ঢাকা ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪

শুদ্ধাচার ও তুরুপের তাস

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪, ১১:১৮ এএম
আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪, ১১:১৮ এএম
শুদ্ধাচার ও তুরুপের তাস
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশ-সমাজ-সংসারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা-প্রয়োগের প্রধানতম পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তিজীবনে শুদ্ধাচারিতা। ব্যষ্টি থেকেই সমষ্টি। সঠিক জীবনদৃষ্টি প্রয়োগ করে মেধা ও প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকশিত ব্যক্তিই ‘স্ব-উদ্যোগ, স্ব-পরিকল্পনা ও স্ব-অর্থায়ন দ্বারা সৃষ্টির সেবায় সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে অশান্তিকে প্রশান্তিতে, রোগকে সুস্থতায়, ব্যর্থতাকে সাফল্যে, অভাবকে প্রাচুর্যে রূপান্তরিত করতে পারে।’ বলা বাহুল্য, সুশাসনের ফলিত রূপ হচ্ছে শুদ্ধাচার আর জবাবদিহিহীনতার ফলিত রূপ হচ্ছে দুরাচার। সুশাসক যেমন দুরাচারী হতে পারে না, তেমনি দুরাচারীও কখনো সুশাসক বলে গণ্য হতে পারে না। 

ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনে শুদ্ধাচার বা সদাচার চর্চার তাৎপর্যময় আবশ্যকতার কথা তাবৎ ঐশী গ্রন্থে, ধর্ম প্রবর্তক-প্রচারক, পণ্ডিত প্রবরের বাণীতে। সেই সদাচার-শুদ্ধাচারের চর্চা অবলম্বন অনুসরণ যুগে যুগে নানান প্রেক্ষাপটে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। সদাচার-সুশাসন লোপ পেলে ব্যক্তি-সমাজ-সংসার নিপতিত হয় নানান অরাজক পরিস্থিতিতে। মানবসমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূচনা-বিকাশ-বিবর্তনও ঘটেছে শুদ্ধাচারের প্রতি আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষা ও দায়বদ্ধতা থেকে। শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে, সহযোগিতা-সহমর্মিতার স্বার্থে, ন্যায়নীতিনির্ভরতার স্বার্থে ও তাগিদে সুশাসনকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে।  

তেপ্পান্ন বছর বয়সী বাংলাদেশি সমাজ, প্রশাসন ও অর্থনীতিতে সর্ববিধ বিবেচনায় নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, রাজপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরও বেপরোয়া আচরণ, বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের মতো অর্থনীতির সমূহ সর্বনাশসাধন, সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির প্রতিকার না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো দিন দিনই সাধারণ মানুষকে যাতে আরও উদ্বিগ্ন করে না তোলে, সে জন্য সংবিধান-শুদ্ধাচার বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করছেন, রাষ্ট্রই সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আনবে জবাবদিহির মধ্যে, যাতে সরকারকে মুখোমুখি হতে হবে না অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির। 

কেননা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে পারে সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি এই আস্থাহীনতাই জন্ম দেয় সামাজিক অনাচার ও রাজনৈতিক সহিংসতার। ইতিহাসের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ এ কথা স্পষ্ট যে, ঔপনিবেশিক শাসন প্রশাসনযন্ত্রের যাবতীয় অন্যায়-অনিয়ম ও শোষণ-বঞ্চনারহিত সুশাসন-সদাচারী সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ এবং  ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো মানুষের রক্তত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। সেই স্বাধীন রাষ্ট্রে সুশাসন-শুদ্ধাচারের যে দুর্গতি, তার স্বরূপ সন্ধান ও প্রতিকারের দাবি তাই জোরেশোরে উঠছে। 

রসুলপুরের চৌধুরীদের একসময় বেশ প্রতিপত্তি ছিল। জমি-জোতদারি তো ছিলই, ছিল লোকলস্কর, পাইক-পেয়াদার বিশাল বহর। মহিষার মাঠে চাঁদের রাতে তাদের অশ্বারোহীর দল যখন পরের দিন পাশের জমিদার রামজীবনপুরের প্রাণনাথ বাবুর তালুকদারি দখলের লড়াইয়ে নামার মহড়া দিত, তখন বোঝা যেত ক্ষমতা ও কুর্নিশের কৌলীন্য কীভাবে সময়ের স্রোতে বহমান। হোমনাথ ছিল অশ্বারোহী দলের দলপ্রধান এবং চৌধুরীদের প্রধান প্রতিরক্ষক। তার বিশাল বপু ও পেটানো শরীর মনে করিয়ে দিত শক্তিমত্তা যেন চিরস্থায়ী পত্তন নিয়েছে তার চোখে, চোয়ালে ও দুই হাতের কবজিতে। মনে হতো সে যেন মর্ত্যলোকের অমর্ত্য অবয়বের প্রতীক। কিন্তু কালের কপোলতলে সম্রাট শাহজাহানের পত্নীপ্রেমের পসার যেমন অমরতা পেয়েও পায়নি, তেমনি নজিরবিহীন হোমনাথকেও একদিন কঙ্কালসার হয়ে শবযাত্রায় শামিল হতে হয়েছিল। 

বর্মপরিহিত সশস্ত্র হোমনাথ অনেক দূর পর্যন্ত তার দুচোখকে প্রসারিত করে শত্রুর নিশানা ঠাওর করতে পারত। কিন্তু তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি নিয়ে দূরদৃষ্টি দূরে থাক, নিকটদৃষ্টিতেও ছিল না। তার মনের জোর তার চাহনিতে, সহিসের লাগাম টানায় কিংবা তরবারির চাকচিক্যের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠত। তার মনে হতো অমরাবতীর জলে তার মা জননী তাকে যেন সদ্য চুবিয়ে এনেছেন- তার গোটা দেহ অমরার আশীর্বাদ পেয়েছে। 

তার ধরাকে সরা জ্ঞানের কাণ্ডকারখানা দেখে একদিন তার মা ডেকে বলেন, ‘বাছা আশপাশে একটু তাকাস। কেউ কিন্তু একদিনের জন্যও এককভাবে চিরদিনের চরণতলে ঠাঁই পায়নি।’ মায়ের কথা হোমনাথের বড্ড বেশি মনে পড়ে সেদিন, যেদিন নকীপুরের হরিচরণ বাবুর তিরন্দাজ বলরামের ছোড়া ছোট্ট একটা তির তার বাঁ হাতের খালি জায়গাটাতে এসে বেঁধে। সেই তিরে বিষ মাখানো ছিল- পচন ধরেছিল সে জায়গায়, সারানো যায়নি হাজার বদ্দি-কবিরাজি করেও। হাতের কবজিসমেত কেটে ফেলেও শেষরক্ষা হয়নি তার। 

 হোমনাথরা একবার জমিদার বাবুর সঙ্গে বাদায় গিয়েছিল। জমিদার বাবু বলেছিলেন, বাদায় বড় মিয়া আছে। চল তার সঙ্গে মোলাকাত করে আসি। তার ধারণা হয়েছিল, শ্মশ্রুমণ্ডিত কোনো সাঁইবাবা হবেন হয়তো বড় মিয়া, যার সঙ্গে কর্তার সম্পর্ক বহুদিনের। হোমনাথ নিজেও মাঝেমধ্যে সাঁইবাবাদের আখড়ায় গিয়ে নিজের মনের খবর নেওয়ার কথা ভাবত না যে তা নয়। বিশাল বজরায় তাদের যাত্রা সাত-আট দিনের বনবাস না বন উপভোগের জন্য। 

জমিদার বাবুর বজরা তেঁতুলখালির খাড়িতে নোঙর করেছিল। নোঙর করার পর বিরাট এক বাঘ বাদার দিক থেকে ‘হালুম’ শব্দ করে যখন হুংকার দেয়- দুজন বরকন্দাজ তৎক্ষণাৎ পানিতে পড়ে যায়- পাশে কুমির ছিল। তারা হজম করে ফেলে তাদের। জমিদার বাবু জানালেন, ‘বড় মিয়া’ আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন। আর তার ভাষা না বুঝতে পেরে পরান ও প্রণবরা পানিতে পড়ে গেল! হোমনাথের সংবিৎ ফেরে। সে বুঝল এই ‘বড় মিয়া’ তো সাঁইজির ধারেকাছের কেউ নন। 

ইনি তো বাদার বড় জমিদার সুন্দর মিয়া। তখন সন্ধ্যা হবে হবে- পশুর নদী থেকে তারা তেঁতুলখালীর খাড়িতে ঢুকেছে ঘণ্টাখানেক হলো। এর মধ্যে এই ‘হুংকার’, জমিদার বাবু যাকে বলছেন ‘অভ্যর্থনা’। আর সেই অভ্যর্থনায় পরান-প্রণবের কুমিরের পেটে চালান হওয়া। ব্যাপারটা ভয়ানক! বজরা নোঙর করা হলো খালপাড় থেকে নিরাপদ দূরত্বে। বড় মশাল জ্বালানো হলো। খালপাড় দেখা না গেলেও খালপাড়ের বড় মিয়ার শাগরেদরা যাতে তাদের শনাক্ত ও সমীহ করতে পারেন তেমন একটা ধারণায়। 

জমিদার বাবু সামনের ডেস্কে তার গদিতে বসে নল টানছেন। এখন বসন্তকাল। আকাশে তারা। মৃদুমন্দ বাতাস। ডানে-বায়ে গভীর বাদা। বজরায় রাগপ্রধান গানের রেশ- বাইজিরা নাচছে- এমন সময় একটা উল্লুক প্রকৃতির পাখি এসে ছোঁ দিয়ে যেন নিয়ে গেল বজরায় বাঁধা জুনিয়র ছাগলটিকে। এই ছাগলটি আনা হয়েছে ‘বড় মিয়া’র মনোরঞ্জনের জন্য, তাকে ভেট দেওয়ার জন্য। এই রাতে এই খালপাড়ে ছোঁ মারার মতো এত বড় উল্লুক পাখি কিংবা কিছু কীভাবে এল- কেউ ভাববার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। জমিদার বাবু আবার ব্যাখ্যা করলেন, ওটা কিছু না। 

‘বড় মিয়া’র উড্ডয়ন বাহিনী আমাদের একটা ছবক দিতে এসেছিল। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা দেখতে আর যাওয়ার সময় ছাগলটাকে আগেভাগে ভেট চাইছেন হয়তো ‘বড় মিয়া’। জমিদার বাবু রসিকতা করলেন- দেখ না, আমাদের নায়েব মশাই- খাজনা আদায়ের আগে নিজে কত পাবেন তার হিসাব কষেন। ‘ওমা, জমিদার বাবু এটাও জানেন তা হলে! তিনি তবে কেন এমন নায়েব রাখলেন?’ হোমনাথের মাথায় ঢোকে না। তার পাশে ছিল কূটবুদ্ধি বিভাগের রঘুনাথ বাবু। কানে কানে বলেন- ‘এটা হচ্ছে পরস্পরকে ভেট দেওয়ার রীতি’, ‘সেটা কেমন’? ফিসফিস করে জানতে চায় হোমনাথ। রঘু বাবু বলেন- ‘তুমি শুধু তরবারি চালিয়েই গেলে- এটুকু তোমার মাথায় ঢোকে না- আরে নায়েব মশায়ের যেমন দরকার জমিদার বাবুর আশীর্বাদ, তেমনি জমিদার বাবুরও দরকার নায়েব মশায়ের আনুগত্য ও তেলেসমাতি। 

সে কারণে জমিদার বাবু দেখেও না দেখার ভান করেন নায়েব বাবু যাতে কিছু কামাতে পারেন রায়ত প্রজার কাছ থেকে- নইলে নায়েব বাবু তার পক্ষে কেন অতিখেয়ালি হবেন খাজনা আদায়ে? আরও জানো, প্রজার পয়সা জমিদার বাবুর বেশি বেশি দরকার তার নিজের, পরিবারের ও জ্ঞাতিগোষ্ঠীর হাতে তোলার জন্য। সবাইকে হাতে না রাখলে নিজের গদি নিয়ে টানাটানি। এটা একধরনের গদি রক্ষার জন্য উৎকোচ বলা যায়। আমাকে গদিনশিন থাকতে দাও- এর জন্য তোমার নিজের পেট যেভাবে ভরতে চাও- ভরো। আমি কিছু বলব না। বিষয়টা হোমনাথের কাছে নজিরবিহীন মনে হয়। 

সে ভাবে, তাই তো, আমার আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য জমিদার বাবু আমাকে অনেক এনাম, অনেক সম্মান, অনেক সুযোগ দিয়ে রেখেছেন, যাতে আমি কখনো বিগড়ে না যাই কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে না পড়ি অথবা জমিদার বাবুর বিরুদ্ধবাদী বা বিপক্ষ অভ্যন্তর কিংবা বাইরের কারও সঙ্গে যাতে হাত না মেলাই। যাতে সময়মতো তিনি আমাকে তুরুপের তাস হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন। জমিদার বাবু যথেষ্ট আত্মসচেতন এসব ব্যাপারে। কেননা তিনি বিচক্ষণ। জানেন বড় রক্ষকের মাথা যদি বিগড়ে যায় তাহলে তার নিজের জন্য তো বটেই, গোটা জমিদারি হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। সে এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। 

হোমনাথ বড় একটা মঞ্চে বসা রঘুনাথ বাবুর দিকে ঠায় তাকিয়ে। তিনি ওখানে ওই বাঘটার পাশে বসে রয়েছেন কেন- এ তো ভয়ানক কাণ্ড দেখি।  বেশ বড় ধরনের একটা হল ঘর। ঘোষণা দেওয়া হলো অনুষ্ঠানের প্রধান প্রতিবেদন উপস্থাপনকারী হিসেবে আছেন আপ্যায়িত অতিথি বিশিষ্ট গবেষক এবং প্রতিবেশী লোকালয়ের জমিদার চৌধুরী প্রবরের প্রধান কূট পরামর্শদাতা মি. রঘুনাথ। তাকে সুন্দর মিয়া বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কয়েক শ বছর আগেকার মগ সম্প্রদায়ের রাজত্বকালে সেখানকার সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে গবেষণার জন্য। ঘোষণা শুনে হোমনাথের বুক গর্বে ভরে উঠল এবং তখন তার মনে হলো বাঘকে মানুষ ভয় পায় খামোখা- বাঘদের সরদার এবং এই বাদার স্বঘোষিত রাজ্যের প্রধান সুন্দর মিয়া কত বিচক্ষণ এবং ইতিহাসসচেতন। 

ঘোষণা অনুযায়ী রঘুনাথ উঠে দাঁড়ালেন, পোডিয়ামের কাছে গিয়ে তার নিবন্ধ পাঠ শুরু করলেন। হোমনাথ প্রথমে তার ভাষা বুঝতে পারছিল না এবং তার আশঙ্কা হচ্ছিল, এই রঘুনাথ বাবু তাদের সেই রঘুনাথ বাবু তো! এখন তিনি এ কি কোন ভাষায় কথা বলছেন। এর মধ্যে একটি সুদর্শন হরিণ এসে হোমনাথের কানে ফুঁ দিয়ে যাওয়ার পর সে বুঝতে পারল ভাষা। শুনতে পেল রঘুনাথ বাবু প্রাচীনকালে মগ রাজাদের সময়ের কথা বলছেন। রঘুনাথ বাবু একটু বিস্তারিত বয়ানে যাচ্ছিলেন। তখন সুন্দর মিয়া পাশে বসা হরিণা হাপানকে ইশারা করে জানাতে বললেন, রঘুনাথ বাবু যেন তার তার গবেষণার সারবস্তুতে সরাসরি চলে যান। 

রঘু বাবু সারবস্তুতে গেলেন- মগরাজাদের অন্যতম অধস্তন রাজা ছিলেন পাগালান। তাহার পিতাও ছিলেন তাহার চাইতে বড় রাজা। পাগালান পিতার গর্বিত সন্তান হিসেবে রাজকর্ম পরিচালনা করিতেন। একপর্যায়ে প্রতিবেশীদের পরামর্শ ও কূটবুদ্ধি লইয়া তিনি রাজ্য অভ্যন্তরে এমন একটি অবস্থা তৈরিতে মনোনিবেশ করিলেন যেন যে কেহ তাহার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করিতে না পারে। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দেখভালের ভার এমন ভাঁড়দের নিকট দেওয়া হইল যে, তাহারা ইহার মাধ্যমে এমন এক ভীতির সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইলেন যে, রাজার খয়ের খাঁ হইলে সাত খুন মাফ এবং আপন না হইলে তাহাদের সামান্য ছুতা-নাতায় দোষী বানানো অব্যাহত রহিল। 

দেখা গেল আজ যিনি খয়ের খাঁ, মুহূর্তের মধ্যে তাহাকে বাকির খাতায় চলিয়া যাইতে হইত। দেখা গেল কোথাও সর্পাঘাতে কাহারো মৃত্যু হইলেও এই সাপের মন্ত্রদাতা সাজাইয়া শত্রুপক্ষের সবাইকে অভিযুক্ত করা হইত। কর্তাভজার সেই সময়ে ঘাটের পানি আঘাটায় প্রবাহিত হইতে লাগিল। পাগালান মগরাজার এসব কর্মকাণ্ড দেখিয়া, ভয় পাইয়া, অবরুদ্ধ হইয়া ক্রমে ক্রমে দেখা গেল সেই মুল্লুকে সকলে কোনো কথা বলা বন্ধ করিয়া মুখে কুলুপ আঁটিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িল। মগের মুল্লুকে যে মৌনতা দেখা গেল, সেই মুল্লুক বেশি দিন টেকে নাই বলে রঘুনাথ বাবু উপসংহার টানেন। তার বক্তব্য শেষ হলেই মঞ্চের চারদিকে এক ধরনের শোরগোল শোনা গেল। এতে আনন্দ না প্রতিবাদ প্রকাশ পেল তা বোঝা গেল না।

পাশে রঘুনাথ বাবু তখনো ঘুমাচ্ছেন। হোমনাথ এতক্ষণ স্বপ্নের ঘোরে ছিল। ঘোর কেটে গেলে সে বাইরের চিৎকার শুনতে পেল। বজরার পাটাতনে যে খালাসি ও চৌকিদাররা ছিল, তাদের একজনের পা কেটে নিয়ে গিয়েছে কুমিরে এই কিছুক্ষণ আগে।    
[রস রচয়িতা] 

লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]

সর্বজনীন পেনশন আগে পরে সবাই এর আওতায় আসবেন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১৫ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ পিএম
আগে পরে সবাই এর আওতায় আসবেন
মাহবুব আহমেদ

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সবাই এর আওতায় আসবেন। কেউ আগে আবার কেউবা পরে। সবারই এ কর্মসূচির আওতায় আসা উচিত। এতে ক্ষতি নেই। আমিতো ক্ষতির কিছুই দেখি না। বরং জীবনের শেষদিকে একটি আর্থিক নিরাপত্তা হিসেবে এমন একটি কর্মসূচি দরকার ছিল।

পৃথিবীর অনেক দেশেই এ সিস্টেম আছে। সেটা চিন্তা করেই আমাদের এখানে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটা পর্যায়ে সবাইকেই এ কর্মসূচির আওতায় আসতে হবে। এ বছর শিক্ষকরা আসছেন। আগামী বছর থেকে সরকারি কর্মচারীরা এর আওতায় আসবেন।

বেসরকারি পর্যায়ে তো নির্দিষ্ট প্যাকেজই রয়েছে। সব উন্নত রাষ্ট্রেই বার্ধক্যে এ ধরনের নিরাপত্তামূলক আর্থিক কর্মসূচি দিয়ে সেফগার্ড দেওয়া হয়।

সাবেক অর্থসচিব

সর্বজনীন পেনশন আলোচনায় বসলেই সব ঠিক হয়ে যেত

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:১১ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
আলোচনায় বসলেই সব ঠিক হয়ে যেত
নজরুল ইসলাম খান

পেনশন স্কিমে কয়েকটি বিষয় নতুন আছে। এগুলো আলাপ-আলোচনা করে নিলেই ঠিক হয়ে যেত বলে মনে করি।

দূরত্ব না বাড়িয়ে বরং কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। দূরত্ব না বাড়ানো ভালো। বিশেষ করে যারা ব্যবস্থাপনায় আছেন তাদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেভাবে হঠাৎ করেই অচল করে ফেলা হলো সেটাও কতটা ঠিক হয়েছে, তা দেখা দরকার। এর পেছনে অন্যকিছু আছে কি না, তা নিয়ে আমি কিছুটা শঙ্কিত।

তবু এখনো আলোচনায় বসে প্রয়োজনে কিছু বিষয় সংশোধন করার সুযোগ আছে। কত টাকারই বা ব্যাপার। হয়তো আমাদের অর্থনৈতিক কিছুটা সমস্যার কারণে সহজেই প্রয়োজনীয় অনেক কিছু করা যায় না।

সাবেক শিক্ষা সচিব

ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত প্রয়োজন

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৫ পিএম
ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত প্রয়োজন
আবুল কাসেম ফজলুল হক

শিক্ষকদের দাবির বিষয়টি বিবেচনা করে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলে এর সমাধান হয়ে যায়। যারা সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পেনশন পান তাদের বিষয়ে আপাতত কোনো হস্তক্ষেপ বা পরিবর্তন না করা ভালো। এটা চলছে, সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সরকার কেন পরিবর্তন করতে চাচ্ছে তা ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না।

তবে যারা এখনো সরকারি চাকরি করেন না তাদের জন্য আলাদা পেনশন ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে। সেটি করলে সরকার ভালো কাজ করত।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনায় শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে কোনো কিছু পাস করানো এই জিনিসটা ভালো না। সরকারকে বা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা যায়।

জনসভা, মিছিল প্রতিবাদ করতে গেলে সংগ্রামের ব্যাপার দাঁড়ায়। সব কিছুতেই সংগ্রাম করতে হবে এরকম না। বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা, সংগ্রামের অনেক ক্ষেত্র আছে। তাই বিষয়টি ভালো করে বুঝে অল্প সময়ে সমাধান করা উচিত।

সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:০২ পিএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১২:২৬ পিএম
আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত
এ কে আজাদ চৌধুরী

এটা আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। কারণ প্রধানমন্ত্রী সর্বজনীন পেনশনের কথা বলেছেন, সবাইকে রাখতে পারতেন। সেটাই ভালো হতো।

শিক্ষকদেরকে সবার সঙ্গে মেশানো হলো আর ব্যুরোক্রেটদের (আমলাদের) আলাদা করে রাখা হলো। এতে একটা অনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই হিসেবে তো আমি এটা সমর্থন করতে পারি না।

সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করায় বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। তবে এটা তো সংশোধন করা যায়।

আমার মনে হয়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।

সাবেক চেয়ারম্যান, ইউজিসি
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:০১ এএম
আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪, ১১:০১ এএম
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছরে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ পর্যন্ত যেসব অর্জন হয়েছে সেগুলোকে সুসংহত করে যেতে আমাদের বর্তমান কতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন, কৌশল নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন।

সরকারের ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে এবং চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনটি মূল সমস্যা নিয়ে আমি এতদিন যথেষ্ট আলোকপাত করেছি, সেগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, অপর্যাপ্ত রিজার্ভ এবং জ্বালানি সমস্যা। এগুলোর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক সমস্যা আছে। যেমন- ব্যাংকিং খাতের সমস্যা, পুঁজিবাজারের সমস্যা, অর্থপাচার এবং দুর্নীতি। 

বাজেটে সমস্যাগুলোর সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। পরোক্ষভাবে কিছু কিছু আংশিক নীতি ও কৌশলের উল্লেখ আছে কিন্তু সেগুলো সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। আমার মতে, বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। সামনে জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪-এর মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।  সেটাতেও আমি মনে করি, সমস্যাগুলোর সমাধানে দ্রুত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

রাজস্বনীতিতে যেখানে বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং মুদ্রানীতি, দুটার পেছনেই সঠিক দর্শনের অভাব এবং নীতির সীমাবদ্ধতা আমরা বহুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি। সেই সঙ্গে কৌশলগুলোর দুর্বলতা এবং সবশেষে বাস্তবায়নের ব্যর্থতা দিন দিন বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে প্রকট করে তুলছে। এই নিবন্ধে আমি নীতি, কৌশল এবং বাস্তবায়নের প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করছি।

আর্থিক খাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এখন আসা যাক বাজেটের পলিসিগত দুর্বলতা প্রসঙ্গে। বাজেটে বিরাট ঘাটতি আছে। ঘাটতি পূরণে সরকারকে কর নিতে হবে বেশি। ঘাটতির জন্য সরকারকে ঋণ নিতে হবে। ঋণ অভ্যন্তরীণ সেক্টর থেকে নেবে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বেশি নেবে। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে আসবে। কর বাড়াবে, বিশেষ করে পরোক্ষ কর বাড়াবে। প্রত্যক্ষ কর হয়তো কিছু বাড়াবে। করের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। করের যে আদায় এবং কর যে কার কাছ থেকে নেবে- এগুলো সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা দেখতে পেলাম না। 

সাধারণত সব দেশে পরোক্ষ কর সবচেয়ে কম ওঠায়। কারণ পরোক্ষ করে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু যারা ধনী, যারা অবস্থাপন্ন, সম্পদশালী, তারা প্রত্যক্ষ কর দেয়। যাদের কর দেওয়ার সামর্থ্য আছে, অর্থ আছে, আয় আছে, তারা দেবে। কিন্তু এটার কোনো কিছুই এখানে ফলো করা হয় না। অতএব, ট্যাক্স বাড়বে, নতুন করে লোকদের ওপর করের বোঝা বাড়বে। এতে কি ট্যাক্স জিডিপি বাড়বে? আমার তো মনে হয় না। কারণ এনবিআরের যে সক্ষমতা, উদ্যোগ ও মনোযোগ থাকবে যারা ট্যাক্স দিচ্ছে, তাদের দিকে।

এখন আসা যাক মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতির ব্যাপারে। আমার মনে হয়, মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতির সমন্বয় নেই। কারণ মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক। বাজেট সম্প্রসারণশীল। কিছুটা খরচ বাড়বে, যদিও খুব বেশি বাড়ে না। বিরাট একটা বাজেটঘাটতি আছে। সেই খরচটা কমাতে পারত যদি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আরও কাটছাঁট করে ছোট করে নিয়ে আসা যেত। বাজেটে যে করের হিসাব দিয়েছে, বিভিন্ন প্রণোদনা, সরকারের ঋণ গ্রহণ, সেগুলো মুদ্রানীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক।

এখন মুদ্রানীতিতে কী কী করা উচিত? ভবিষ্যতে কী করতে হবে? ভবিষ্যতে যেটা করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথমত প্রাথমিকভাবে খুব দ্রুত একটা পর্যালোচনা করতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে। আগের মুদ্রানীতির ইমপ্যাক্টটা কী? এটার জন্য খুব একটা যে সময় লাগবে তা নয়। মুদ্রানীতিটা কী কী কাজে লেগেছে, তাদের উদ্দেশ্য কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। শুধু মুদ্রানীতিতে আবার কিছুটা টার্গেট দেবে, কিছু রিজার্ভ মানি টার্গেট, ক্রেডিট টার্গেট, পলিসি রেট- সেগুলো দিতে পারবে। 

কিন্তু এর আগে পর্যালোচনা করতে হবে, আগের টার্গেটগুলোর কী হয়েছে? এগুলোর ফল কী হয়েছে? আগের কৌশলগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে। কারণ গত মুদ্রানীতিতে আমরা তেমন সফলতা দেখিনি। এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কথা বলছি, বাজেটের সময়ে যে বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে, বিভিন্ন বিষয় অ্যাড্রেস করতে হবে। এগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথমত যেটা হলো, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছি। যেটা আমরা বলছি, চাহিদাটাকে কমানো। চাহিদা যদি কমানো হয়, মূল্যস্ফীতি কমবে। পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করেছে, পলিসি রেটগুলো পরিবর্তন করলে বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে অর্থের সরবরাহ কমবে। সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। আমাদের সঞ্চয় বা ব্যাংকের জামানতকৃত টাকা কমে যাচ্ছে। ওই দিকে চাহিদা বাড়ছে। ফলে সুদের হার বাড়ছে। সুদের হারটা আগে নয়ছয় ছিল, সেটা মোটেও যুক্তিসংগত ছিল না। সেটা বাড়িয়েছে।

এখন ক্রলিং পেগ করেছে। ক্রলিং পেগ হলো একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ওঠানামা করবে। কিছুটা বেড়েছে হয়তো, রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে ইদানীং। ক্রলিং পেগে ক্রল করে তো বেশি কিছু হয়নি। বিভিন্ন দেশে ক্রলিং পেগের অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। ওপরে নামবে, নিচে নামবে। আমাদের মূল সমস্যা- ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে কেন ওঠানামা করছে? রিজার্ভ কেন কমে যাচ্ছে? বাইরে থেকে ফরেন কারেন্সি কেন আসছে না?

জ্বালানির ব্যাপারটা সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। কিন্তু জ্বালানির উপাদান তো আনতে হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, ডিজেল, পেট্রল আনতে হবে। সেগুলোর জন্য ফরেন রিজার্ভ কতটুকু দরকার, সেটা তো অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচ্য বিষয় হবে।

এর জন্য মুদ্রানীতিতে যেটা দরকার, সেটা করতে হবে। খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বাজেটে তো কিছুই তেমন বলেনি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো খেলাপি ঋণের ব্যাপারে একটার পর একটা ছাড় দিয়েই যাচ্ছে। আমি কিছুদিন আগে এক জায়গায় বলেছিলাম, ‘খেলাপি ঋণ একটা ব্যবসায়িক মডেল হয়ে গেছে।’ এই মডেল একটা ভালো মডেলের বিকৃত রূপ। মডেল হবে ঋণ নেবে, ঋণ ফেরত দেবে। লোকজনের কর্মসংস্থান করবে। 

ঋণটা সুস্থভাবে আদায় করবে। ঋণটা শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হবে না, পুঁজিবাজারের ওপরে হবে। এগুলো কিছু নেই, কিছুই হয়নি। যারা ঋণখেলাপি, তারা ব্যাংক থেকে শুধু ঋণ নিয়ে নিচ্ছে, শোধ দিচ্ছে না। কিন্তু দিন দিন ওদের ব্যবসার প্রসার হয়তো ঘটছে। ব্যবসার প্রসার না ঘটুক, দিন দিন বিপুল পরিমাণে ওদের আয় ও সম্পদ বাড়ছে। এটা বাংলাদেশে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেউ বলে সারপ্রাইজ, কেউ বলে মিরাকল। 

আবার কেউ বলে বাংলাদেশ একটা আদর্শ। ব্যাংকিং মহলে এই আদর্শ বা মিরাকলের ব্যাপারটা অনেক ক্ষুণ্ন করেছে খেলাপি ঋণ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতটাকে আমূল সংস্কার করতে হবে। খেলাপি ঋণ কী কারণে হচ্ছে? ব্যাংকের সুশাসন কেন হচ্ছে না? বাংলাদেশে কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতি শুধু টার্গেট দিয়ে হবে না। কী কী করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, কী কী ব্যাংক করবে- সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।

মুদ্রানীতি ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট সম্পর্কে সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মত নীতি ও কৌশল দেবে, এটাই কাম্য। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ, ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মুখে আছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট মানে সেখানে দেশে বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে, সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। অতএব ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ইমপ্রুভ করতে হলে বাইরে থেকে অর্থ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে।

আমি মনে করি, মুদ্রানীতি এবার ফরেন রিজার্ভ এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করতে হবে। কী কী পদক্ষেপ থাকবে এবং ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ডেভেলপ করার কৌশল থাকবে। ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটটাকে আলাদা করে দেখতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেটটাকে শুধু রেমিট্যান্স আনার ব্যাপারে নয়, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ সহায়ক করতে হবে। মার্কেট মনিটর করতে হবে।

গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। টাকাটা কনভার্ট করে ব্ল্যাক মার্কেট থেকে অথবা কার্ব মার্কেট থেকে ডলার কিনে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যারা নানা রকমভাবে অর্থ পাচার করে, হুন্ডি করে, তাদের ধরতে হবে। কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিষয়টা শুধু মুদ্রানীতির ব্যাপার নয়, আর্থিক খাতে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দূর করতে সরকারকে এ ব্যাপারে অতিসত্বর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়নের দুটি মূল গুরুত্বপূর্ণ অর্জন- নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু সামনের দিকে যেতে হলে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের আপামর জনসাধারণের মানোন্নয়ন এবং একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অর্থনীতির সব খাতের নীতির সমন্বয়, কার্যকরী কৌশলের প্রণয়ন, সর্বোপরি বাস্তবায়নের দিকে অতিসত্তর দৃষ্টি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াস নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়