ভারতের প্রথা অনুযায়ী নির্বাচনোত্তর রাষ্ট্রপতির ভাষণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে লোকসভা অধিবেশন। কিন্তু সংখ্যায় দুই কক্ষ এখন অচল। লোকসভার বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী এবং রাজ্যসভার নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। উভয় কক্ষে দুই নেতা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনের সময় দেশের NEET (ডাক্তারিতে ভর্তির সর্বভারতীয় পরীক্ষা) এবং NET (কলেজে চাকরি ও গবেষণার সর্বভারতীয় পরীক্ষা) প্রশ্নপত্র কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে বাজারে ফাঁস হয়ে গেছে। ফলে লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে।
নরেন্দ্র মোদির শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান প্রশ্নপত্র কালোবাজারে বিক্রির কথা স্বীকার করে যথা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। গোটা ভারত এখন এ নিয়ে তোলপাড়। লোকসভায় বিরোধী দলনেতা কাগজপত্র দেখিয়ে অভিযোগ করেছেন, মোদির গত ১০ বছর শাসনকালে ৭০ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়ে কালোবাজারে বিক্রি হয়েছে।
সোমবার লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বিরোধীরা এসব তথ্য ধরে সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। গোটা দেশে এত বড় দুর্নীতি নিয়ে এর আগে কোনো কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসেনি। এই প্রথম ভারতবর্ষের লোকসভা দেখল আরএসএস-বিজেপি গত ১০ বছরে দেশকে কোন দিকে নিয়ে গেছে।
নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবতরা আবার হিন্দুত্ববাদের স্লোগান দিয়ে আসরে নেমে পড়েছেন। এর উত্তর দিতে গিয়ে রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন, চাষিদের জমি কেড়ে নিয়ে অযোধ্যায় বিমানবন্দর বানানো হয়েছে। সে জন্য অযোধ্যার বিজেপি প্রার্থী সমাজবাদী প্রার্থীর হাতে বিপুলভাবে পরাজিত হয়েছেন।
রাহুল যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন তাকে বাধা দিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, আপনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। রাহুল তাকে বলেন, আমাদের সংবিধানে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন সবার সমান অধিকার। কয়েক দিন ধরে সংসদে রাহুলের বক্তব্য দেখে এবং শুনে বিজেপি এমপিরা একই সুরে কুৎসিত ভাষায় জওহরলাল নেহরুকে আক্রমণ করে চলেছেন।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৬৪ সালের ২৭ মে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান নেহরু। তার পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৬৬ সালে লালবাহাদুর তাসখন্দে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর জয়ী হয়ে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ তৈরি করেছিলেন, তখন মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, দিল্লির এক মহিলার হাতে আমেরিকার বিদেশনীতি পরাজিত হয়েছে। আমরা ওই মহিলাকে উচিত শাস্তি দেব। এমনকি ঠিক যুদ্ধের আবহে ইন্দিরা গান্ধী ছুটে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে। হাতজোড় করে তিনি নিক্সনকে বলেছিলেন, বাঙালিদের হত্যা করার জন্য আপনি পাকিস্তানের হাতে অস্ত্র দেবেন না।
নিক্সন সেই অনুরোধের কোনো জবাব দেননি। এসব তো ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, নিক্সন-চীন যৌথভাবে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর দিল্লিতে শিখদের দাঙ্গা হয়েছিল। দিল্লির ওই দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছিল আরএসএস। তাই আরএসএসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে সোমবার রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে, লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী দৃঢ়তার সঙ্গে বলে দেন, যতই আপনারা চেষ্টা করুন, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করতে দেবে না দেশের মানুষই।
বারবার বিরোধী দলনেতাকে বাধা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, আমরা একদিন হিন্দু রাষ্ট্র করবই। সরকার ও ট্রেজারি বেঞ্চের বাগবিতণ্ডার মধ্যে লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেন, ’২৪-এর নির্বাচনে তো চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। আর কোনো দিন পারবেন না।
সারা জীবন স্বাধীনতার সংগ্রাম করে, জেল খেটে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। কিছু না পেলে আপনারা এখন তাকে ঠেলে গালমন্দ করছেন। এটা কোন দেশের গণতন্ত্র। মনে রাখবেন, আপনারা সংখ্যালঘু সরকার। বিজেপিকে এবার দেশের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়নি। আপনারা এজেন্সি দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন। দেশ রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীও আপনারা ভেঙে দিয়েছেন। আরএসএস ক্যাডার দিয়ে অগ্নিবীর সেনা তৈরি করেছেন।
গত ১০ বছরে পাঁচটি কংগ্রেসশাসিত সরকার ভেঙে দিয়েছে বিজেপি। দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা নিয়ে গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন শ্রেণির বিশেষজ্ঞরা সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখছেন। টেলিভিশনেও বক্তব্য রাখছেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদির স্লোগান ছিল কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবারমুক্ত ভারত। মোদির মুখের ওপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে রাহুল আজ বলেছেন, পারলে করে দেখান।
দ্রব্যমূল্য, বেকার সমস্যা এবং দেশের মানুষের সমস্যা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনারা হিন্দুত্ববাদের কথা তুলছেন। আর আমরাও বলছি, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখছি এবং রাখব। রাহুল যখনই সংসদে বক্তৃতা করছেন, তখনই মাঝে মাঝে মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ করা হলে স্পিকার বলছেন, আমার হাতে কোনো সুইচ নেই। আমরা বন্ধ করছি না। অথচ যারা টিভি দেখছেন, তারাও বিষয়টি লক্ষ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ সংসদীয় রাজনীতি শুরু হওয়ার সময় থেকেই বিরোধী দল ছায়া মন্ত্রিসভা করছে আজ পর্যন্ত।
নেহরু, অটল বিহারি রাজপেয়ি, রাজীব গান্ধী, নরসিহা রাও যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিরোধীদের ছায়া মন্ত্রিসভা গঠনের নীতি নিয়ম মেনে চলেছেন। রাহুল চাইছেন সেই ধাঁচে এবারও ছায়া মন্ত্রিসভা তৈরি করবেন। কিন্তু মোদি, অমিত শাহ কি এই ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেবেন? এই প্রশ্নে এখন সংসদ এলাকা তোলপাড়। ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধি আইন অনুযায়ী ছায়া মন্ত্রিসভা করতে দিতে বাধ্য সরকারপক্ষ।
রাহুলের জোটের অন্যতম শরিক সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব বলেছেন, আইন অনুযায়ী ছায়া মন্ত্রিসভা করতে দিতে বাধ্য, তা দেওয়া না হলে আমরা সংসদ অচল করে দেব। ভারতের সংসদীয় রাজনীতি আগামী কয়েক মাস কোন পথে যাবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চুলচেরা বিচার করছেন। এদিকে আরএসএস মুখপাত্ররা বলছেন, আমরা ছায়া মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেব না।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক