![সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দাখিলের দাবি সর্বমহলে](uploads/2024/06/30/govtjob-1719724489.jpg)
সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান নিয়ে আবার বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে কথা উঠেছে। এমনকি বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং ছাগলকাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিলের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের দুজন সংসদ সদস্য। গত ২৫ জুন ২০২৪-২৫ সংসদে সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কমেনি। সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সম্পদের হিসাব দাখিল বাধ্যতামূলক করার জোরালো দাবি জানান তিনি। একই দাবি জানিয়ে সরকারি দলের অপর সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন বলেন, শহরের ৯০ শতাংশ বাড়ি হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের। এত বাড়ি, এত জমি হলো অথচ গোয়েন্দারা কেউ টের পেল না।
উচ্চমাত্রার দুর্নীতি কমাতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে প্রতিবছর সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। বাংলাদেশ বিষয়ে আইএমএফের কান্ট্রি রিপোর্টে এ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার বাংলাদেশের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের অনুমোদনের দিনে কান্ট্রি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এমন একসময়ে এ পরামর্শ দিল আইএমএফ, যখন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও এনবিআর থেকে প্রত্যাহারকৃত সদস্য মতিউর রহমানের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ খুঁজে বের করতে তদন্ত চলছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ২০২২ সালের ১৬ জুন জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাবের বিবরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে আচরণ বিধিমালা-১৯৭৯ হালনাগাদ করা হচ্ছে। দুই বছর পার হলেও বিধিমালাটি চূড়ান্ত করা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল নিশ্চিত করতে পারলে অপরাধ ও দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হলে তাদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করতে হবে। আয়কর রিটার্নে সম্পদের হিসাব বিবরণীর তথ্য থাকে। যদি কেউ না দিয়ে থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
তিনি মনে করেন, সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করা হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে ভয়ভীতি কাজ করবে। এতে করে দুর্নীতি কমবে।
সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পরপর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান ১৯৭৯ সালে চালু করা হয়। দেশে বর্তমানে ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবী আছেন। চাকরিজীবীদের জবাবদিহি নিশ্চিতে আচরণ বিধিমালায় এ নিয়ম যুক্ত করা হয়। কিন্তু চার দশক ধরে এই নিয়ম পুরোপুরি প্রতিপালন করা যায়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছর পর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সরকারি চাকরিজীবীর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। কিন্তু ৪৩ বছর আগের এ বিধানকে মানছেন না সরকারি চাকুরেরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় দুর্নীতি বন্ধে সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। এর মধ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়ার বিষয়টিও ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ওই অনুশাসন প্রতিপালন করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এরপর কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু এত বছর অতিক্রম করার পরও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন হয়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বর্তমানে ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ লাখ। তাদের প্রত্যেককে যদি মূল্যায়ন না করা হয়, তাহলে সম্পদের হিসাব জমা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। অনেকে আছেন, যারা নিজের নামে সম্পত্তি করেন না। তাই সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করা হলেই যে দুর্নীতি প্রতিরোধ হবে, এটিকে আমি কার্যকর পদক্ষেপ মনে করি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু সম্পদের হিসাব জমা দিয়ে লাভ নেই। যারা দুর্নীতি করছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে আমরা সবাই জানি। ওই সব জায়গায় দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে পারলে সেটি হবে কার্যকর পদক্ষেপ।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণায়ের একটি সূত্র বলেছে, বিদ্যমান ১৯৭৯ সালের সরকারি আচরণ বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। সেখানে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বলা হয়, ‘সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময় এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু নিয়মিত এ বিধানাবলি অনুসরণ করে হিসাব দাখিলের প্রশাসনিক চর্চা নেই। তবে এ অচল অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-২০২২-এ আয়কর রিটার্ন স্লিপ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।’
সম্পদের হিসাব দাখিলের নিয়ম শিথিল করা হয়েছে: ২০২৩ সালের নভেম্বরে সরকারি চাকরিজীবী আচরণ বিধিমালা সংশোধনের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাবে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যারা নিয়মিত এনবিআরে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, তাদের আলাদাভাবে কোনো সম্পদের হিসাব জমা দিতে হবে না। সরকার প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর এনবিআরে দাখিল করা সম্পদের হিসাব বিবরণী সংগ্রহ করবে। জানা গেছে, প্রস্তাবিত সংশোধনী এনবিআরের সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা যাচাই- বাছাই করছে আইন মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টদের সম্মতি পাওয়া সাপেক্ষে বিধিমালাটি বাস্তবায়ন হলে সরকারি চাকুরেদের আলাদা করে সম্পদের হিসাব দিতে হবে না। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংশোধিত বিধিমালা কার্যকর হলে সম্পদ বিবরণী দাখিলের প্রক্রিয়া আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং দুর্নীতি বাড়বে। কারণ সরকারি চাকরি বিধিমালা প্রণয়নের সময় আয়কর রিটার্ন ছাড়াও সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিধান করা হয়েছিল এবং বর্তমানেও সে যৌক্তিকতা ফুরিয়ে যায়নি।
জটিলতা বাড়বে: এনবিআর সূত্র বলেছে, সংশোধিত বিধিমালাটি চূড়ান্ত হলে আইনি জটিলতা বাড়বে। বিদ্যমান এনবিআরের আইন অনুযায়ী, আয়কর বিবরণীতে জমা দেওয়া তথ্য সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতা আছে এবং তা প্রকাশও করা যাবে না। এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আদালত চাইলে কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো রাষ্ট্রীয় তদন্তকারী সংস্থা চাইলেই কেবল ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার যেকোনো তথ্য প্রদান করতে পারে এনবিআর। সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন এই নিয়ম বদলে ফেলা হয়েছে। সে অনুযায়ী এনবিআর নিজেই এখন তাদের সম্পদ বিবরণী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবে। অভিযোগ আছে, একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এনবিআরে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে প্রকৃত সম্পদ দেখান না। বেনামে সম্পদ লুকিয়ে রাখেন।
আচরণবিধি অনুযায়ী সব সরকারি চাকরিজীবীর সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। যাদের টিআইএন আছে এবং ৪০ লাখ টাকার বেশি সম্পদধারী কিংবা বাড়ি-গাড়ি আছে, এমন সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিজীবীদের আলদাভাবে সম্পদ হিসাব জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। বর্তমান আয়কর আইনে রিটার্ন দাখিলের সময় সম্পদের হিসাব বিবরণী দিতে হয়।
সরকার যদি এই তথ্য চায়, তাহলে এনবিআর দিতে বাধ্য থাকবে। এর বাইরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পৃথকভাবে সম্পদের হিসাব দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তিনি বলেন, বিদ্যমান আয়কর আইনে কোনো ব্যক্তি করদাতার তথ্য দেওয়ার নিয়ম নেই। সরকার যদি চায় তাহলে আইন সংশোধন করতে পারে। আসলে সরকার কী চায়, তার ওপর নির্ভর করছে বিষয়টি।