরে আসবে না। আরবের শান্তি উদ্যোগের ধারাবাহিকতা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবিলম্বে গাজায় নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি বিনিময়ের মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাদের নিপীড়িত জনগণের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে। 

আমি এমন সব দেশকে আহ্বান জানাই, যারা এখনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি। এটা শান্তিকে উৎসাহিত করবে, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন অর্জনে অবদান রাখবে। ফিলিস্তিনি জনগণের কয়েক দশক ধরে চলা দুর্ভোগের অবসান ঘটাবে।

লেখক: সৌদি আরবে জিবুতির রাষ্ট্রদূত।
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল