![অছুটি](uploads/2024/06/07/suborno-rekha-golpo-1717742570.jpg)
রেবেকা ভোরে স্বপ্নে দেখেছিল বাপজান এসেছেন। ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে বলছেন, মা গো! শুকনা মরিচ পুড়াইয়া আমারে চাইরডা ভাত দিবি?
ঘুম ভেঙ্গে যায় অস্থিরতায়। শুকনো মরিচ পোড়ানোর অস্থিরতা, সঙ্গে ভাতও তো বাড়তে হবে। রেবেকা খাট থেকে নামার পথ খুঁজে পায় না ঘুম জড়ানো চোখে। সেলিমের বেশ খানিকটা সময় যায় বুঝে উঠতে।
ভোরের স্বপ্ন রেবেকার মনে আনন্দ জাগায়। উঁচু পেটটায় হাত বুলিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে বলে, বাপজান! আপনে আসতেছেন তাইলে?
রেবেকার স্বামী-শাশুড়ি, এমনকি অফিসের কলিগ সীমা আপাও বলে, ছেলে হবে।
চাকরিতে ঢোকার আগে রেবেকার মেয়ে হান্না জন্ম নিয়েছিল। শেষ সময়ে এত জটিলতা হয়েছিল যে সি সেকশন করতে হয়েছিল। এবার রেবেকার ঝামেলা আরও বেশি। প্রসবের এক মাস আগে থেকে ছুটিতে যাওয়ার পরামর্শ দেয় ডাক্তার। প্রেসক্রিপশনে লেখা ডাক্তারের পরামর্শ আর প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ জানিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি চেয়ে আবেদন করে রেবেকা। বস বটে পোড়ামুখো! ফাইল বারবার নামায় নানা ক্যয়েরি করে। মাতৃত্বকালীন ছুটি কত দিনের ও কী কী শর্তে প্রাপ্য হয় তা জানাইয়া নথি পুনঃউপস্থাপন করুন, এর আগে ছুটি নিয়েছেন কী না জানাইয়া নথি পুনঃ উপস্থাপন করুন ব্লা ব্লা ব্লা!
সীমা আপা আর রহমত আলী স্যার একই ব্যাচের। রেবেকা রহমত আলীকে স্যার বললেও সীমা খন্দকারকে ম্যাডাম না বলে আপা বলে। সীমা আপাই বলেছে, তুমি আমার ছোট বোন। আপা বলবে কিন্তু।
সীমা আপার সামনে রাগ মেলে আরাম খোঁজে রেবেকা। পোড়ামুখোর বউ কি বাচ্চা বিয়োয়নি?
সীমা আপা নিজস্ব তদন্তসাপেক্ষে জবাব দেয়, বউয়ের হয়ে পোড়ামুখোই বাচ্চা বিয়েছিল। পুরুষ মানুষের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই, তাই ওটা ওর কপালে জোটেনি। তাই ও জানে না উক্ত ছুটি কত দিনের ও কী কী শর্তে প্রাপ্য, বুঝলি না?
রেবেকা দাঁতে দাঁত চেপে ফাইলের জবাব লিখে পাঠায়। ফাইল সদয় অনুমোদন নিয়ে নেমে আসার আগেই গর্ভের পানি দু-পা দিয়ে নামতে থাকে। অগত্যা ছুটি অনুমোদনের আগেই হাসপাতালে ছুটতে হয়। তবে, সেই ছোটাও সহজে হয় না ওর। কেবল ওর এই ছুটির ফাইল তো নয়, আরও অনেক ফাইলে ত্যাড়া-বাঁকা ক্যয়েরি দিয়ে রেখেছে পোড়ামুখো। সহজে সিদ্ধান্ত আসার উপায় নেই। কিছু বলতে গেলে ‘জনস্বার্থে’ শব্দটির সমাস-সন্ধি সব বুঝিয়ে দিচ্ছে রেবেকাকে। এসব নিয়ে এতটাই দৌড়ের ওপর ছিল যে, পেটিকোট কেন ভেজা, তা নিয়ে ভাববার ফুরসত পায়নি। ভাবল তখন, যখন রহমত আলী স্যার বিস্ময় নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মুখ এমন সাদা কেন রেবেকা?
রেবেকার চোখ সীমা আপাকে খুঁজছিল। ফাইল নিয়ে ওপরে গেছে। কতক্ষণে ফেরে, ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না ভেবেই রেবেকা রহমত আলীকে বলে, আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে স্যার।
রহমত আলী ব্যস্ত হয়ে ছুটল। রেবেকা ওর ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতেই দেখল সীমা আপা নামছে। রেবেকাকে দেখেই বুঝে গেল যা বোঝার। ওদের বসতে হয় দুই তলায়। রেবেকাকে একহাতে ধরে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে সীমা আপা একখান সিএনজি দাঁড়ানো দেখে গর্জে উঠল ঠিক বাঘিনীর মতো। এই অবস্থায় মেয়েটা সিএনজিতে যাবে?
গর্ভাবস্থায় রেবেকার যতবার সমস্যা হয়েছে, যানবাহন শাখায় ফোন করলেই গাড়ি পেয়ে গেছে। সীমা আপাও ফোন দিলেই পাওয়া গেল গাড়ি। অথচ রহমত আলী কেন এ কাজ না করে সিএনজি ডাকল, সিএনজিকে কেন রেবেকার জন্য নিরাপদ বাহন ভাবল, তা নিয়ে সীমা আপার জেরা ওখানেই রেখে রেবেকাকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলে হাসপাতালে। চলতি পথে রেবেকা ফোন দেয় সেলিমকে। ওটিতে ঢোকার আগ মুহূর্তে পৌঁছাতে পেরেছিল সেলিম। মেয়েটাকে দেখতে পেল না বলে রেবেকার হাহাকার ঢেকে যায় ওটির দরজা বন্ধ হলে।
সুমি আছে স্কুলে, ছুটি হয়নি এখনো। ওকে স্কুল থেকে উঠিয়ে আনতে পারত সেলিম, পারেনি, কেননা এরকম সময়ে মা তার সন্তানকে দেখতে চাইতে পারে, এই ভাবনা সেলিমের মাথায় খেলেনি। ও ভাবছিল হাসপাতালের বিল, মিষ্টির খরচ-টরচ নিয়ে। মাসের শেষ সপ্তায় ব্যাপারটা ঘটে যাবে ভাবেনি। আরও তো এক মাস ছিল হাতে।
সেলিমের অফিসেও ঝামেলা কম না। সাড়ে তিনটায় বিদেশি বায়ারের সঙ্গে প্রেজেন্টেশন আছে। রেবেকার অবস্থার কথা জানালে বস্ ছুটি দিয়েছে বটে, তবে মুখে ঝুলে থাকা বিরক্তি চোখ এড়ায়নি। ঘটনাটা বৃহস্পতিবার ঘটলে হজম করতে সুবিধা হতো, পরের দিন ছুটি থাকে বলে। মঙ্গলবারে এরকম তেঁতো পাচন বানানোর জন্য রেবেকার ওপর একটু রাগও হয় সেলিমের। যদিও পরক্ষণেই রাগটা অন্য রকমের উত্তেজনায় মিইয়ে যায়। ওটির দরজা খুললেই তো ছেলে কোলে নেবে ও।
ভোরে স্বপ্ন দেখেছে রেবেকা, সেলিমের মা বলেছে এবার ছেলে-ই হবে। তাহলে হবেই। মেয়ের নাম ওর সঙ্গে মিলিয়ে সুমি রেখেছিল বলে এবার ছেলের নাম রেবেকার নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে কি না ভাবতে থাকে সেলিম। ওদিকে সেলিমের মা বংশের বাতির নাম সেলিমের মরহুম বাপ আজগর আলীর নামে রাখার খায়েশ প্রকাশ করে ফেলেছে। এ যুগে আজগর নামটা তাল মিলিয়ে চলনসই না, সেলিমের এরকম মনে হয়। মায়ের খায়েশ পূরণ করবে না কি ছেলেকে আধুনিক নাম উপহার দেবে ভাবতে গিয়ে দ্বিধায় জড়িয়ে পড়া সেলিম টের পায় না ওর কাছে থাকা রেবেকার ব্যাগের ভেতর মোবাইলটা বেজে চলেছে অনেকক্ষণ।
সীমা আপা ফোন করেছিল। বেশ কয়েকবার। সেলিম কল ব্যাক করে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে রাখে সীমা আপাকে। রেবেকার মুখে শোনা রেবেকার অফিসের চরিত্রগুলোর রং সেলিমেরও চেনা। আর তাই রেবেকার বস্ ফোন দিতেই সেলিম না বলে পারে না, আপনি ছুটি দেননি, রেবেকাকে ছুটি মঞ্জুর করেছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক।
বস্ শুকনো হাসি গিলে ওকে আগাম অভিনন্দন জানায়। সেলিম ফোন রাখে তৃপ্তি নিয়ে। ছেলে কোলে নেওয়ার আগেই দেখি জোশ টের পাচ্ছে। কোলে নেওয়ার পর কী করবে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে যায় সেলিমের। আর তাই ওটি থেকে ভেসে আসা তারস্বরে কান্নার শব্দ সেলিমের মাথায় ঢোকে না। সেলিম বুঝতে পারে না, কান্নাটা রেবেকার। বুঝতে পারে না, ছেলে কোলে নেওয়ার স্বপ্ন আপাতত, অধরাই থেকে যাচ্ছে ওর। যখন পৃথিবীতে আসতে চেয়েছিল, তখন আসতে পারেনি বলে অভিমানী শিশুটির আত্মা সৃষ্টিকর্তার কাছেই ফিরে গেছে।
সেলিম যখন পুরোপুরি বুঝে উঠতে সক্ষম হয়, তখন ওর মাথায় ঝিলিক দেয় ‘রনবীর’ শব্দটি। রেবেকার সঙ্গে মিলিয়ে এই নামটা দেওয়া যেতে পারত শিশুটিকে। বলিউডের দু-দুজন নায়ক আছে এই নামে। রেবেকা আর সুমি খুব পছন্দ করে নায়কটাকে। নামটাও ওরা পছন্দ করত এবং মা গাঁইগুঁই করলেও ওদের পছন্দ বলে সেলিম শিশুটিকে এই নামটিই উপহার দিতে পারত। হয়নি। এবং রেবেকাকে কখনোই এই নামকরণের দ্বন্দ্ব নিয়ে সেলিম কিছু বলতে পারেনি। বললেও শুনতে এবং বুঝতে পারত না রেবেকা। কেননা, ওই ঘটনার পর রেবেকা বাড়ি ফিরেছিল যে রকম শরীর আর মন নিয়ে, তাতে বেঁচে থাকাটাই ছিল অনেক বেশি। পেটের সেলাইয়ে সংক্রমণ ধরল, স্তণবৃত্ত থেকে অভিমানী শিশুটির মতোই অভিমানে ঝরত দুগ্ধস্রোত। রেবেকা কথাটথা বলত না, কেবলি কাঁদত। সে কান্নার কারণ হারিয়ে ফেলা বাবাকে ফিরে না পাওয়ার দুঃখ না কি অভিমান, টের পাওয়া মুশকিল।
মুশকিল তো আরও তৈরি হলো। মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন করেছিল ও। সন্তানের প্রসবের সঙ্গে সম্পর্কিত এই ছুটি। সন্তান জীবিত থাকবে, সন্তানের দেখভাল করবে মা, মহান নীতি-নির্ধারকগণের শুভ চিন্তাকে স্বীকৃতি দিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি আছে ছুটি বিধিতে। মৃত সন্তান প্রসব করলে কিংবা জন্মের পর পর সন্তানের মৃত্যু ঘটলে এই ছুটি ভোগ করা বৈধ হবে কি হবে না, তা নিয়ে কেউ ভাবেনি। কেননা, এই ভাবনার পেছনে আছে সন্তান মৃত্যুবরণ করতে পারে, এই অশুভ চিন্তা। নীতি-নির্ধারকগণের কাজ শুভ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া, অশুভ চিন্তাকে না।
বস্ ফোন করে ঠিক এরকম ব্যাখ্যা দিল সেলিমকেই। বলল, বৈধ ছুটিকে অবৈধ উপায়ে মঞ্জুর করা যায় কি না, দয়া করে আল্লাহ্পাকের কাছ থেকে জেনে নেবেন এবং আমাকে জানাবেন।
সীমা আপা ধরা গলায় উপদেশ দিল, মঙ্গল থেকে বৃহস্পতি পর্যন্ত তিন দিনের নৈমিত্তিক ছুটির দরখাস্ত লিখে রেবেকার স্বাক্ষর নিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন ভাই।
এর মানে রোববার থেকে অফিস করতে হবে ওকে?
রেবেকা পারবে না।
শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটির দুই দিকে নৈমিত্তিক ছুটি মেলানো যাবে না, বিধিতে স্পষ্ট বলে জানায় সীমা আপা। রেবেকাকে ছুটি শেষে যোগদান করে আবার ছুটি নিতে হবে।
রেবেকা পারবে না।
একসঙ্গে দশ দিনের বেশি নৈমিত্তিক ছুটির অনুমোদন দেওয়া যায় না, অন্তত এই দশ দিনের ছুটি দেওয়ার জন্য বসকে রাজি করাতে সীমা আপা আপ্রাণ চেষ্টা করবে জানিয়ে অনুরোধ করে রবিবার রেবেকাকে অফিসে নিয়ে আসতে।
তিন দিনের নৈমিত্তিক ছুটির দরখাস্ত প্রিন্ট করে বাড়ি ফেরে সেলিম। রেবেকার স্বাক্ষর নিতে গিয়ে দেখে, ঘুমিয়ে আছে ও। ঠোঁটের কোনায় মিষ্টি হাসি। ঘুমের ভেতর সেই অভিমানী শিশুটিকে বুকের দুধ পান করাতে ব্যস্ত মায়ের ঠোঁটে ঝুলতে থাকা হাসিটা সেলিমের চোখ ভিজিয়ে দেয়। রেবেকার ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে সরে আসতে গিয়ে মনে হলো, রনবীরের মা সত্যিই কি ঘুমিয়েছে?