![‘নিরীক্ষা ফার্মের’ কর ফাঁকি বছরের পর বছর](uploads/2023/11/24/1700802405.Tax.jpg)
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএ) ফার্ম বা নিরীক্ষা ফার্মগুলোর বিরুদ্ধে কর ফাঁকিসহ সাজানো বা ভুয়া নিরীক্ষা রিপোর্ট তৈরি ও পেছনের তারিখে (ব্যাক ডেট) অডিট স্বাক্ষর করার মতো গুরুতর অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)।
অন্তত ৩৫টি সিএ বা নিরীক্ষা (অডিট) ফার্মের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছে এফআরসি। সম্প্রতি এফআরসিতে নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার পর এসব অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানে এফআরসি জানতে পারে, এসব ফার্মের কোনো কোনোটির টিআইএন (ট্যাক্সপেয়ার আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) থাকলেও অবশ্য করণীয় বিআইএন (বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) নেই। কারণ তারা সরকারকে কর ও মূসক পরিশোধ করে না।
এসব ফার্ম জাল অডিট করা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী নিরীক্ষা প্রতিবেদন করে দেয়।
নিরীক্ষা ফার্মের সততা আর্থিক হিসাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বছরের পর বছর ধরে এসব ফার্ম নিজেরাই অসততার আশ্রয় নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করেছে। এতে করে ঠকেছে সরকার। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এফআরসি অনুসন্ধানে কেস-১
ফেমস অ্যান্ড আর নামে একটি নিরীক্ষা (অডিট) ফার্ম গত তিন বছরে অডিট করেছে ১ হাজার ৪৫৭টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে প্রতি অডিটের বিপরীতে গড়ে ৫১ হাজার টাকা আয় বা রেভিনিউ এসেছে। এতে করে মোট আয় দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এ আয়ের বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বা মূসক হিসাব করলে তার পরিমাণ হয় ১ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু ওই ফার্ম সরকারকে কোনো মূসক পরিশোধ করেনি। এর বাইরে ১০ শতাংশ কর দেওয়ার বিধানও রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান কোনোটিই সরকারকে দেয়নি।
এই নিরীক্ষা ফার্মটি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির ব্যক্তিগত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষা করছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু মন্ত্রী নিজেও জানতেন না যে ফার্মটি সরকারকে মূসক ফাঁকি দিয়ে আসছে। এতদিন এসব তথ্য গোপনই ছিল। কিন্তু থলের বিড়াল বের হয়ে আসে সম্প্রতি ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) অনুসন্ধানে। আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে পেশাগত ধারাবাহিকতা নিয়মিত করতে এফআরসিতে নিবন্ধিত হতে হয়। আর এ নিবন্ধন পেতেই আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর কাগজপত্রে ঘাপলা পেয়ে অনুসন্ধান চালান এফআরসি কর্মকর্তারা। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি ও অসততার দায়ে তারা নিরীক্ষা ফার্মটিকে বাদ দেন নিবন্ধনের জন্য করা তালিকা থেকে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এরপর ফার্মটির বর্তমান স্বত্বাধিকারী (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ের ভাষায় পার্টনার) ফওজিয়া হক এফআরসির বিরুদ্ধে নালিশ করেন বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে। গত সোমবার এ ব্যাপারে মন্ত্রী তলব করেন এফআরসির চেয়ারম্যান ও তার শীর্ষ কর্তাদের। কিন্তু বিস্তারিত জানার পর মন্ত্রী নিজেও এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং ওই ফার্মটিকে দিয়ে আর তিনি নিজের কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম করবেন না বলে নিজের সিদ্ধান্ত এফআরসি চেয়ারম্যানকে জানিয়ে দেন।
যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ফেমস অ্যান্ড আরের স্বত্বাধিকারী ফওজিয়া হক এফসিএর সঙ্গে। তার ব্যবহৃত ফোনে কল দিয়ে বারবার মন্তব্য জানার চেষ্টা করা হলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে ফেইম অ্যান্ড আরের অপর পার্টনার সাফি উদ্দিন আহমেদের ফোন নাম্বারে কল দিলে তিনি কল রিসিভ করেন। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের ফার্ম বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট করে থাকে। কিন্তু আমি এখানে যুক্ত হয়েছি মাত্র এক বছর হলো। তাই আমি বেশি কিছু বলতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘ফওজিয়া বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। তার কাছে আমি এ বিষয়গুলো অবহিত করার চেষ্টা করব।’
এফআরসি অনুসন্ধানে কেস-২
এফআরসিতে নিবন্ধন পেতে আবেদন করে এম এম ইয়াসিন নামে একটি নিরীক্ষা ফার্ম। এ ফার্মের কোনো বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (বিআইএন) নেই। এ ফার্মের বিরুদ্ধেও সরকারকে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছেন এফআরসি কর্মকর্তারা।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. ইয়াসিন মিয়া এফসিএ বর্তমানে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের বৃহৎ সংগঠন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সহসভাপতি। যোগাযোগ করা হলে মো. ইয়াসিন মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, এফআরসিতে নিবন্ধন পেতে আবেদন করার পর বিআইএনের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন। পরে গত অক্টোবরে তিনি তার ফার্মের নামে বিআইএন নিয়ে আবারও আবেদন ফাইল জমা দিয়েছেন।
মো. ইয়াসিন মিয়া কর ফাঁকির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি নিজ নামে টিআইএন ও বিআইএন করে আয়কর দিয়ে আসছি। বছরে আমি ৫ লাখ টাকা কর পরিশোধ করি।’
বাংলাদেশে কোম্পানি ও ফার্মগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ আছে, একই কোম্পানি কয়েক রকমের আর্থিক প্রতিবেদন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন ভিন্ন ভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারি দপ্তরে জমা দেয়। যেমন- শেয়ারবাজারে থাকায় এক ধরনের প্রতিবেদন ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। আবার কর ও রাজস্ব পরিশোধে আরেক ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এর বাইরে ব্যবসার আকার ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা প্রক্ষেপণ করে ব্র্যান্ডিং এবং ঋণ ও বিনিয়োগ পেতে ভিন্ন প্রতিবেদন দেওয়া হয়। আর এসব কাজে সহযোগী হলো অডিট ফার্ম। সততাকে জলাঞ্জলি দিয়ে (কমপ্রোমাইজ করে) এসব নিরীক্ষক আনডিউ বেনিফিট বা নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নিয়ে নিজেরা কালোটাকার মালিক হয়েছে।
এ ছাড়া এফআরসির অনুসন্ধানে উঠে আসে নিয়ম ভেঙে নিরীক্ষা ফি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ নগদ নেওয়ার চিত্র। নিরীক্ষকরা কর ফাঁকি দিতে এ পথ অবলম্বন করে থাকেন। এমন অভিযোগও পেয়েছে এফআরসি, যেখানে একাধিক নিরীক্ষক ফি বাবদ নিয়েছেন ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু ভাউচারে স্বাক্ষর করতে চাননি। একপর্যায়ে একজন সাড়ে ১১ হাজার টাকার একটি পে-অর্ডার ইস্যু করতে অনুরোধ জানিয়ে সমপরিমাণ টাকা নেওয়ার ভাউচার স্বাক্ষর করেছেন।
এ ব্যাপারে এফআরসি চেয়ারম্যান ড. মো. হামিদ উল্লাহ ভূঁঞা খবরের কাগজকে বলেন, এতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে তারা সরকারকে কীভাবে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছে। তিনি বলেন, অনুসন্ধানে অনিয়ম ও কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িতদের নিবন্ধনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এফআরসি চেয়ারম্যান বলেন, অনুসন্ধানে ১৮টি ফার্মের কর ফাঁকির ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। তাদের কাছেই গত তিন বছরেই সরকারের রাজস্ব পাওনা আছে প্রায় ৮-৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া আরও আছে।
ড. হামিদ উল্লাহ বলেন, ‘এফআরসি নতুন প্রতিষ্ঠান। আগামী দিনে অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে।’
তিনি জানান, এফআরসিতে নিবন্ধিত না হলে নিরীক্ষক ও ফার্ম কোনো ‘জনস্বার্থ সংস্থা’য় নিরীক্ষণ করতে পারবে না।
এফআরসিতে কী আছে?
ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল ২০১৫ গেজেট সংখ্যা অক্টোবর ২৩, ২০২৩ অনুযায়ী ‘জনস্বার্থ সংস্থা’ বলতে বোঝায় যেখানে সর্বনিম্ন ৫০ জন বেতনভোগী জনবল রয়েছে।
কাউন্সিল (এফআরসি) বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়োজিত জনবলের ভিত্তিতে উহাকে জনস্বার্থ সংস্থা হিসেবে নির্ণয়ের লক্ষ্যে উক্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের জনবলের তালিকা, নিয়োগবিধি, নিয়োগ বহি, বেতন বহি, পে-রোল, হিসাব বিবরণী, আর্থিক বিবরণী, নিরীক্ষা বিবরণী, প্রভিডেন্ট ও গ্র্যাচুইটি ফান্ড বা অন্যান্য তথ্য কাউন্সিলে জমা প্রদান বা দাখিলের আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।
উপ-প্রবিধান (৩)-এর (২) ধারা অনুসারে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান উপ-প্রবিধান (২)-এর অধীন চাহিত তথ্য বা দলিলাদি সরবরাহ না করলে কাউন্সিল উহার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।