![লক্কড়-ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে অভিযান,দৃশ্যমান নয় বিআরটিএর তৎপরতা](uploads/2024/07/01/bus-1719805459.jpg)
রাজধানীর সড়ক থেকে রংচটা ও লক্কড়-ঝক্কড় বাস সরাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল তার মেয়াদ ফুরিয়েছে রবিবার (৩০ জুন)। রাজধানীর সড়কে দৃষ্টিনন্দন ও নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সোমবার (১ জুলাই) থেকে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিল, তার সিকিভাগও দৃশ্যমান হয়নি।
রবিবার বিআরটিএ ঢাকা সার্কেল অফিস ও বিআরটিএ প্রধান কার্যালয়ে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ (সোমবার) থেকে বিআরটিএর যে অভিযান শুরুর কথা ছিল, তাতে তেমন গতি নেই।
আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর সড়কে ৩৮৪টি কোম্পানির প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাস চলাচল করে, যা বিআরটিএর রুট পারমিট শাখায় নিবন্ধিত। বিআরটিএ ঢাকা সার্কেলের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার কর্মকর্তারা রবিবার জানিয়েছেন, বিআরটিএর গণবিজ্ঞপ্তি জারির পরে গত মে মাসে ৩৪৮টি আর জুন মাসে ৪৭৫টি বাস ফিটনেস নবায়ন করা হয়েছে। এ হিসাবে নগর পরিবহনের মাত্র ২৩ দশমিক ৫১ ভাগ বাস ফিটনেস নবায়ন করে নিয়েছে। প্রায় ৭৭ ভাগ বাস ফিটনেস নবায়ন না করায় সড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়ার উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়িত হবে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিআরটিএর হিসাবেই দেখা যাচ্ছে কতসংখ্যক বাস ফিটনেস নবায়ন করে নেয়নি। এখন এই ফিটনেসবিহীন বাসগুলো সড়কে তো আর চলতে পারবে না চলতি অভিযানে। এতে রাজধানীর সড়কে গণপরিবহন সংকট দেখা দেবে। রাজধানীর যাত্রীরা বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে তখন ছোট ছোট যানবাহনের ওপর ভরসা করবেন। এই সুযোগে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও উবার ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে নেবে। নগরে তখন গণপরিবহন ব্যবস্থায় বড় সংকট দেখা দেবে।’
বাস্তবতা বুঝতে পারছেন বিআরটিএর কর্মকর্তারাও। বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট বিভাগ আজ থেকে চারজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রাজধানীর সড়কে অভিযান পরিচালনা করবে বলে জানিয়েছেন এই বিভাগের উপপরিচালক মো. হেমায়েত উদ্দিন। পরে জানা যায়, এই অভিযানে বাস আটক করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে বিআরটিএ। বরাবরের মতো জরিমানা আদায় করে বাসচালকদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরীর কথাতেও তার আভাস মেলে। তিনি রবিবার বিকেলে খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিআরটিএ যে নির্দেশিকা জারি করেছিল, তার মেয়াদ ফুরিয়েছে আজ (রবিবার)। আমরা এখন অভিযানে নামব। তবে তার আগে সর্বশেষ আরও একবার আমরা বাসমালিকদের সঙ্গে বসব। তারা কারা কথা রেখেছে, কারা কতটা বাস ফিটনেস করে নিয়েছে নতুন করে তার তালিকা আমরা নেব। যারা কথা রাখেনি, আমরা সেসব বাসমালিকদের বিরুদ্ধে অভিযানে যাব।’
এক দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় রুট অনুযায়ী গণপরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট রং নির্ধারণ করত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির নিয়ম অনুযায়ী কোনো বাসের রং উঠে গেলে সেটি চলাচলের অনুপযোগী হবে। কিন্তু সেই নীতিমালার তোয়াক্কা করছেন না বাসমালিকরা।
বিআরটিএর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে চলমান বাস-মিনিবাসের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ বাসের দরজা-জানালা ভাঙা, বসার সিট ছেঁড়া। ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসের সিটে স্টিল, ফোম, কাপড় নেই। আর যেসব বাসে স্টিলের কাঠামোর ভেতর ফোম বা কাপড়ের স্তর রয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই ছেঁড়া। অধিকাংশ বাসের পেছনের সিগন্যালিং লাইটগুলো অকেজো। কয়েকটি বাস-মিনিবাসে পাখা থাকলেও অধিকাংশই নষ্ট। বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীতে চলাচলকারী বাসগুলোর অর্ধেকের বেশি বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (২০ বছর) পেরিয়ে গেছে।
গত মার্চ মাসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, বায়ুদূষণ রোধে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ইকোনমিক লাইফ অতিক্রান্ত ২০ বছরের অধিক বয়সী বাস প্রত্যাহার করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে ৮ এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ওই বয়সী বাসের তালিকা পাঠাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, পরিবহন মালিক সমিতি ২০ এপ্রিলের মধ্যে ২০ বছরের বেশি বয়সী বাস প্রত্যাহারের পরিকল্পনা দেবে। খবর নিয়ে জানা গেছে, বিআরটিএ এখনো সেই তালিকা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দেয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি মাহবুবুর রহমানও দায় স্বীকার করে নেন।
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢাকার সড়কে কোন কোম্পানির কতগুলো বাস চলে, কতগুলো গাড়ি ওয়ার্কশপে আছে, আমরা বিআরটিএকে সে তালিকা দিয়েছি।’ রংচটা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকা জমা দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।
বিআরটিএর সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘আর এক দিনও সময় আর বাড়ানো ঠিক হবে না। ১ জুলাই থেকে সড়কে লক্কড়-ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা দরকার। সড়ক থেকে এসব বাস তুলে নিতে পরিবহন মালিকরা নিজেরা অনেক সময় নিয়েছেন। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কমিটির সভায় বাসমালিকরা এক মাস সময় বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সময় না বাড়িয়ে এখন জোরদার অভিযান শুরু করা হবে।’
ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস উঠিয়ে নেওয়ার আগে বিকল্প গণপরিবহনের জোগান নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঢাকার নগর পরিবহনব্যবস্থা সমন্বয়ের লক্ষ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশনের যে পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেটি তো শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তাতে যে ঘাটতি থেকে গেছে তার মাশুল দিতে হবে এখন।’
ঢাকার সড়কে গণপরিবহন সমন্বয়ের দায়িত্ব মূলত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। বিআরটিএ ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস তুলে নিতে যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে ডিটিসিএকে যুক্ত না করায় সরকারি দপ্তরের সমন্বয়হীনতার চিত্র আরও বড় আকারে ফুটে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
রাজধানীর গুলশান, বনানী ও হাতিরঝিলের বাসের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে বাস নামানোর জন্য এখন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা উচিত সরকারের। ঢাকার সড়কে এত যাত্রী। অনেক কোম্পানি লাভের আশাতেই ঢাকার সড়কে উন্নতমানের বাস নামাবে, ভালো সেবা দিতে চাইবে। ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে এত এত কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয়নি। আমি মনে করি, মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ঢাকার সড়কব্যবস্থার চিত্র আমূল বদলে যাবে। এত বছর যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেখানে এই অঙ্কটা খুব বড় নয়।