![সক্রিয় আনসার আল-ইসলাম, ভারতেও চালাচ্ছে জঙ্গি তৎপরতা](uploads/2024/07/01/ansar-1719814842.jpg)
দেশে থেমে থেমে জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। একেকটি জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ করার পর আরেকটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এসব জঙ্গি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে ভার্চুয়ালি (অনলাইন) যুক্ত। অনলাইনে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও টেলিগ্রাম অ্যাপস বা অন্য কোনো নতুন অ্যাপসের মাধ্যমে ছদ্মনামে তারা প্রচার চালাচ্ছে। অনলাইনে প্রচারণা চালানোর পর জঙ্গিরা যখন বাস্তবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যায়, ঠিক তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। সম্প্রতি জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামের বেশ কয়েকজন সদস্য ধরা পড়ার পর গোয়েন্দারা বলছেন, বর্তমান সময়ে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলাম বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা দেশ-বিদেশে উগ্রবাদী মতবাদের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও নানামুখী সন্ত্রাসী হামলার ছক এঁকে উসকানিমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডসহ বিভিন্নভাবে সক্রিয় হয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে ৩২৫ জন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ ও র্যাবের সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৪২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে র্যাবের অভিযানে ১২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি ৩২০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিট।
এদিকে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) একটি সূত্র খবরের কাগজকে জানায়, চলতি ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠনের ১৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে এটিইউ।
জঙ্গিদের এমন তৎপরতা ও সার্বিক বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসির প্রধান) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সিটিটিসির গোয়েন্দারা জঙ্গি দমনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। আমরা জঙ্গিদের বিভিন্নভাবে মনিটরিং করি। জঙ্গিরা একশ্রেণির মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তাদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করে। এদের কাজ হলো উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচার ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করার চেষ্টা। এরা যেকোনো সময় সক্রিয় হতে পারে। তবে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামের সদস্যরা আমাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। তাদের কার্যক্রম নিয়ে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছেন।’
নিষিদ্ধঘোষিত এই জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল-ইসলাম’ ভিন্ন নামে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দারা বলছেন, সম্প্রতি ‘আস-শাহাদাত’ ওরফে ‘আনসার আল-ইসলাম’ গ্রুপের নামে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহসহ নানা তৎপরতার সময় তিন জঙ্গি সদস্যকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব-৭।
তাদের ধরার পর র্যাব জানায়, বর্তমান সময়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলাম। তারা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে র্যাব-৭-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. শরীফ উল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য শিক্ষিত ও উগ্র উঠতি বয়সীদের আকৃষ্ট করে দেশ-বিরোধিতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা ও বেশ কিছু তথ্য স্বীকার করেছে। সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জঙ্গিরা বিভিন্ন সময় অনলাইনে বিভিন্ন উগ্রবাদী নেতার উসকানিমূলক বক্তব্য শুনে ও দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ওই সংগঠনে যোগ দেয়। পরে তারা ‘আনসার আল-ইসলাম’-এর মতাদর্শে পরিচালিত নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘শাহাদাত’ গ্রুপের নামে সদস্য সংগ্রহ ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। এরা বেশ ভয়ংকর। আনসার আল-ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। সংগঠনের সদস্যদের তারা বিভিন্ন উগ্রবাদী পুস্তিকা, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করে কাজ করে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তারা মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করত এবং সংগঠনের সদস্যদের শারীরিক প্রশিক্ষণ দিত। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, সাতক্ষীরাসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকাকে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য টার্গেট করে কাজ করছে।
অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস উইংয়ের পুলিশ সুপার ব্যারিস্টার মাহফুজুল আলম রাসেল খবরের কাগজকে বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠন আনসার আল-ইসলামের সদস্যদের আমাদের এটিইউ নজরে রাখছে এবং তাদের ধরতে আমাদের গোয়েন্দাদের বিভিন্ন অভিযান চলমান রয়েছে।’
জঙ্গিরা সম্প্রতি তাদের সাংগঠনিক ও নানা বিষয় নিয়ে তৎপর হচ্ছে- এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমাদের সাইবার ইউনিটও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। জঙ্গিরা যাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে কোনো ধরনের নাশকতা করতে না পারে, সেই বিষয়ে লক্ষ রেখে আমরা সতর্ক আছি এবং কাজ করছি।’
এদিকে দেশের বাইরেও কর্মপদ্ধতিতে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এনেছে আনসার আল-ইসলাম। সম্প্রতি শাহাদাত সংগঠনের তিনজন সদস্যকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে এমনটাই মনে করছেন সে দেশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের (এসটিএফ) কর্মকর্তারা।
এসটিএফ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে জেএমবির নেটওয়ার্ক দুর্বল হতেই তার জায়গা নিয়েছিল নব্য জেএমবি ও আনসার জঙ্গিরা। তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ অঞ্চলে বাংলাদেশি সংগঠন আনসার আল-ইসলাম জঙ্গিগোষ্ঠী কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে তাদের নেটওয়ার্ক পাকাপোক্ত করে।
আনসার আল-ইসলাম সংগঠনটি ভারতের মাটিতে মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীদের নিশানায় রাখলেও প্রকাশ্যে এখনো খুনখারাবি করেনি। বরং তাদের লক্ষ্য, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেদের সংগঠনে যুব সমাজের একটা অংশকে টেনে আনা।
পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশি যুক্তিবাদী লেখকদের ওপর হামলা অনেকটাই কমে এসেছে। আনসার আল-ইসলাম সেই সময় থেকে বাংলাদেশ লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গ, আসমসহ বিভিন্ন রাজ্যে জাল ছড়িয়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, ভারতে একশ্রেণির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করার কাজটি নিঃশব্দে করে চলেছে আনসার আল-ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠন। নীতিগত দূরত্ব থাকলেও জেএমবি জঙ্গি সংগঠনের ভারতীয় শাখা জেএমএইচের সাহায্যও পাচ্ছে আনসার আল-ইসলাম।
ভারতে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ও সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের যোগাযোগ নিবিড়। ভারতের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রবলভাবে সক্রিয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে।