![খুলনায় সিন্ডিকেটের কবলে নিয়োগ](uploads/2024/07/01/Khulna-Outsourcing-Syndicat-1719804214.jpg)
খুলনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতের আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে। একই ঠিকাদার ঘুষ দিয়ে কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বছরের পর বছর ধরে আউটসোর্সিং কাজ চালিয়ে নেন। কোনো ধরনের মনিটরিং না থাকায় কর্মচারী নিয়োগে অনৈতিক অর্থ আদায়, খেয়াল-খুশিমতো চাকরিচ্যুত ও বেতন না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চরম জনবলসংকটের কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হওয়ায় ঠিকাদারের মাধ্যমে সরকার অস্থায়ী ভিত্তিতে ওয়ার্ড বয়, আয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী ও মালি পদে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবছর দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগের কথা থাকলেও ২০১৯ সাল থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আউটসোর্সিং কর্মচারী দিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাছরাঙ্গা সিকিউরিটি সার্ভিসেস ও কন্ট্রাক ক্লিনিং সার্ভিসেস লিমিটেড। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই দুই প্রতিষ্ঠানেরই মালিক ঠিকাদার হেমায়েত হোসেন ফারুক।
একাধিকবার তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং পুলিশকে জানানো হলেও গোপনে তার প্রতিষ্ঠানের কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আউটসোর্সিং ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করা হলেও ঠিকাদারদের মধ্যে মারামারির ঘটনায় তা স্থগিত করা হয়। পরে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হলেও অনিবার্য কারণ দেখিয়ে তা আবারও স্থগিত করা হয়।
এ ছাড়া জেলা সিভিল সার্জন অফিসের আওতায় বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসে আউটসোর্সিং কাজে ঠিকাদার নিয়োগে ঘুষ গ্রহণ ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসের সাবেক উপপরিচালক শামসুদ্দীন মোল্লার বিরুদ্ধে আউটসোর্সিং ঠিকাদার নিয়োগে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি ও হয়রানির অভিযোগ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাকির উদ্দিন আহমেদ।
পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালককে দেওয়া লিগ্যাল নোটিশে তিনি বলেন, ‘কাজ পাইয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন উপপরিচালক শামসুদ্দীন মোল্লা। ঘুষের টাকা না দেওয়ায় দরপত্রে ঠিকাদারের সংযুক্ত করা কাগজপত্র সরিয়ে বাছাইয়ে তাকে হয়রানি করা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ওই দপ্তরে আউটসোর্সিং নিয়োগকাজ বন্ধ রয়েছে। ঘুষ দিলেই এই দপ্তরে কাগজপত্র ঠিকঠাক হয়ে যায়।’
সরকারি চাকরির প্রলোভনে অর্থ আদায়
এ ছাড়া হাসপাতালে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আউটসোর্সিং লট-৯৫-এ কর্মরত টেবিল বয় আদনান মাহমুদ জানান, মাছরাঙ্গা সিকিউরিটি সার্ভিসেস ও কন্ট্রাক ক্লিনিং সার্ভিসেস লিমিটেডের সীমাহীন দুর্নীতিতে বেতনহীন অবস্থায় অসংখ্য কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গত তিন বছরে তার ১৪ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির পরিচালক হেমায়েত হোসেন ফারুক তাকে সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাড়ে ৫ লাখ টাকা নেন। পরবর্তী সময়ে সরকারি চাকরি না দিয়ে আউটসোর্সিং কাজে নিয়োগ দেন। এর পরও হাসপাতালে কোনো হাজিরা খাতা না রেখে কর্মচারীদের উপস্থিতির দাপ্তরিক প্রমাণাদি না রেখে সবাইকে মৌখিক ডিউটি করার নির্দেশ দেন। ডিউটি করার কয়েক মাসের মধ্যেই কয়েকজনকে বেতন না দিয়ে তাদের বাদ দিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দিয়েছেন।
বেতন পাননি ২১৪ জন কর্মচারী
খুলনা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আউটসোর্সিং কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন না দেওয়ায় প্রায় এক বছর ধরে বেতন পাননি ২১৪ জন কর্মচারী। জানা যায়, সাবেক খুলনা সিভিল সার্জন ডা. সজিবুর রহমান কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুমোদন দিতে অহেতুক কালক্ষেপণ করেন। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রায় এক বছরের বেতন বন্ধ রয়েছে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের।
জানা যায়, কর্মরত এই ২১৪ জন আউটসোর্সিং কর্মচারী এর আগে মেসার্স তাকবীর এন্টারপ্রাইজের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ মাস, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ মাস ৬ দিন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২ মাস কর্মরত ছিলেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আউটসোর্সিং জনবল কার্যাদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি হওয়া পর্যন্ত সেবা কার্যক্রম চালু রাখার নির্দেশ দেন তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ। কিন্তু তার বদলির পর বর্তমান সিভিল সার্জন ডা. সজিবুর রহমান কাজে মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুমোদন প্রদানে কালক্ষেপণ করেন।
মেসার্স তাকবীর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইকতিয়ার উদ্দিন জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আউটসোর্সিং কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে তৎকালীন সিভিল সার্জনের অনুমতিক্রমে দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু করি। পিপিআর নিয়মানুযায়ী একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরপর দুবার কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির সুযোগ পায়। তৎকালীন সিভিল সার্জন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২১৪ জন আউটসোর্সিং কর্মীকে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য লিখিতভাবে চিঠি দেন। এরপর বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) অনুমোদনের জন্য বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বর্তমান সিভিল সার্জনকে চিঠি দেয়। কিন্তু সিভিল সার্জন কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ প্রদানে কালক্ষেপণ করেন। এতে ২১৪ জন কর্মচারীর বেতন বন্ধ হয়ে গেছে।
খুলনা সদর হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় পরিমল কবিরাজ জানান, প্রায় এক বছর বেতন না পেয়ে ধারদেনা করে তার জীবন চলছে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। ঘর ভাড়া দিতে না পারায় বাড়িওয়ালা অনেক আগেই ঘর থেকে নেমে যেতে বলেছেন।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বক্তব্য
আউটসোর্সিং ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেটের কথা স্বীকার করেন মেসার্স তাকবীর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইকতিয়ার উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সব কাগজ থাকা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের কারণে প্রায় এক বছর ধরে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এক বছর ধরে কর্মচারীরা বেতন না পাওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।’ তবে মাছরাঙ্গা সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড ও কন্ট্রাক ক্লিনিং সার্ভিসেস লিমিটেডের মালিক হেমায়েত হোসেন ফারুক জানান, তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সঠিক নয়। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আর নতুন জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ শফিকুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।