![অগ্নিঝুঁকিতে চট্টগ্রামের ১৫৫ মার্কেট](uploads/2024/07/02/ctg-1719891804.jpg)
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ভবনটি নগরের কোতোয়ালি মোড়ে অবস্থিত। এর পাশেই রয়েছে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আদালত চত্বর। সেখান থেকে একটু দূরেই জেলা কারাগার। এ ছাড়া জেলার গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশাসনিক দপ্তরের কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হয়। প্রতিদিন লাখো মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই কোতোয়ালি এলাকা। কিন্তু এই জায়গাটিই শহরের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান! প্রশাসনিক দপ্তরগুলোর চারপাশে রয়েছে কয়েকটি বৃহৎ বাজার। এর মধ্যে রিয়াজুদ্দিন বাজার, টেরিবাজার ও পৌর জহুর হকার্স মার্কেট অন্যতম।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, এই তিনটি বাজারকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় ১৫৫টি মার্কেট গড়ে উঠেছে। এর সব কটিই রয়েছে অগ্নিঁঝুকিতে। যেকোনো সময় আগুন লেগে এখানে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে দোকান মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে প্রতিকারের উপায়। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আইন প্রয়োগকারী সংস্থা না হওয়ায় কেউ তাদের পাত্তা দেয় না!
মার্কেটসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, যখন মার্কেটগুলোর ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন কোনো স্থপতির পরামর্শ নেওয়া হয়নি। রাজমিস্ত্রীনির্ভর তৈরি হওয়া এসব ভবন একবারে ভেঙে ফেলাও সম্ভব নয়। তাই অগ্নিঝুঁকি কমাতে বিকল্প উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, কোতোয়ালি থানা এলাকায় রিয়াজুদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক মার্কেট আছে ৭৮টি। এর মধ্যে দোকান রয়েছে ১৩ হাজার ৫৪৭টি। পৌর জহুর হকার্স মার্কেটকেন্দ্রিক পাঁচটি মার্কেটের ১ হাজার ৪৬১টি দোকান রয়েছে। আর টেরিবাজারকেন্দ্রিক ৭২টি মার্কেট থাকলেও দোকানের সংখ্যা জানা যায়নি।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন, ‘অনেকের জীবন-জীবিকার শেষ সম্বল বারবার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে। তবুও তাদের (দোকান মালিক) হুঁশ ফিরছে না। একটি মার্কেট ঝুঁকিমুক্ত থাকলে সেখানে ব্যবসা বাড়ে, এই বিষয়টি অনেকে বুঝতে চান না।’
চট্টগ্রামের যেসব মার্কেট অগ্নিঝুঁকিতে আছে, সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত করার প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট সব সময় প্রস্তুত আছে বলে জানান তিনি।
‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির মহাসচিব এইচ এম মুজিবুল হক শাকুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো রয়েছে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে। তারপরও কর্তৃপক্ষগুলোর নজরে কেন আসে না তা চট্টগ্রামবাসীর বোধগম্য নয়।’ অবিলম্বে মার্কেটগুলো ঝুঁকিমুক্ত করার দাবি জানান তিনি।
মার্কেটের কাছে ফায়ার স্টেশন দাবি
চট্টগ্রাম জেলা দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ছালেহ আহমদ সোলেমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘রিয়াজুদ্দিন বাজার ও টেরিবাজারের ভবনগুলো অনেক পুরোনো। এসব মার্কেট যখন বানানো হয়েছিল তখন স্থপতি, প্রকৌশলী দিয়ে কেউ ভবনের নকশা করাতেন না। রাজমিস্ত্রিনির্ভর এসব ভবন ঝুঁকিমুক্ত বলার সুযোগ নেই। যখন মার্কেটগুলো বানানো হয়েছে তখন পরিকল্পনার অভাব ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু দোষারোপ করেই বসে থাকলে চলবে না। কারণ এতগুলো মার্কেট এই মুহূর্তে ভেঙে ফেলাও সম্ভব নয়। তাই কীভাবে কী করলে কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত করা যায়, সেই বিষয়ে সবার সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রতিটি মার্কেটের ছাদে পানির একটি রিজার্ভ ট্যাংক রাখা যেতে পারে। ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর নানা ইভেন্টের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। একবারের টাকা না হয় নিজেদের ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য খরচ করলেন।’
ছালেহ আহমদ বলেন, ‘যেহেতু অনেকটি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট এক জায়গায় রয়েছে, তাই এগুলোর পাশেই একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন করা জরুরি। তা ছাড়া চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্ণফুলী নদীর পানি হাইড্রেন্টে দিতে পারে। এই পানি শোধন করার প্রয়োজন নেই। মার্কেটের ভেতরের চলাচলের পথগুলো খুবই সরু। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ক্রেতারা বের হওয়া পথ খুঁজে পাবেন না।’
ফায়ার সার্ভিসকে কেউ পাত্তা দেয় না!
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক খবরের কাগজকে বলেন, জরিপ করে ব্যবসায়ীদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া সিডিএ, সিটি করপোরেশন, পিডিবিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।
তিনি জানান, এসব মার্কেটে পানিবাহী গাড়ি ঢোকার সুযোগ নেই। আগুন যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
সব মার্কেট ভেঙে নতুন করে নির্মাণের বিকল্প দেখছেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট নিয়ে মালিক সমিতির সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস বারবার বৈঠক করেছে। যেহেতু ফায়ার সার্ভিসের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, তাই কেউ এই সংস্থাকে পাত্তা দেয় না!’
সিডিএ চেয়ারম্যানকে অনুরোধের প্রতিশ্রুতি
সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী খবরের কাগজকে জানান, ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো নিয়ে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। রিয়াজুদ্দিন বাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওই মার্কেটের ভবনগুলো একটার সঙ্গে অন্যটা এমনভাবে লাগানো, দুজন মানুষ একসঙ্গে হাঁটতে পারে না। যেহেতু ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা সিডিএর, তাই তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
এ বিষয়ে তিনি সিডিএ চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করবেন বলে উল্লেখ করেন।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কার্যকর
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ জানান, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকা চেয়েছেন। তালিকা পেলে তার সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি বসবেন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তা কার্যকর করবেন।
ফায়ার সার্ভিসের সুরক্ষা পরামর্শ
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, পৌর জহুর হকার্স মার্কেটের সব ধরনের রান্নার চুলা এবং ওয়াটার হিটার অপসারণ করতে হবে। মার্কেটের ভেতরে চায়ের দোকানে সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, এগুলো বন্ধ করা জরুরি। এ ছাড়া মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণী সরঞ্জামাদি, হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা, পানির জলাধার রাখা হয়নি। বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ও ফিটিংস অভিজ্ঞ বিদ্যুৎ প্রকৌশলীর মাধ্যমে ছয় মাস পরপর চেক করতে হবে। মার্কেটের ভেতরে হোটেল, চায়ের দোকান এবং আবাসিক হোটেল বা আবাসন ব্যবস্থা রাখা যাবে না। মার্কেটের ছাদ সব সময় উন্মুক্ত রাখতে হবে।