![চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাংলাদেশের সম্ভাবনা](uploads/2024/07/04/Munshi-Foyez-1720069668.jpg)
বিআরআই হচ্ছে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি চীনের একটি উদ্যোগ; যা এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ ঘনিষ্ঠ করেছে। এটি এমন একটি ধারণা, যেখানে অসংখ্য বড় ও ক্ষুদ্র প্রকল্পের সমন্বিত চিন্তাভাবনা সামনে চলে আসে। এর অনেকগুলো ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। আরও অসংখ্য নতুন প্রকল্প আগামীতে গ্রহণ করা হবে। এই ধারণাটি চীনের জন্য নতুন বা বিশেষ কিছু নয়। তাদের ভবিষ্যতের ভাবনা ও দৃশ্যকল্পের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মিলে যায়।
কারণ তারা অসংখ্য জাতীয়, দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংযোগে সহযোগিতার মাধ্যমে সবার সঙ্গে পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩০টিরও বেশি দেশে তাদের বিআরআই সহযোগিতা বিস্তৃত। এটির উদ্দেশ্য এসব দেশের সঙ্গে মালিকানা, দায়িত্ব, উন্নয়ন ভাগ করে নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া।
যা-ই হোক, উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে প্রকল্প নির্বাচন, শর্তাবলির বিষয়ে আন্তরিক ও সমতাভিত্তিক আলোচনা, উদ্দেশ্য, সুবিধা এবং সম্ভাব্য বাধাসহ সব বিষয়ের স্বচ্ছতার ওপর। সাফল্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়তা হলো- এই উদ্যোগের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অগ্রগতি, উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রকল্পগুলোকে নিয়মিত পর্যালোচনা ও পরিকল্পিত করার জন্যও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিআরআইয়ের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি চীনা মালিকানাধীন উদ্যোগ। কোনো সহযোগিতার উদ্যোগ কখনো একটি দেশের সম্পূর্ণ একক মালিকানাধীন হতে পারে না। যদিও এটি চীনা উদ্যোগ, চীনের সীমান্তের মধ্যে ছাড়া বিআরআইয়ের অন্য সব প্রকল্প একচেটিয়াভাবে চীনের মালিকানাধীন হতে পারে না।
কোনো প্রকল্প দ্বিপক্ষীয় হলে তা দুই দেশের মালিকানাধীন। যেহেতু অনেক প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে, তাই চীন সেগুলোর অংশীদার হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা অনুমান করতে পারি, বিআরআইয়ের অধীনে কিছু প্রকল্প কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বা জাতীয়ভাবে গৃহীত হলে সেই দেশের মালিকানাধীন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই জাতীয় প্রকল্পগুলো দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয়ভাবে অংশীদারির ভিত্তিতে যৌথ মালিকানাধীনও হতে পারে।
প্রস্তাবক দেশ হিসেবে বিআরআইতে চীনের অনেক স্বার্থ রয়েছে। এটি চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান হাতিয়ার। এটি চীনা বৈদেশিক নীতির উদ্দেশ্য এবং অগ্রাধিকারগুলোর পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় অর্থনীতির গতি বৃদ্ধির জন্য একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করছে।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, উন্নয়নশীল দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিশ্বায়ন বজায় রাখা এবং টেকসই করা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা বৃদ্ধি করা চীনের অন্যতম স্বার্থ। বিআরআই চীনকে তার ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ ফান্ডের সর্বোচ্চ ব্যবহার, উৎপাদন, নির্মাণ এবং অবকাঠামোসহ কৌশলগত সম্পদের চীনা আমদানি ও রপ্তানির জন্য বিকল্প পথ খোলার ক্ষেত্রেও সহায়তা করতে পারে।
তবে চীন ছাড়া অন্য দেশও বিআরআই থেকে লাভবান হবে। তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলো চীনের মতোই বিভিন্ন সুবিধা পাবে। তুলনামূলকভাবে কম সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশের ক্ষেত্রেও বিআরআইতে অংশগ্রহণ অনেক সুবিধা এনে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, প্রয়োজনীয় তহবিল/বিনিয়োগ সংগ্রহ, আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত সংযোগসহ নানামুখী সুবিধা।
সব ক্ষেত্রেই বিআরআই দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে অবকাঠামোর অভাব, বিনিয়োগ তহবিল, আধুনিক প্রযুক্তি, বাজারে প্রবেশের বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। বিষয়গুলো মোকাবিলায় বিআরআই থেকে বাংলাদেশও অন্যান্য তুলনীয় অবস্থানের দেশগুলো অনুরূপ সুবিধা পেতে পারে।
বিআরআই চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। এটি ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপের কিছু দেশ এবং আরও কেউ কেউ আশঙ্কা বা সন্দেহের চোখে দেখে। যদিও অনেকের চীনের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে ছড়িয়ে দেওয়া বিভ্রান্তিকর তথ্য মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে। বিআরআইকে অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে যেভাবে বর্ণনা করা হয় তা থেকে সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া স্বচ্ছতা ও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যার অভাব রয়েছে।
বিআরআইয়ের সমালোচকরা একে একচেটিয়াভাবে চীনা উদ্যোগ/প্রকল্প হিসেবে দেখেন, যেন একচেটিয়াভাবে চীনা স্বার্থ রক্ষার জন্যই ওই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটি প্রায়শই বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, এ উদ্যোগটিতে অন্য অংশগ্রহণকারীদের চাহিদা এবং আগ্রহকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় না। যদিও চীনের বাইরে বিআরআইয়ের অনেক বিরোধিতাকারী রয়েছে, সেই দেশে কিছু চীনা পণ্ডিত, বিনিয়োগকারী, ব্যাংকারও রয়েছেন।
সেই বিরোধীরা বিনিয়োগের রিটার্ন বা প্রকল্পের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সতর্কতার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ছাড়া অনেক ভুল ধারণাও রয়েছে। অনেকেই বিআরআইকে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য রক্ষার লক্ষ্যে পরিচালিত বলে সন্দেহ পোষণ করে। চীনা সহায়তা প্রকল্প থেকে ঋণের ফাঁদে পড়ার ভয়, অলাভজনক প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া এবং অন্যান্য অংশীদার দেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আপস করার ভয়ও রয়েছে।
বিআরআই অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অস্থিরতা, সমন্বয়ের অভাব, বিভিন্ন নিয়ম, প্রবিধান এবং পদ্ধতির সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। কেউ কেউ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, সিপিইসি পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলোকে ঋণের ফাঁদ বা সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ চারদিকে ভারত ঘেরা। তাই ভারত ও মায়ানমার উভয়েরই বিআরআইতে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের বিআরআই থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার পূর্বশর্ত। এ ছাড়া অনুন্নত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব, দক্ষ জনশক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিবেশগত অবনতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর অবস্থান এবং মায়ানমারের সঙ্গে টানাপোড়েন সম্পর্ক- এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিআরআইতে কার্যকরী অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য অনেক সুবিধা এনে দিতে পারে।
বিশ্বে এমন কোনো উদ্যোগ নেই, যা চ্যালেঞ্জ বা বাধার সম্মুখীন হয়নি। বিআরআইও এর ব্যতিক্রম নয়। ওপরে উল্লিখিত বিআরআইয়ের চ্যালেঞ্জগুলোর বর্ণনা থেকেই প্রাসঙ্গিক প্রতিকারের ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এমন বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত যা অংশগ্রহণকারীদের কাছে বিশেষ আবেদন রাখবে। অংশগ্রহণকারীদের চাহিদা এবং আগ্রহের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।
মালিকানা, দায়িত্ব বণ্টন, সুবিধা এবং লাভ-ক্ষতির বিষয়ে স্পষ্ট থাকতে হবে। চীনের উদ্দেশ্য এবং স্বার্থ সম্পর্কে স্বচ্ছতা এবং স্পষ্টতা নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। আন্তরিকভাবে মুক্ত আলোচনা ও পরামর্শের ওপর জোর দিতে হবে। সহযোগিতার পারস্পরিক সুবিধার ওপর নজর দিতে হবে। দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয়ভাবে সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী দেশের উচিত সুশাসন নিশ্চিতে এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশেষ করে বিআরআই-সম্পর্কিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে বিভিন্ন নিয়ম, প্রবিধান এবং পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করতে হবে। বিআরআই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে।
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা অংশী দেশের জনগণের মধ্যে বৃহত্তর সংযোগ এবং সহায়তা করেছে। এমন কিছু করতে হবে যা অনুসরণ করার মতো, যা সবার জন্য উপকার বয়ে আনবে। যদি সমতার নীতির ভিত্তিতে যথাযথ পরিশ্রমের সঙ্গে উদ্যেগী হওয়া যায়। তাহলে পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা এবং সুবিধা অনেক বাড়বে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত