![শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/02/02/1706854462.radhuni.jpg)
গত সংখ্যার পর
প্রশ্নটি প্রথম কে আবিষ্কার করেছিলেন কবি জানেন না। তবে এটি অনেক পুরোনো দিনের প্রশ্ন। তবে নতুন প্রশ্নকর্তা এখানে বানরের আগে কেন দুষ্ট শব্দ বসালেন আর বিশেষ বাহিনীর তাড়া খাওয়ার প্রসঙ্গই-বা কেন আনলেন বুঝতে পারছেন না তিনি। প্রশ্নকর্তা কি কোনো কারণে বিশেষ বাহিনীর ওপর ক্ষুব্ধ? তিনি কি অপরাধ জগতের কেউ? না না না, তিনি নিশ্চয়ই অঙ্কের শিক্ষক হবেন- কোনো অপরাধী হতে যাবেন কেন? সমাধান বাদ দিয়ে ইত্যাকার হাজারো প্রশ্ন কবি হাসান আলীর মাথায় জট পাকাতে লাগল।
এদিকে জটলার কেন্দ্রে যিনি বসে আছেন তিনি ততক্ষণে অঙ্কের সমাধানে নেমে পড়েছেন। প্রথম মিনিটে তিন ফুট ওঠে দ্বিতীয় মিনিটে দুই ফুট নেমে গেলে গড়ে দুই মিনিটে এক ফুট মাত্র উঠতে পারে। কিন্তু শেষ তিন ফুট এক লাফে উঠে চূড়ার ওপর উঠে গেলে বানরটির আর নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। অতএব, শেষ তিন ফুটের জন্য এক মিনিট আর বাকি ১২ ফুটের জন্য ১২ মিনিট- একুনে ১৩ মিনিট লাগবে তার, এটিই উত্তর।
তবে উত্তরদাতার মাথায় বোধ করি একটু সমস্যা ছিল। কারণ উত্তর শেষ করার পর তিনি বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লিখলেন, বাঁশের উচ্চতা ১৫ না হয়ে সাড়ে ১৪ ফুট হলেও চূড়ায় উঠতে একই সময় অর্থাৎ ১৩ মিনিট লাগত। তিনি যুক্তি দিলেন, প্রচলিত অঙ্কের পদ্ধতি অনুযায়ী শেষের তিন ফুটের জন্য এক মিনিট হিসেবে আর বাকি ১১.৫ ফুটের জন্য ১১.৫ মিনিট- একুনে ১২.৫ মিনিট লাগার কথা সাড়ে ১৪ ফুট বাঁশের মাথায় উঠতে। কিন্তু বানরটির ১১.৫ ফুট উচ্চতায় উঠে থামাটা বাস্তবসম্মত নয়। সে তো পরীক্ষার অঙ্কের জন্য বাঁশ বাইছে না। বিশেষ বাহিনীর ভয়ে জান নিয়ে পালাচ্ছে সে। কাজেই নিচের দিক থেকে তার গতি অনুযায়ী সে হয়তো ১১ ফুট অথবা ১২ ফুটের মার্কে অবস্থান করতে পারবে, ১১.৫ ফুট উচ্চতায় কখনো নয়। পরবর্তী দূরত্ব আড়াই ফুট, তিন ফুট, যা-ই হোক না কেন তার জন্য একটি লাফ অথবা এক মিনিটই যথেষ্ট। সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, আপনি বলতে চাচ্ছেন, বাঁশের উচ্চতা ১৫ ফুট হোক, সাড়ে ১৪ ফুট হোক- একই সময় লাগবে?
-গণিতের বর্তমান প্রচলিত হিসাবে তো তা-ই মনে হয়।
তবে আড়াই ফুট অতিক্রমণের জন্য তিন ফুটের চেয়ে, গড়ের হিসেবে সময় একটু কম লাগবে তবে তা কোনোমতেই ১২.৫ মিনিট নয়। একইভাবে কম সময় লাগতে পারে, যদি বাঁশের উচ্চতা ১৪.৬ ফুট, ১৪.৪ ফুট ইত্যাদি হয়। এখানে গণিতের এক নতুন ফর্মুলা লুকিয়ে আছে। তবে তা এখনই প্রকাশ করতে চাই নে। তাহলে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে, যাদবের পাটিগণিত থেকে সব পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লিখতে হবে।
আমি জানি এ ফর্মুলা, এর নাম দিলাম ফয়েজ ফর্মুলা। গণিতের অমীমাংসিত ফার্মির সূত্রের মতো এটিও গোপনীয় থাক।
অভিভাবকের দল এসময় হইচই করে উঠলেন। তাঁরা সমস্বরে বললেন, আপনি এসব বিশেষ দ্রষ্টব্য বাদ দেন। দশজন যেভাবে অঙ্ক করে সেভাবেই থাক। এত পণ্ডিত হলে আপনি এই আদর্শ স্কুলের মাঠে নকলের উত্তর দিতে এসেছেন কেন, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গণিতের অধ্যাপক হন, তারপর গণিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করুন। এখন আল্লাহর ওয়াস্তে আপনার গবেষণার অংশ কেটে আসলটুকু দেন, আমরা হলে সাপ্লায়ারের হাতে তুলে দিই। হলের গার্ডরা অস্থির হয়ে পড়েছে।
কিন্তু পরীক্ষার হলের গার্ডদের নকলের অস্থিরতার চেয়েও বড় অস্থিরতা এ সময় দেখা দিল স্কুলের মাঠে। পুলিশ আর বিশেষ বাহিনী নকলের দায়ে যাকে যেখানে পেল গ্রেফতার করতে লাগল। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ আগের জমজমাট স্কুলের মাঠ জনশূন্য মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হলো।
কবি হাসান আলী বায়তুল ফালাহ মসজিদে জোহরের নামাজ শেষে মাদুরের ওপর গা এলিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ কিছু মুসল্লি কাজা নামাজ পড়ছেন ইতস্তত। আজ পরীক্ষা উপলক্ষে মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে গেছে। দুজন মহিলাও বোরকা গায়ে মসজিদের একপাশে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। কবি হাসান আলী অবাক হলেন। এ মসজিদে মহিলাদের নামাজ আদায় এই প্রথম কি না।
আবার তিনি কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। গঞ্জের পাঞ্জেগানা মসজিদ থেকে ইমাম সাহেব এসে দেখলে বিষয়টা কীভাবে নেবেন। ইত্যাকার হাজারো দ্বন্দ্বে যখন তিনি অবশ বিবশ হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মহিলারা এগিয়ে এসে তাঁকে উঠে মসজিদের বাইরে যেতে বললেন। বললেন, আল্লাহর ঘর ধুলোবালিতে ভরপুর কেন?
কবি এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন। তিনি আর হালিম শাহ কখনো কখনো মসজিদ ঝাড় দেন বটে, তবে তা যে সত্যিকারের সাফসুতরো করা বোঝায়, সে দাবি তিনি করেন না; এখনো করলেন না। বাকি আধঘণ্টা সময়ে দুই মহিলা মুসল্লি মসজিদ ঝকঝকে তকতকে করে তুললেন। কবি একবার শুনেছিলেন, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্য অনেক দেশে মসজিদের মোতোয়াল্লি হন মহিলারা। ফলে আল্লাহর ঘর থাকে সর্বদা পরিচ্ছন্ন। দেশে বিশেষত গ্রামে মসজিদগুলোর সাফ সুতরো রাখার জিম্মাদারি সব মা-বোনদের হাতে তুলে দেওয়া যায় কি না একবার মনে মনে ভাবলেন তিনি, আবার তৎক্ষণাৎ কী এক অজানিত শঙ্কা কি আশঙ্কায় নিজের ভেতর সেঁটিয়ে গেলেন তিনি। আরও আধাঘণ্টা পর, বহুদিনের অবসানে পবিত্রতার এক অনুভবে পরিচ্ছন্ন বায়তুল ফালাহ মসজিদে তার চোখে ঘুম নেমে আসছিল। এ সময়ে হন্তদন্ত হয়ে হালিম শাহ মসজিদে এসে কবি হাসান আলীর আরামের ঘুম হারাম করে দিলেন।
-গণক হারাধনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। থানায় যেতে হবে চলুন।
কবি হাসান আলী কোনোদিন থানায় আসেননি। তার ধারণা, থানায় শুধু খারাপ লোকেরাই আসে। তার মতো এক নিরীহ কবিকে কোনোদিন থানায় আসতে হবে- এ ছিল তার কল্পনারও বাইরে।
থানার বারান্দায় দুই বন্ধু পাশাপাশি বসেছিলেন। থানা চত্বরে বাতিল গাড়ির স্তূপ, বিভিন্ন সময়ে পুলিশ কর্তৃক সিজ করা গাড়িগুলো সময়ের গ্রাসে মাটির খোরাকে পরিণত হচ্ছে। দু-একজন মানুষ ভগ্ন গাড়ির চাকায় বসে গোপন পরামর্শ করছে। দুটি চড়ুইপাখি কিছুক্ষণ পরপর উড়ে এসে গাড়ির অবশিষ্টাংশের ওপর বসছে আবার চলে যাচ্ছে। কবির ধারণা, এখানে তারা বাসা বানিয়েছে আর সে বাসায় মনুষ্য সমাজের সদস্যরা কেন বসতে এসেছে তা তারা বুঝে উঠতে পারছে না। যেহেতু কবি, আরও এক ধাপ গিয়ে তার চিন্তারা কথা বলছে, যে পুলিশ স্বয়ং থানার মধ্যে সামান্য চড়ুই পাখির বাসার নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা বাইরে মানুষের কী নিরাপত্তা দেবে।
চলবে...