![সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও ভীতিকর পরিবেশ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে](uploads/2024/07/01/sultana-1719809245.jpg)
দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই নাজুক। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সংখ্যালঘু সহিংসতার শিকার অনেকাংশে বেড়েছে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে; যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার ও গণপিটুনির মতো ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অবিরত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। সামগ্রিক বিবেচনায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও আইনি পরিবেশ উন্নয়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সব ধরনের সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও ভীতিকর পরিবেশ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে ২০২৪-এ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত দুই মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক ও নির্বাচনি সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। পুলিশি বলপ্রয়োগের ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে অনেক ক্ষেত্রে তা বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতার ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে, যা উদ্বেগজনক। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মতপ্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতার ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে, সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি। অপরদিকে অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার অব্যাহতভাবে বেড়েছে, গণপিটুনির মতো আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনাও বন্ধ করা যায়নি, বরং বেড়েই চলেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে ২০২৪-এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গোলাগুলির অন্তত চারটি ঘটনা ঘটেছে। একটি ঘটনায় ব্যাপক গোলাগুলি হলেও হতাহতের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমে দুজনের আটকের বিষয় জানা যায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আসামির মৃত্যুর ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য, যা জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক সৃষ্টি করে। এমএসএফ মনে করে, প্রতিটি হেফাজতে মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক। মে ২০২৪-এ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে তিনজনের মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৭ মার্চ ২০২৪-এ শাহ আলম ও সবুজ নামের দুই পুলিশ কর্মকর্তা ডিবি পরিচয়ে মো. রানাকে বাসা থেকে তুলে যাত্রাবাড়ী থানায় নিয়ে যান এবং সেখানে রানাকে ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় এবং তিনি মারা যান।
রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত, মামলা ও গ্রেপ্তার, বিরোধীদলীয় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও বিএনপি তাদের নিজস্ব কর্মকাণ্ড ধরে রাখার লক্ষ্যে জনসংযোগ কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছে। রাজনৈতিক মাঠে বিএনপি না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টি জনমনে ভীতির সঞ্চারে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ রাজনৈতিক সহিংসতার ২৯টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১০৪ জন। তাদের মধ্যে ৬ জন নিহত ও ৯৮ জন আহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। ২৯টি ঘটনার মধ্যে ২৪টি ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে আর পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিরোধী দল বিএনপির।
সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করতে বিএসএফ কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ যাচ্ছে না বরং ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে। এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে তিনজন নিহত, নিহতের মধ্যে একজন ভারতীয়, দুজন বাংলাদেশি। এপ্রিলে তিনজন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। যশোরের বেনাপোল সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশি আহত হন। সীমান্ত থেকে দুজন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করে নিয়ে গেছে বিএসএফ। কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে নারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। অপরদিকে মায়ানমারের আরাকান আর্মির গুলিতে এক বাংলাদেশি জেলের পা বিচ্ছিন্ন হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ভারতের পক্ষ থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এমএসএফ মনে করে, সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় সীমান্তে হতাহতের ঘটনা কমছে না। সরকার সীমান্তে হতাহতের প্রতিবাদ ও প্রতিকারে যে ব্যর্থতা দেখাচ্ছে তা জনমনে ক্রমাগত প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। অপরদিকে মায়ানমার আন্তর্জাতিক সীমানা আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা কখনোই কাম্য হতে পারে না। সংখ্যালঘু নির্যাতন গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া ও এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মে ২০২৪-এ বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া ও এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ মাসে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ছয়টি ও দুটি জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
১৯ মে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে জয়ন্ত মণ্ডল নামে একজনকে গ্রেপ্তার ও তার বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।
সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে হুমকি, নিপীড়ন, হয়রানি, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন; যা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার খর্বের শামিল। সাংবাদিকদের যেভাবে শারীরিক, মানসিক এবং আইনি হয়রানি, আক্রমণ, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং তার মাধ্যমে সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। জুন মাসেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র উদ্বেগজনক। দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের ১৭টি ঘটনায় ৩৫ জন সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এমএসএফ মনে করে, যেভাবে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধের পাশাপাশি স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ। সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা ও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাংবাদিকদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সাইবার নিরাপত্তা আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার, ভিন্নমত দমন ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার ও অপব্যবহার জনমনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইনও একইভাবে সাইবার মাধ্যম ব্যবহারকারীর জন্য হয়রানি, হুমকি, আতঙ্ক ও সাইবার নিরাপত্তাহীনতাবোধ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইনে ছয়টি মামলা হয়েছে, অভিযুক্ত হয়েছেন ৩৫ জন ব্যক্তি এবং সি প্লাস টিভির ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব পেজ। একই মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইনে দুজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তারদের মধ্যে একজন হিন্দু যুবক, যিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং একজন ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, যার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যঙ্গোক্তি করার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দুটি মামলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে, একটি মামলা হয়েছে হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, একটি মামলা হয়েছে চট্টগ্রামে সি প্লাস টিভি, সাংবাদিকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে এবং দুটি মামলা হয়েছে মানহানির অভিযোগে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায় না। ফলে দিন দিন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়ে গিয়ে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা জাতীয় জীবনে প্রধান উদ্বেগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মে ২০২৪-এ দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যেমন: ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর তুলনায় বেড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা দৃশ্যমান হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারকে ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী