ঢাকা ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪

মাধ্যমিকের কারিকুলামে কোডিং অন্তর্ভুক্ত

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪, ১১:১৩ এএম
আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪, ১১:৪১ এএম
মাধ্যমিকের কারিকুলামে কোডিং অন্তর্ভুক্ত
মো. হাসান-উল-বারী

প্রযুক্তির দুনিয়ায় বর্তমানে চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। শুধু চর্চা নয়, বেড়েছে ব্যবহারও। মানবসভ্যতার উন্নয়নে এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে দিনরাত চলছে গবেষণা। আর সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই প্রবেশ ঘটেছে শিক্ষাক্ষেত্রেও। সেটা ভালো হবে কী মন্দ হবে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। তবু এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি বিশ্ব আমাদের তৈরি হবে। আর সেই বিশ্বে পদচারণ করবে আজকের দিনের নতুন প্রজন্ম, আমার আপনার সন্তানরা। সেই বিশ্বে আমাদের সন্তানরা কেমন করবে তা অনেকখানিই নির্ভর করবে তার ‘তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের ওপর’।

তাই বর্তমান বিশ্বের অভিভাবকরা চাচ্ছেন তাদের সন্তানরা ছোট থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির ওপর বেসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করুক। তথ্যপ্রযুক্তি বলতে যদি আপনি শুধু ফেসবুককে বোঝেন তবে মারাত্মক ভুল করবেন। আপনি যেটি ব্যবহার করছেন তা একটি অ্যাপ মাত্র। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, লিংকডইন, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল এসব অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্মের পেছনে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল কর্মযজ্ঞ। সেখানে কাজ করছেন লক্ষাধিক প্রযুক্তিবিদ। এসব প্ল্যাটফর্মে তথ্যকে সহজেই প্রদর্শন করার জন্য ‘কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বা কোডিং’ ব্যবহার করেন প্রযুক্তিবিদরা। 

আমরা যদি আমাদের শিশু-কিশোরদের একাডেমিক সাফল্য ও স্মার্ট করতে চাই তাহলে প্রতিটি শিশুকে কোডিং শেখাতে হবে। বাচ্চাদের জন্য কোডিং শুধু তাদের গণিত এবং লেখার দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করে না বরং পরবর্তী সময়ে তাদের কর্মজীবনে দক্ষতার নতুন মাত্রা যোগ করবে। কেন কোডিং শেখা গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন ছোটবেলা থেকেই স্কুলে কোডিং শেখানো উচিত তার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। শিশুরা যত তাড়াতাড়ি কোডিং করতে শিখবে, তাদের সাফল্য অর্জনের সুযোগ তত দ্রুত ধরা দেবে। 

আধুনিক বিশ্বে নিজেদের এগিয়ে নিতে গণিত, বিজ্ঞানের পাশাপাশি প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার, যা কিনা শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার মাধমে সোনার মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব।

২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে গড়ে তোলা অপরিহার্য। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে আগ্রহী করে গড়ে তুলতে গত ৬-৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ প্রতিদিন এক ঘণ্টার কোডিং ক্যাম্পেইন ‘আওয়ার অব কোড’ দেশব্যাপী সব মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা করা হয়। 

ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত আনন্দসহকারে কোডিং আওয়ার শেষ করেছে ও কম্পিউটার জেনারেটেড সনদ গ্রহণ করেছে। ওই ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয় ‘কিশোর বাতায়ন’ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে, যেটি বর্তমান সরকার এটুআইয়ের সহযোগিতায় বেশ কয়েক বছর আগেই স্কুলশিক্ষার্থীদের উপযোগী করে তৈরি করেছে। ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তোলো স্লোগান সামনে রেখে আমাদের স্কুলশিক্ষার্থীরা ‘কিশোর বাতায়ন’ প্ল্যাটফর্ম থেকে আমার স্কুল, বইসমূহ, জীবন দক্ষতা, ক্যারিয়ার দক্ষতা ইত্যাদি বিষয় অনলাইনে শিখতে পারবে। 

এখানে উল্লেখ্য, শুধু জীবনদক্ষতা বিষয়ের ওপর কিশোর বাতায়নে ১৯৩টি কনটেন্ট রয়েছে। অভিভাবক থেকে শুরু করে সহকর্মী সবার একই প্রশ্ন- শিশু-কিশোরদের কোডিং শিখতে হবে কেন? এই কোডিং শিখে কী লাভ? এটি শিখে কি কম্পিউটার বিজ্ঞানী হবে? নাকি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবে? সেটা যদি না হয় তাহলে কোডিং শিখবে কেন? একেবারেই যৌক্তিক প্রশ্ন। কোনো জিনিস শেখার আগে কেন শিখছি, সেটি জানা খুবই জরুরি। 

প্রচলিত ধারণায়, প্রোগ্রামিং শুধু কম্পিউটারের ভাষা, এটি দিয়ে কম্পিউটারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রকৃত অর্থে সেটি প্রোগ্রামিংয়ের প্রথম ধাপ নয়। প্রোগ্রামিং আসলে সমস্যা সমাধান (প্রবলেম সলভিং) এবং সিদ্ধান্ত  গ্রহণ (ডিসিশন মেকিং) করতে শেখায়। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমরা সমস্যার সমাধান করে চলেছি। আমরা সেটি সব সময় আসলে খেয়াল করছি না।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন স্যারের উদাহরণ টেনে বলা যাক, অফিসে যাওয়ার জন্য রিকশা নেব নাকি উবার বা পাঠাও থেকে কার বা বাইক নেব, নাকি পাবলিক বাসে যাব, এটি একটি সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের অনেক বিষয় বিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। উদ্দেশ্য যদি হয় কম খরচে যাওয়া, তাহলে রিকশা নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে খরচের কথা চিন্তা না করে যদি দ্রুত যাওয়াই হয় প্রধান উদ্দেশ্য, তাহলে পাঠাও নেওয়া যায়। আর যদি উদ্দেশ্য হয় কম খরচে তুলনামূলকভাবে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো, তাহলে পাবলিক বাস নেওয়াটা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।

কোডিং শেখার অনেক কারণ আছে, যার কয়েকটি নিম্নে দেওয়া হলো-

১. কোডিং সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে তোলে   

২. কোডিং চিন্তা করতে শেখায়

৩. একাডেমিক কর্মক্ষমতা উন্নত করে 

৪. কোডিং সৃজনশীলতা বাড়ায়

৫. ভালো কম্পিউটার প্রোগ্রামার হওয়ার সম্ভাবনা 

৬. সফটওয়্যার শিল্পে দক্ষতার অভাব রয়েছে 

৭. কোডিং শিশুদের গণিত শেখা আনন্দদায়ক করে তোলে 

৮. কোডিং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে

নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষায় স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে যুক্ত করা হয়েছে। যদিও বাস্তবে এ বছর প্রাথমিকের সিলেবাসে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং যুক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিকের সিলেবাসে অর্থাৎ অষ্টম ও নবম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে পাইথন প্রোগ্রামিং ভাষা অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেটি খুবই যুগোপযোগী। 

ইতোমধ্যে দেশব্যাপী মাধ্যমিকের সব আইসিটি শিক্ষককে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও নেটওয়ার্কিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, সবকিছুর মূল সমাধান লুকিয়ে আছে শিক্ষায়। যখনই কোনো সমস্যা হয়, আমি বলি, সর্বক্ষেত্রে শিক্ষা বিস্তার করো। এতেই সমাধান হয়ে যাবে। কাজে কাজেই ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের প্রধান ভিত্তি হলো স্মার্ট সিটিজেন। আর স্মার্ট সিটিজেন তৈরির জন্য দরকার ডিজিটাল লিটারেসি ও কোডিং শিক্ষা। 

সুতরাং বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাসহ পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে বাংলার শিক্ষার্থীদেরও এআই এবং কোডিং শিক্ষা দিতে পারলে দ্রুত আমাদের এই সোনার বাংলা বাস্তবে সোনার স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে।  

লেখক: শিক্ষক, মিলেনিয়াম স্কলাস্টিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস, বগুড়া
[email protected]

সর্বজনীন পেনশন আগে পরে সবাই এর আওতায় আসবেন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
আগে পরে সবাই এর আওতায় আসবেন
মাহবুব আহমেদ

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সবাই এর আওতায় আসবেন। কেউ আগে আবার কেউবা পরে। সবারই এ কর্মসূচির আওতায় আসা উচিত। এতে ক্ষতি নেই। আমিতো ক্ষতির কিছুই দেখি না। বরং জীবনের শেষদিকে একটি আর্থিক নিরাপত্তা হিসেবে এমন একটি কর্মসূচি দরকার ছিল।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এ সিস্টেম আছে। সেটা চিন্তা করেই আমাদের এখানে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটা পর্যায়ে সবাইকেই এ কর্মসূচির আওতায় আসতে হবে। এ বছর শিক্ষকরা আসছেন। আগামী বছর থেকে সরকারি কর্মচারীরা এর আওতায় আসবেন।

বেসরকারি পর্যায়ে তো নির্দিষ্ট প্যাকেজই রয়েছে। সব উন্নত রাষ্ট্রেই বার্ধক্যে এ ধরনের নিরাপত্তামূলক আর্থিক কর্মসূচি দিয়ে সেফগার্ড দেওয়া হয়।

সাবেক অর্থসচিব

সর্বজনীন পেনশন আলোচনায় বসলেই সব ঠিক হয়ে যেত

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১১ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
আলোচনায় বসলেই সব ঠিক হয়ে যেত
নজরুল ইসলাম খান

পেনশন স্কিমে কয়েকটি বিষয় নতুন আছে। এগুলো আলাপ-আলোচনা করে নিলেই ঠিক হয়ে যেত বলে মনে করি।

দূরত্ব না বাড়িয়ে বরং কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। দূরত্ব না বাড়ানো ভালো। বিশেষ করে যারা ব্যবস্থাপনায় আছেন তাদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেভাবে হঠাৎ করেই অচল করে ফেলা হলো সেটাও কতটা ঠিক হয়েছে, তা দেখা দরকার। এর পেছনে অন্যকিছু আছে কি না, তা নিয়ে আমি কিছুটা শঙ্কিত।

তবু এখনো আলোচনায় বসে প্রয়োজনে কিছু বিষয় সংশোধন করার সুযোগ আছে। কত টাকারই বা ব্যাপার। হয়তো আমাদের অর্থনৈতিক কিছুটা সমস্যার কারণে সহজেই প্রয়োজনীয় অনেক কিছু করা যায় না।

সাবেক শিক্ষা সচিব

ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত প্রয়োজন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৫ পিএম
ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত প্রয়োজন
আবুল কাসেম ফজলুল হক

শিক্ষকদের দাবির বিষয়টি বিবেচনা করে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে এর সমাধান হয়ে যায়। যারা সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পেনশন পান তাদের বিষয়ে আপাতত কোনো হস্তক্ষেপ বা পরিবর্তন না করা ভালো। এটা চলছে, সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সরকার কেন পরিবর্তন করতে চাচ্ছে তা ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না।

তবে যারা এখনো সরকারি চাকরি করেন না তাদের জন্য আলাদা পেনশন ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে। সেটি করলে সরকার ভালো কাজ করত।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনায় শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে কোনো কিছু পাস করানো এই জিনিসটা ভালো না। সরকারকে বা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা যায়।

জনসভা, মিছিল প্রতিবাদ করতে গেলে সংগ্রামের ব্যাপার দাঁড়ায়। সব কিছুতেই সংগ্রাম করতে হবে এরকম না। বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা, সংগ্রামের অনেক ক্ষেত্র আছে। তাই বিষয়টি ভালো করে বুঝে অল্প সময়ে সমাধান করা উচিত।

সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৬ পিএম
আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত
এ কে আজাদ চৌধুরী

এটা আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশনের কথা বলেছেন, সবাইকে রাখতে পারতেন। সেটাই ভালো হতো।

শিক্ষকদেরকে সবার সঙ্গে মেশানো হলো আর ব্যুরোক্রেটদের (আমলাদের) আলাদা করে রাখা হলো। এতে একটা অনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই হিসেবে তো আমি এটা সমর্থন করতে পারি না।

সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করায় বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তবে এটা তো সংশোধন করা যায়।

আমার মনে হয়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।

সাবেক চেয়ারম্যান, ইউজিসি
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:০১ এএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:০১ এএম
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছরে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ পর্যন্ত যেসব অর্জন হয়েছে সেগুলোকে সুসংহত করে যেতে আমাদের বর্তমান কতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন, কৌশল নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন।

সরকারের ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে এবং চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনটি মূল সমস্যা নিয়ে আমি এতদিন যথেষ্ট আলোকপাত করেছি, সেগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, অপর্যাপ্ত রিজার্ভ এবং জ্বালানি সমস্যা। এগুলোর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক সমস্যা আছে। যেমন- ব্যাংকিং খাতের সমস্যা, পুঁজিবাজারের সমস্যা, অর্থপাচার এবং দুর্নীতি। 

বাজেটে সমস্যাগুলোর সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। পরোক্ষভাবে কিছু কিছু আংশিক নীতি ও কৌশলের উল্লেখ আছে কিন্তু সেগুলো সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। আমার মতে, বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। সামনে জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪-এর মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।  সেটাতেও আমি মনে করি, সমস্যাগুলোর সমাধানে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

রাজস্বনীতিতে যেখানে বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং মুদ্রানীতি, দুটার পেছনেই সঠিক দর্শনের অভাব এবং নীতির সীমাবদ্ধতা আমরা বহুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি। সেই সঙ্গে কৌশলগুলোর দুর্বলতা এবং সবশেষে বাস্তবায়নের ব্যর্থতা দিন দিন বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে প্রকট করে তুলছে। এই নিবন্ধে আমি নীতি, কৌশল এবং বাস্তবায়নের প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করছি।

আর্থিক খাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এখন আসা যাক বাজেটের পলিসিগত দুর্বলতা প্রসঙ্গে। বাজেটে বিরাট ঘাটতি আছে। ঘাটতি পূরণে সরকারকে কর নিতে হবে বেশি। ঘাটতির জন্য সরকারকে ঋণ নিতে হবে। ঋণ অভ্যন্তরীণ সেক্টর থেকে নেবে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বেশি নেবে। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে আসবে। কর বাড়াবে, বিশেষ করে পরোক্ষ কর বাড়াবে। প্রত্যক্ষ কর হয়তো কিছু বাড়াবে। করের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। করের যে আদায় এবং কর যে কার কাছ থেকে নেবে- এগুলো সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা দেখতে পেলাম না। 

সাধারণত সব দেশে পরোক্ষ কর সবচেয়ে কম ওঠায়। কারণ পরোক্ষ করে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু যারা ধনী, যারা অবস্থাপন্ন, সম্পদশালী, তারা প্রত্যক্ষ কর দেয়। যাদের কর দেওয়ার সামর্থ্য আছে, অর্থ আছে, আয় আছে, তারা দেবে। কিন্তু এটার কোনো কিছুই এখানে ফলো করা হয় না। অতএব, ট্যাক্স বাড়বে, নতুন করে লোকদের ওপর করের বোঝা বাড়বে। এতে কি ট্যাক্স জিডিপি বাড়বে? আমার তো মনে হয় না। কারণ এনবিআরের যে সক্ষমতা, উদ্যোগ ও মনোযোগ থাকবে যারা ট্যাক্স দিচ্ছে, তাদের দিকে।

এখন আসা যাক মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতির ব্যাপারে। আমার মনে হয়, মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় নেই। কারণ মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। বাজেট সম্প্রসারণশীল। কিছুটা খরচ বাড়বে, যদিও খুব বেশি বাড়ে না। বিরাট একটা বাজেটঘাটতি আছে। সেই খরচটা কমাতে পারত যদি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আরও কাটছাঁট করে ছোট করে নিয়ে আসা যেত। বাজেটে যে করের হিসাব দিয়েছে, বিভিন্ন প্রণোদনা, সরকারের ঋণ গ্রহণ, সেগুলো মুদ্রানীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক।

এখন মুদ্রানীতিতে কী কী করা উচিত? ভবিষ্যতে কী করতে হবে? ভবিষ্যতে যেটা করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথমত প্রাথমিকভাবে খুব দ্রুত একটা পর্যালোচনা করতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে। আগের মুদ্রানীতির ইমপ্যাক্টটা কী? এটার জন্য খুব একটা যে সময় লাগবে তা নয়। মুদ্রানীতিটা কী কী কাজে লেগেছে, তাদের উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। শুধু মুদ্রানীতিতে আবার কিছুটা টার্গেট দেবে, কিছু রিজার্ভ মানি টার্গেট, ক্রেডিট টার্গেট, পলিসি রেট- সেগুলো দিতে পারবে। 

কিন্তু এর আগে পর্যালোচনা করতে হবে, আগের টার্গেটগুলোর কী হয়েছে? এগুলোর ফল কী হয়েছে? আগের কৌশলগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে। কারণ গত মুদ্রানীতিতে আমরা তেমন সফলতা দেখিনি। এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কথা বলছি, বাজেটের সময়ে যে বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে, বিভিন্ন বিষয় অ্যাড্রেস করতে হবে। এগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথমত যেটা হলো, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছি। যেটা আমরা বলছি, চাহিদাটাকে কমানো। চাহিদা যদি কমানো হয়, মূল্যস্ফীতি কমবে। পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করেছে, পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করলে বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে অর্থের সরবরাহ কমবে। সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। আমাদের সঞ্চয় বা ব্যাংকের জামানতকৃত টাকা কমে যাচ্ছে। ওই দিকে চাহিদা বাড়ছে। ফলে সুদের হার বাড়ছে। সুদের হারটা আগে নয়ছয় ছিল, সেটা মোটেও যুক্তিসংগত ছিল না। সেটা বাড়িয়েছে।

এখন ক্রলিং পেগ করেছে। ক্রলিং পেগ হলো একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ওঠানামা করবে। কিছুটা বেড়েছে হয়তো, রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে ইদানীং। ক্রলিং পেগে ক্রল করে তো বেশি কিছু হয়নি। বিভিন্ন দেশে ক্রলিং পেগের অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। ওপরে নামবে, নিচে নামবে। আমাদের মূল সমস্যা- ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে কেন ওঠানামা করছে? রিজার্ভ কেন কমে যাচ্ছে? বাইরে থেকে ফরেন কারেন্সি কেন আসছে না?

জ্বালানির ব্যাপারটা সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। কিন্তু জ্বালানির উপাদান তো আনতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, ডিজেল, পেট্রল আনতে হবে। সেগুলোর জন্য ফরেন রিজার্ভ কতটুকু দরকার, সেটা তো অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচ্য বিষয় হবে।

এর জন্য মুদ্রানীতিতে যেটা দরকার, সেটা করতে হবে। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বাজেটে তো কিছুই তেমন বলেনি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো খেলাপি ঋণের ব্যাপারে একটার পর একটা ছাড় দিয়েই যাচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে এক জায়গায় বলেছিলাম, ‘খেলাপি ঋণ একটা ব্যবসায়িক মডেল হয়ে গেছে।’ এই মডেল একটা ভালো মডেলের বিকৃত রূপ। মডেল হবে ঋণ নেবে, ঋণ ফেরত দেবে। লোকজনের কর্মসংস্থান করবে। 

ঋণটা সুস্থভাবে আদায় করবে। ঋণটা শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হবে না, পুঁজিবাজারের ওপরে হবে। এগুলো কিছু নেই, কিছুই হয়নি। যারা ঋণখেলাপি, তারা ব্যাংক থেকে শুধু ঋণ নিয়ে নিচ্ছে, শোধ দিচ্ছে না। কিন্তু দিন দিন ওদের ব্যবসার প্রসার হয়তো ঘটছে। ব্যবসার প্রসার না ঘটুক, দিন দিন বিপুল পরিমাণে ওদের আয় ও সম্পদ বাড়ছে। এটা বাংলাদেশে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেউ বলে সারপ্রাইজ, কেউ বলে মিরাকল। 

আবার কেউ বলে বাংলাদেশ একটা আদর্শ। ব্যাংকিং মহলে এই আদর্শ বা মিরাকলের ব্যাপারটা অনেক ক্ষুণ্ন করেছে খেলাপি ঋণ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতটাকে আমূল সংস্কার করতে হবে। খেলাপি ঋণ কী কারণে হচ্ছে? ব্যাংকের সুশাসন কেন হচ্ছে না? বাংলাদেশে কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতি শুধু টার্গেট দিয়ে হবে না। কী কী করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, কী কী ব্যাংক করবে- সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

মুদ্রানীতি ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট সম্পর্কে সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মত নীতি ও কৌশল দেবে, এটাই কাম্য। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ, ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট মানে সেখানে দেশে বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে, সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। অতএব ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইমপ্রুভ করতে হলে বাইরে থেকে অর্থ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে।

আমি মনে করি, মুদ্রানীতি এবার ফরেন রিজার্ভ এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করতে হবে। কী কী পদক্ষেপ থাকবে এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ডেভেলপ করার কৌশল থাকবে। ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটটাকে আলাদা করে দেখতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেটটাকে শুধু রেমিট্যান্স আনার ব্যাপারে নয়, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ সহায়ক করতে হবে। মার্কেট মনিটর করতে হবে।

গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। টাকাটা কনভার্ট করে ব্ল্যাক মার্কেট থেকে অথবা কার্ব মার্কেট থেকে ডলার কিনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা নানা রকমভাবে অর্থ পাচার করে, হুন্ডি করে, তাদের ধরতে হবে। কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিষয়টা শুধু মুদ্রানীতির ব্যাপার নয়, আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দূর করতে সরকারকে এ ব্যাপারে অতিসত্বর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়নের দুটি মূল গুরুত্বপূর্ণ অর্জন- নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু সামনের দিকে যেতে হলে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের আপামর জনসাধারণের মানোন্নয়ন এবং একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অর্থনীতির সব খাতের নীতির সমন্বয়, কার্যকরী কৌশলের প্রণয়ন, সর্বোপরি বাস্তবায়নের দিকে অতিসত্তর দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াস নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়