চায়ের দেশ ও পর্যটনের শহরখ্যাত মৌলভীবাজার জেলা। আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ জেলার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে মৌলভীবাজার-১, ৩ ও ৪ আসনে নৌকার বিপরীতে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী বা অন্য কোনো দলের শক্তিশালী প্রার্থী নেই। এ কারণে এই তিনটি আসনে নৌকার বিজয় প্রায় নিশ্চিত হলেও মৌলভীবাজার-২ আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা ও জুড়ী) আসনে পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ও মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে ছয়বারের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ দুটি আসনে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের মাঠে প্রচারে রয়েছেন। এ দুটি আসনে দলীয় ভোটারদের উপস্থিতি আশানুরূপ হলেও সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে কম যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে ব্যতিক্রম মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনটি। এখানে নৌকার প্রার্থী শিল্পপতি জিল্লুর রহমান। স্বতন্ত্র শূন্য এই আসনে প্রার্থীকে মেনে নিচ্ছে না জেলা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ। তারা স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী বলে পরিচিত। পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেওয়া অন্য দলেরও নেই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে দলীয় ও সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে নেওয়াকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও নৌকার সমর্থকরা সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমান এমপি নেছার আহমদ দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি। মনোনয়ন দেওয়া হয় নতুন মুখ শিল্পপতি জিল্লুর রহমানকে। এতে ক্ষুব্ধ হন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। তারা দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম এ রহিম শহীদের পক্ষে অবস্থান নেন। যদিও রহিম শহীদের মনোনয়ন উচ্চ আদালতে চূড়ান্তভাবে বাতিল হয়। ফলে এই আসন হয় স্বতন্ত্র শূন্য। এতে নৌকার প্রার্থিতা নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের বিভক্তি প্রকাশ্যে থাকার কারণে আসনটির ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে নৌকার প্রার্থী ছাড়া প্রচারে মাঠে অন্যদের তেমন দেখা যাচ্ছে না। যদিও নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যে নৌকার প্রার্থী ঘুরে বেড়াচ্ছেন সদর ও রাজনগর উপজেলার অলিগলিতে। তবে নৌকা প্রতীকের বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হলে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে চান না। তারা মনে করেন, নিজের প্রার্থী তো নেই, কেন্দ্রে গিয়ে কাকে ভোট দেবেন। যিনি আছেন তিনি তো জিতে যাবেন। স্বতন্ত্র শূন্য হওয়ায় এই আসনের ভোটকেন্দ্রে কীভাবে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানো যাবে, তা নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে সদরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অলিগলি ও প্রধান সড়কের কোথাও কোথাও নৌকার পোস্টার-ব্যানারের ফাঁকে ফাঁকে জাসদের মশাল ও জাপার লাঙ্গল প্রতীকের পোস্টার চোখে পড়লেও দেখা যায়নি তাদের জনসংযোগ কিংবা নির্বাচনি সভা-সমাবেশ।
অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী ও সমর্থকরা সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত লাগাতার সভা-সমাবেশ ও জনসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এ আসনের নির্বাচন অনেকটাই আমেজহীন জানিয়ে তরুণ ভোটার রাসেল খান বলেন, ভোটারদের ভোট নিয়ে আগ্রহ কম। ফলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনি আমেজ ধরে রাখা এবং সন্তোষজনক ভোটার উপস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পৌর এলাকার বাসিন্দা জালাল আহমদ বলেন, নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও তেমন উৎসাহ নেই। ফলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন কি না, সেই সন্দেহ থেকে যায়।
সাধারণ ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে, তারা ভোটকেন্দ্রে যাবেন জানিয়ে নৌকার প্রার্থীর প্রচার সেলের দায়িত্বে থাকা নাইম আহমদ বলেন, সাধারণ মানুষজন চান উন্নয়ন। তারা মনে করেন, জিল্লুর রহমান দলমত নির্বিশেষে জেলার উন্নয়ন করতে পারবেন।
তবে ভিন্ন সুর সাবেক জেলা যুবলীগ নেতা কয়ছর আহমদের কথায়। তিনি জানান, বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলসহ কয়েকটি দলের ভোট বর্জন, নৌকার প্রার্থী বাছাইয়ে অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মূলধারার সংগঠকদের নির্বাচনের মাঠে না থাকাসহ সার্বিক বিবেচনায় এবং শহর ও গ্রামের বর্তমান আলোচনায় বলা যায় নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ নেই।
এ বিষয়ে নৌকার কয়েকজন সমর্থক জানান, প্রার্থী যেখানে যাচ্ছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন, সেখানেই সাধারণ ভোটারদের অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই উন্নয়নের পক্ষে। তাই তারা ভোটকেন্দ্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাবেন।
এদিকে মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনে নৌকার শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ এ কে এম সফি আহমদ সলমান ও তৃণমূল বিএনপির এম এম শাহীনের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
মৌলভীবাজার-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী ছাড়াও আছেন জাসদের আব্দুল মোসাব্বির, জাতীয় পার্টির মো. আলতাফুর রহমান ও এনপিপির মো. আবু বকর, ইসলামী ফ্রন্টের মো. আব্দুর রউফ, ওয়ার্কার্স পার্টির তাপস কুমার ঘোষ ও সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের মো. ফাহাদ আলম।