![শিক্ষকদের যৌন হয়রানি, ঢাবি-চবি-জাবি উত্তাল](uploads/2024/02/12/1707756174.CU.jpg)
দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়- ঢাকা, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নকারী শিক্ষক ও ছাত্রদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে ফুঁসছে। ঢাবিতে অভিযুক্ত এক শিক্ষককে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণচেষ্টায় অভিযুক্ত শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে নবম দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ ৫ দফা দাবিতে জাবির প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাবিতে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে অভিযুক্ত অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে বিভাগের নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি বিভাগের চেয়ারম্যান আবুল মনসুরের কাছে পাঠানো হয়।
সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে অধ্যাপক নাদিরকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠনসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
যৌন হয়রানির ঘটনায় আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল অভিযুক্ত শিক্ষকের রুম সিলগালা করে দিয়ে ক্লাস বর্জন করেন আন্দোলনকারীরা। শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিলও বের করেন।
এর আগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দুপুরে বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিভাগীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে বিভাগের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি না দেওয়া পর্যন্ত একাডেমিক কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন না তারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: লঘু শাস্তির বিধান করলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, যৌন নিপীড়ন, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণচেষ্টায় নিজ বিভাগের ছাত্রী কর্তৃক অভিযুক্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মতিনের বিচারের দাবিতে গতকাল নবম দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
অভিযুক্ত অধ্যাপককে যথাযথ শাস্তি না দেওয়া হলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনকারীরা। তারা অভিযুক্ত শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের ২ দফা দাবি হলো অভিযুক্ত শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদী হয়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে।
রসায়ন বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তার স্থায়ী বহিষ্কার চাই। যেন এ রকম নিকৃষ্ট কাজ করার চিন্তাও কেউ মাথায় না আনেন। বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরে যাব না। আন্দোলন চলবে। সুষ্ঠু বিচার না পেলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাব।’
আরেক শিক্ষার্থী আশফাক বলেন, ‘আমরা জেনেছি তদন্ত প্রতিবেদন হয়েছে। ক্রসচেকিং চলছে। উপাচার্য ম্যাম আসেননি। তাই আজ (সোমবার) তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে না। কাল (মঙ্গলবার) প্রতিবেদন পাওয়ার পরে সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত কি আসে, আমরা তা দেখব। যদি লঘু শাস্তি দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব। আমাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক উপগ্রুপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করেছে। আমরা এখন পর্যন্ত আন্দোলন নিজেদের বিভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। সুষ্ঠু বিচার না পেলে বা অভিযুক্তের গুরু অপরাধের লঘু শাস্তি দেওয়া হলে তাদের সবার সমর্থন নিয়ে আমরা কঠোর থেকে কঠোরতর আন্দোলনে যাব।’
গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেলের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত কমিটি। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. জরিন আখতার। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক খবরের কাগজকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের কাজ চলছে। আগামীকালের (আজ মঙ্গলবার) মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেব।
এ বিষয়ে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, তদন্ত কমিটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে প্রতিবেদন জমা দিতে। তদন্ত কমিটি প্রতিনিয়ত বৈঠক করে যাচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। তারা আজকে (সোমবার) পারেনি। কাল বা পরশু মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে কি না, এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে কীভাবে বলব? অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরদিনই আমরা অধিকতর তদন্ত কমিটি যারা শাস্তি দেবেন, তাদের সঙ্গে বসে শাস্তির ব্যবস্থা করব। আমরা এ ব্যাপারে কোনো ছাড়ই দেব না। এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং শিক্ষক সমাজের লজ্জার বিষয়। অতিদ্রুত আমরা এর একটি সুরাহা করতে পারব।’
রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল মতিনের বিরুদ্ধে গত ১ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য বরাবর যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণচেষ্টার জন্য লিখিতভাবে অভিযোগ করেন একই বিভাগের ও অভিযুক্ত শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর থিসিস করা এক ছাত্রী। অভিযোগে বলা হয়, থিসিস চলাকালীন সুপারভাইজার (অধ্যাপক) তাকে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন করেন। ল্যাবে একা কাজ করার সময় এবং কেমিক্যাল দেওয়ার বাহানায় নিজ কক্ষে ডেকে দরজা আটকে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন বলে উল্লেখ করা হয় অভিযোগে। তবে অভিযুক্ত অধ্যাপক অভিযোগটি সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের বহিষ্কার ও যথাযথ বিচার চেয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পাশাপাশি বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন সেলে তুলে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়।
জাবিতে ৫ দফা দাবিতে প্রশাসনিক ভবন অবরোধ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা জানান, ধর্ষক ও তার সহায়তাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করাসহ পাঁচ দফা দাবিতে নতুন প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল ৯টা থেকে ‘নিপীড়নবিরোধী মঞ্চ’-এর ব্যানারে এ অবরোধ করা হয়। পরে আজ মঙ্গলবারও প্রতীকী অবরোধের ঘোষণা দিয়ে দুপুর ১২টায় অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। অবরোধ চলাকালে নতুন প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তাদের কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে গণরুম বিলুপ্ত করে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আবাসন নিশ্চিত করা; র্যাগিং সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা; নিপীড়ক শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার নিষ্পত্তি করাসহ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা; নিপীড়কদের সহায়তাকারী প্রক্টর ও মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্টের অপরাধ তদন্ত ও তদন্ত চলাকালে প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া এবং মাদকের সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে জড়িতদের ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
অবরোধের সময় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গত ৪ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট সভা শেষে উপাচার্য বলেছিলেন পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে অছাত্রদের হল থেকে বের করবেন। গতকাল ছিল শেষ কর্মদিবস। কিন্তু প্রশাসনের কোনো কর্মতৎপরতা আমরা দেখিনি। আমরা চাই, প্রতিটি হলে প্রতিটি নিয়মিত শিক্ষার্থীকে আসন নিশ্চিত করুক প্রশাসন। কক্ষের দরজায় তালিকা টাঙিয়ে দিক। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিত হলে স্বাভাবিকভাবেই অবৈধ ছাত্ররা অপসারিত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তার পেছনে এই প্রশাসনই দায়ী। ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এর দায় প্রশাসনের।’
ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন জলী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গত কয়েক বছর ধরে ঘুরে ঘুরে পদে আসছেন। আমরা জানি না তার মধ্যে বিশেষ কী গুণ রয়েছে। তিনি নিজেও নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত, অসংখ্য নিপীড়নের ঘটনাকে তিনি উসকে দিচ্ছেন। কিন্তু তাকেই বারবার ক্ষমতায় বসানোর কারণ কী?’