দেশের ব্যবসায়ীদের কর দেওয়ার তথ্য খতিয়ে দেখে ২০২২-২৩ করবর্ষের জন্য এনবিআর কাউছ মিয়াকে ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে সেরা করদাতা নির্বাচন করেছে।
সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা নিয়েও দেশের নামিদামি অনেক ব্যবসায়ী বছরের পর বছর কর ফাঁকি দিয়ে চলেছেন। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তারা প্রযোজ্য কর পরিশোধ করছেন না। বকেয়া কর আদায়ে এসব ব্যবসায়ীর নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মামলাও করে থাকে। এসব এখন দেশের ‘প্রচলিত কর সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া ব্যতিক্রম।
ডিসেম্বরের প্রথম ভাগে এনবিআর বড় আয়োজনে অনুষ্ঠান করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত সেরা করদাতাদের ট্যাক্স কার্ড দিয়ে সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাউছ মিয়াসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আরও যাদের এনবিআর সেরা করদাতা হিসেবে নির্বাচন করেছে তাদের নামের তালিকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় তালিকা থেকে কারও নাম বাদ দেওয়ার আইনি ক্ষমতা রাখে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সেরা করদাতা নির্বাচন করা হয়।
এবার নিয়ে ১৫ বার সেরা করদাতা হতে যাচ্ছেন কাউছ মিয়া। গত ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে কর দিয়ে আসছেন তিনি।
ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া হাকিমপুরী জর্দার স্বত্বাধিকারী। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন। পুরান ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডে হাকিমপুরী জর্দা কারখানা অবস্থিত।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, দেশের অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত গুলশান-বনানী-বারিধারায় বড় পরিসরে জাঁকজমক অফিসে বসে ব্যবসা করেন এমন অনেক নামিদামি ব্যবসায়ী নিয়মিত কর দেন না। অথচ পুরান ঢাকার এই ব্যবসায়ী নিজ উদ্যোগে বছরের পর বছর ঠিকভাবে কর দিয়ে আসছেন। কর দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে ট্যাক্স কার্ড দেওয়া হয়। এ থেকে বড় ব্যবসায়ীদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
এর আগে একবার ট্যাক্স কার্ড পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া বলেছিলেন, ‘ব্যবসার শুরুতে কর দেওয়া বা ব্যাংকে টাকা রাখা কোনোটিই করিনি। এতে হিসাব রাখতে সমস্যা হতো। ব্যবসা বাড়তে থাকলে সরকারের এ সংস্থা, সে সংস্থা থেকে খোঁজখবর নিতে আসত। ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারতাম না। ঠিক করলাম এত লুকোচুরির কী আছে? আয় করব, প্রয়োজনমতো খরচ করতে হবে। সেই ১৯৫৮ সাল থেকে নিয়মিত কর দেওয়া শুরু করি। ব্যাংকেও টাকা রাখতে থাকি। কর দিলে টাকা হোয়াইট (বৈধ) হয়ে যায়। তখন যা আয় করি তাই প্রকাশ করা যায়। বৈধভাবে টাকা খরচে বাধা থাকে না। এ জন্যই আমি সব সময় কর দিয়ে থাকি। আমি বহু বছর থেকে নিয়মিত কর দিয়ে দেশের উন্নয়নে শরিক হয়েছি। কর দিলে সম্মান বাড়ে।’
২০২১-২২ করবর্ষের জন্য ১৪১ জনকে শীর্ষ করদাতা নির্বাচিত করা হয়েছিল। গত অর্থবছর করদাতাদের কর পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখে ব্যক্তিপর্যায়ে ৭৬ জন এবং কোম্পানি পর্যায়ে ৫৩ জনকে এবং অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ১২ জন; মোট ১৪১ জনকে সেরা করদাতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিটি জেলা ও সিটি করপোরেশনের সেরা করদাতাদের আঞ্চলিকভাবেও সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, এনবিআর কাউছ মিয়াকে ব্যবসায়ী ক্যাটাগরিতে সেরা করদাতা নির্বাচন করেছে। এ তালিকায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আরও অনেকে আছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআরের তালিকা চূড়ান্ত ধরে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে।
ট্যাক্স কার্ডের মেয়াদ থাকবে এক বছর। ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া এই কার্ডপ্রাপ্তির কারণে বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবেন। সংশোধিত জাতীয় ট্যাক্স কার্ড নীতিমালা ২০১০ অনুসারে সেরা করদাতা নির্বাচন করা হয়।
নীতিমালা অনুযায়ী, ট্যাক্স কার্ডধারী হওয়ায় কাউছ মিয়া বিভিন্ন রাষ্টীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাবেন। সড়ক, বিমান, নদীপথে ভ্রমণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকিট পাবেন। হোটেল-রেস্তোরাঁয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা পাবেন। বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। তিনি ও তার পরিবার চিকিৎসায় হাসপাতালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শয্যা সুবিধা পাবেন।
কাউছ মিয়ার বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা করেন। তার বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। চাকরি করবে। কাউছ মিয়া নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের কারণে তার পড়াশোনা আর হয়ে ওঠে না। কাউছ মিয়া ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার সহযোগিতা না পেলেও তার মা ছেলের ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে আসেন। বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাউছ মিয়া তার মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরান বাজারে মুদি দোকান দেন। প্রথম দিকে মালপত্র খুব বেশি কিছু ছিল না। তবে ভালো ব্যবহার এবং ভালো জিনিসটি বিক্রির কারণে ক্রেতা বাড়তে থাকে। দোকানে মালপত্রও বাড়াতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং তামাকের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে ৪০-৪৫ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। তবে এখনো কাউছ মিয়ার অন্যতম ব্যবসা তামাক বেচাকেনা। নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্য তার কয়েকটি কার্গো জাহাজ রয়েছে। কার্গো ব্যবসায়ে তার ছেলেরা যোগ দিয়েছেন।