![ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন: কাউন্টারে সিট নেই, ভরসা সিন্ডিকেটে](uploads/2024/06/30/Mymensing-Railway-Station-T-1719717209.jpg)
অনলাইনে ট্রেনের টিকিট না পেয়ে অনেকেই আসছেন স্টেশনের কাউন্টারে। সেখানে টিকিট কাটতে পারলেও সিট পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কাউন্টারের একটু বাইরে দাঁড়ালেই দেখা মেলে কয়েকজন ব্যক্তির। কেউ টিকিট কাটতে এলেই তাকে জানানো হয়- নিজের জন্য তারা টিকিট কেটেছিলেন, ব্যক্তিগত কারণে ভ্রমণ বাতিল করেছেন। কেউ বেশি টাকা দিলে সিটসহ টিকিট দেওয়া হবে। গত ২২ জুন বিকেলে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে গেলে এমন ঘটনার দেখা মেলে।
প্রতিদিন এই স্টেশন থেকে আটটি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, অগ্নিবীণা, হাওর, জামালপুর, মোহনগঞ্জ ও বিজয় এক্সপ্রেস। এসব ট্রেনে যাতায়াত করতে স্টেশনে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার যাত্রী আসেন। এর বিপরীতে আসনসহ টিকিট থাকে মাত্র ২৩৭টি! আর সিট ছাড়া কাউন্টারে টিকিট বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৭০০টি। সিটগুলোর বেশিরভাগ কালোবাজারি সিন্ডিকেট চক্র নানা কায়দায় তাদের কব্জায় নিয়ে নেয়। এরপর বেশি দামে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করে। আর এই চক্রের সঙ্গে জড়িত খোদ রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মচারী।
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইনে টিকিট ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ফলে শত শত যাত্রী কাউন্টারে এসে ভিড় করেন। সেখানে মোট বরাদ্দের অর্ধেক সিট থাকার কথা থাকলেও হাতে গোনা কিছু যাত্রী সিটসহ টিকিট পেয়ে থাকেন। ফলে বাধ্য হয়ে বাকিদের সিট ছাড়া টিকিট কিনতে হয়। কখনো আবার আসনবিহীন টিকিটও পাওয়া যায় না। তবে কাউন্টারের বাইরে খোলাবাজারিদের কাছে টাকা দিলেই মেলে আসনসহ টিকিট।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্টেশনে হাজারও যাত্রী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রীরা হুড়াহুড়ি শুরু করেন। তখন একজনকে টিকিট কেটেছেন কি-না জিজ্ঞেস করলে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে একপলক তাকিয়ে জানান তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ইকবাল বাহার নামের ওই যাত্রী বলেন, ‘অনলাইনে টিকিট ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কাটতে হয়; তা না হলে টিকিট আর পাওয়া যায় না। কাউন্টার থেকেও আসনসহ টিকিট পাইনি। কাউন্টারের পাশেই একজন বললেন, ব্যক্তিগত কারণে তিনি ভ্রমণ বাতিল করেছেন। তার কাছে আসনসহ টিকিট আছে। তিনি এটা বিক্রি করবেন। পরে নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে টিকিটটি কিনে নিই।’
আশরাফুল আলম নামে আরেক যাত্রী বলেন, ‘এই স্টেশনে এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় টিকিট কালোবাজারি বেড়ে গেছে। তাদের কাছে যাওয়া ছাড়া এখন সিটসহ টিকিট পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রশাসন জোরালো অভিযান চালালে কালোবাজারি বন্ধ হবে। তখন যাত্রীরা স্বস্তিতে ভ্রমণ করতে পারবেন।’
তবে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, এই স্টেশনের জন্য বরাদ্দ ২৩৭টি টিকিটের অর্ধেক প্রতিদিন অনলাইনে বিক্রি হয়, বাকিগুলো পাওয়া যায় কাউন্টারে। ঈদযাত্রা উপলক্ষে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয়েছে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধে সব সময় তৎপর রয়েছেন!
যদিও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। আসনসহ টিকিটগুলোর বেশির ভাগই কালোবাজারি চক্রের কব্জায় চলে যায়। স্টেশন কর্মচারীদের (কাউন্টারের বুকিং সহকারী) বেশ কয়েকজন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারাই কালোবাজারি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন কৌশলে কাউন্টারের টিকিটগুলো সিন্ডিকেটের হাতে পৌঁছে দেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, কাউন্টারে দায়িত্ব পালনের সময় রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মচারী টিকিটপ্রত্যাশী যাত্রীদের মোবাইল ও জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নম্বর কৌশলে সংগ্রহ করেন। এরপর এগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করে নিজেদের কাছে রেখে দেন। সুযোগ বুঝে ওই যাত্রীদের এনআইডি ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট কেটে কালোবাজারি সিন্ডিকেটের কাছে সরবরাহ করেন।
চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে স্টেশনে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় রেলওয়ের কর্মচারী (বুকিং সহকারী) রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় কালোবাজারির ১২টি টিকিট, পাঁচ হাজার ১০০ টাকা, দুটি মোবাইল ফোন, সাধারণ যাত্রীদের এনআইডি ও মোবাইল নম্বরের তালিকা। যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর তিনি সাদা কাগজে সংরক্ষণ করে রাখতেন। পরে ওই নম্বর ব্যবহার করে টিকিট কেটে কালোবাজারি চক্রের কাছে বিক্রি করে দিতেন। ওই অভিযানের পর কয়েক মাস কালোবাজারি চক্র নিষ্ক্রিয় থাকলেও ধীরে ধীরে তারা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রেলওয়ে স্টেশনে টিকিট কালোবাজারির দৌরাত্ম্য লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছে। সাধারণ যাত্রীরা এখন তাদের কাছে জিম্মি। সংশ্লিষ্টরা হঠাৎ একদিন অভিযান চালিয়ে দীর্ঘদিন চুপ থাকেন। ফলে টিকিট কালোবাজারি চক্র দিন দিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে। এসব অপরাধের সঙ্গে রেলওয়ের কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।’
ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক বলেন, ‘কালোবাজারি চক্র অগোচরে টিকিট বিক্রি করতে পারে। এটি আমি একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। তবে রেলওয়ের কোনো কর্মচারী যেন এই কাজের সঙ্গে জড়িত না হন, সে জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্টেশনে জিআরপি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী আছে, এসব দেখা তাদের দায়িত্ব। আমিও চাই কালোবাজারি চক্রের সঙ্গে জড়িতরা আইনের আওতায় আসুক।’
স্থানীয় রেলওয়ে থানার ওসি মামুন রহমান বলেন, কালোবাজারি চক্রের সদস্যরা খুবই ধূর্ত। এসব টিকিট বিক্রির সময় তাদেরকে নিশ্চিত হয়ে ধরতে হয়। অপরাধীদের শনাক্ত করতে চেষ্টা চলছে।
ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি ফারুক হোসেন বলেন, রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হবে। কালোবাজারে টিকিট বিক্রির প্রমাণ মিললে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হবে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা বের করতে গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে।