বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, মাঝে মাঝে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে দেশ-জাতির দুঃসময়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে অন্যায়কে পিষ্ট করে যখন বিজয় কেতন ওড়ায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞাকেও ছাড়িয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়; রূপ নেয় অধিকার আদায় এবং অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা এক পীঠস্থানরূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) হলো সেই পীঠস্থান, ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলে নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকেছে, ছিনিয়ে এনেছে অধিকার, সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস, বিশ্ব মানচিত্রের বুকে বাংলাদেশ নামক দেশ সৃষ্টিতে যার অবদান কোনো অংশে কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামনে থেকে দেশের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্ব দিয়ে পাশে থেকেছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে অবহেলিত এই ভূখণ্ডের পথপ্রদর্শক হিসেবে ও উচ্চশিক্ষা বিস্তারে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গৌরবগাথা ১০৩ বছরে এই বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। জানা যায়, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষজুড়ে মুসলিম শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলার এক ধরনের নবজাগরণ তৈরি হয়। যার প্রভাব পড়ে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গতেও। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এরপর ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানান ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ বাংলার অন্য নেতারা।
তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল ৬০ জন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণাকেন্দ্র এবং ছাত্রছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার ১৫০ জন। পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার শিক্ষক।
১০৩ বছরের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সংগ্রাম-ঐতিহ্যের ও গৌরবময় কণ্টকাকীর্ণ পথচলায় অর্জনের তালিকাও বেশ লম্বা। রাষ্ট্র সৃষ্টি করে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে রাষ্ট্র সৃষ্টিতেও ভূমিকা রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর হয়তো অনেক নামি বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে, তবে রাষ্ট্র সৃষ্টি এবং রক্ষায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ৪৮ থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি পরতে পরতে নাম জড়িয়ে আছে দেশের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির।
বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে পরিকল্পনা
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিবি) ও ভৌত অবকাঠামোগত মাস্টারপ্ল্যান (পিএমপি) নামে দুটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। যা ২০৪৫ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়। যার ফলে পাল্টে যাবে এর একাডেমিক ভৌত অবকাঠামোর চিত্র।
ভৌত অবকাঠামোগত পরিকল্পনা (পিএমপি) সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে আধুনিক গবেষণাগারসহ একাডেমিক ফ্লোর স্পেস ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭০০ বর্গফুট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ বর্গফুট হবে। লাইব্রেরির সুবিধা ১ হাজার ৫০০ জন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩ হাজার জন হবে এবং নারী শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা ৩৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে। মাস্টারপ্ল্যানে প্রদর্শিত ভবনগুলো বহুতলবিশিষ্ট হওয়ায় ভবনের ফুটপ্রিন্ট ২৭ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২২ শতাংশে নেমে আসবে। ফলে সবুজ চত্বর ও উন্মুক্ত স্থান বৃদ্ধি পাবে।
গেল মাসে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সাময়িকী কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) এবারের র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। যেখানে প্রকাশিত র্যাঙ্কিংয়ে দেখা যায়, ২২.৫০ সামগ্রিক নম্বর নিয়ে ঢাবি এবারের অবস্থান ৫৫৪তম। গতবারের র্যাঙ্কিংয়ে যা ছিল ৬৯১-৭০০তম। এদিকে বিগত দশ অর্থবছরে তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেড়েছে গবেষণার বরাদ্দের আকার। গত ১০ বছর বিশ্লেষণ করে দেখা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ২.১২ শতাংশ। যদিও এই বাজেট পর্যাপ্ত না বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দীন। যেখানে শিক্ষকপ্রতি গড়ে গবেষণা বাবদ ১ লাখ টাকা বরাদ্দ পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ঘিরে উপাচার্য ভবন, কার্জন হল, কলাভবন ও ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সড়কসমূহে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রবেশপথে তোরণ নির্মাণ এবং রোড ডিভাইডার ও আইল্যান্ডসমূহে সাজসজ্জা করা হয়েছে।
দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ
‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে পায়রা চত্বরে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল ও হোস্টেল থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা শোভাযাত্রা সহকারে স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সমবেত হবেন। স্মৃতি চিরন্তন চত্বর থেকে সকাল পৌনে ১০টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে পায়রা চত্বরে যাবেন। সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সম্মুখস্থ পায়রা চত্বরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হলসমূহের পতাকা উত্তোলন, পায়রা, বেলুন ও ফেস্টুন উড়ানো, কেক কাটা এবং সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিম সং ও উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশিত হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সকাল সাড়ে ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রতিপাদ্য ‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’ বিষয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এতে সভাপতিত্ব করবেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল।
আলোচনা সভার শুরুতে দিবসটি উপলক্ষে প্রকাশিত ‘স্মরণিকা’ ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক গ্রন্থের ২য় খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করা হবে।
বন্ধ থাকবে রাস্তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আগামীকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নীলক্ষেত ও ফুলার রোডসংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এ সময় বিকল্প রাস্তা ব্যবহারের জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে অংশ নেবে না শিক্ষক সমিতি
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য সম্প্রতি চালু হওয়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে সর্বাত্মক কর্মবিরতির অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক সমিতি।
রবিবার (৩০ জুন) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিত পূর্ণদিবস কর্মবিরতি উপলক্ষে অবস্থান কর্মসূচিতে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা এই ঘোষণা দেন।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘পহেলা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিবস, একটি আনন্দের দিন কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন একটি দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজপথে থাকতে হবে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা তাকে জানিয়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কোনো কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি অংশ নেবে না।’