গত সংখ্যার পর
চিঠির রংচটা খামটা হাতে তুলে চোখ বুলাতেই রিপোর্টারের চোখ-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। ঠিকানার শুরুতেই লেখা ‘বড় আব্বা’, তারপর ডাক্তার দত্তের নাম- এবং আগরতলার হাসপাতালের ঠিকানা। হিন্দু বাঙালিরা প্রায় সবাই জনককে বাবা ডাকেন- আব্বা নয়। অতএব, আগ্রহ দমাতে রিপোর্টার মল্লিকা প্রশ্ন করল- কেউ কী আপনাকে বড় আব্বা বলে সম্বোধন করতেন, স্যার?
বয়সের ধকলে চামড়া ঝুলে গেলেও গায়ের রংটা এখনো বেশ টকটকে সার্জন দত্তের। মাথার চুল যথেষ্টই কমেছে, তবু যা আছে তা পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখের ভ্রুগুলোয় যদিও তোসা পাটের লালচে আভা লেগেছে, কিন্তু বোঝা যায় যৌবনে রীতিমতো সুপুরুষ ছিলেন তিনি।
রিপোর্টারের প্রশ্নে দত্ত বাবু কিছুটা স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলেন- হ্যাঁ, এক সময় একজন ডাকত। তারপর রিপোর্টারের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন- মল্লিকা, মল্লিকাই তো বললে, চল, টেবিলে বস, চা খাও, কথা বলতে বলতেই সবকিছু পরিষ্কার হবে।
এরপর ক্যামেরা ঠিকঠাক করে বসানো হলো, লাইট জ্বলল। ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখা হলো ডাক্তার দত্তের স্মৃতিস্মারকের একটা দেয়াল। অবসরপ্রাপ্ত সার্জন এরই মধ্যে সোফা থেকে উঠে হাতের পুরনো চিঠিটা দেয়ালের নির্দিষ্ট জায়গায় সেঁটে দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন।
রিপোর্টার মল্লিকা সেনগুপ্ত এবার ক্যামেরাম্যানদের দিকে তাকিয়ে, নিজে ঠিকঠাক হয়ে সার্জন দত্তের পাশের চেয়ারটায় আসন নিল। এরপর সে শুরু করল ঠিক এভাবে: অর্ধ শতাব্দী আগের ঘটনা; পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো। পাকিস্তান দুই টুকরো হলো। ১৯৭১ সালে একটা বড় যুদ্ধ হলো- লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, এক কোটি মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে এল রিফিউজি হয়ে। আপনি তো সেই ইতিহাসের সাক্ষী?
ভূমিকার সঙ্গে প্রশ্ন করা দেখে রথীন দত্ত রিপোর্টারের মুখের দিকে তাকালেন, অবাক হলেন নাকি বিরক্ত হলেন বোঝা গেল না। তবে তিনি যে নানা কিছু ভেবে চলছেন তা আন্দাজ করা গেল। এক সময় চোখ থেকে চশমা খুললেন, কাপড় দিয়ে আলতো করে মুছলেন সার্জন দত্ত। ক্ষণিক তাকিয়ে থাকলেন দেয়ালের স্মৃতি স্মারকগুলোর দিকে। মা-বাবার সঙ্গে তার ছেলেবেলার ছবি, স্ত্রী ও সন্তানদের নানা বয়সের ছবি, আগরতরার গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালের ছবি, পদ্মভূষণ প্রাপ্তির ছবি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননার ছবি, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের লেখা প্রশংসাপত্র- ইত্যাদি। এবং এক পাশে সাবিনা নামের একটি মেয়ের ছবি, সেই সঙ্গে দীর্ঘ পেশাগত জীবনের অগনিত স্মৃতিস্মারক!
রিপোর্টার মল্লিকা সেনগুপ্ত অবসরপ্রাপ্ত সার্জনের স্মৃতি কাতরতা লক্ষ্য করতে পারল। ক্যামেরা নানা দিক থেকে ছবি তুলতে ব্যস্ত হলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সে আরেকবার প্রশ্ন করল- স্যার, সি আর দাস, নেতাজী সুভাষ, মাস্টারদা সূর্য সেন- এঁরা সবাই অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কিন্তু আপনার দেয়ালে বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান কেন?
রথীন দত্ত হয়তো কিছুটা বিরক্ত হলেন, তবু এক ঝলক হাসলেন, নতুন প্রজন্মের সংকট বুঝলেন। এরপর বললেন- বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানতে এসেছ অথচ ওই ছবিটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো তোমার কাছে!
রিপোর্টার কালবিলম্ব না করে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিল- সরি স্যার, অপ্রাসঙ্গিক ভাবিনি এবং বলিওনি, বরং প্রশ্নটি করে আমি আপনাকে পুরনো সময় ও ইতিহাসের পৃষ্ঠার দিকে নিতে চাইছিলাম।
শ্রী দত্ত মেয়েটির বুদ্ধিমত্তায় খুশি হলেন। এরপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীর লয়ে বলতে থাকলেন- শোন, শেখ মুজিবুর রহমান- মানে বঙ্গবন্ধু, বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন ও স্বার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জনক- বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা তিনি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ হঠাতে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন- ব্রিটিশ শাসনের অর্গল ভেঙে মুক্ত স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন- কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। বর্মা দখল করে মণিপুরের কোহিমা পর্যন্ত এসেও ফিরে যেতে হয়েছে তার আজাদ হিন্দ ফৌজকে। দেশবন্ধু, শরৎ বসু, আবুল হাসিমরা স্বাধীন বৃহৎ বঙ্গ গঠনে চুক্তি করেছিলেন- এগিয়েও ছিলেন কিছুটা- সেটিও ঘটেনি। ভেবে দেখ, এই উপমহাদেশের কেউই যা পারেননি মুজিব তাই সম্ভব করেছেন- বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।
শোন, তোমাকে বলি।
১৯৬৩ সালে একবার গোপনে আগরতলায় এসেছিলেন শেখ মুজিব- পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করতে ভারতের সাহায্য চাইতে। ত্রিপুরার মুখমন্ত্রী তখন শচীন্দ্রলাল সিংহ। ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সবেমাত্র চীনের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ভারতে তখন তুমুল অস্থিরতা। তবু চিফ সেক্রেটারি শ্রী রমণকে সঙ্গে নিয়ে শচীন বাবু দিল্লি গেলেন, দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে। কিন্তু নেহরুজি জাতীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে নতুন ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। ১৫ দিন কাটিয়ে ফিরে গেলেন মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ দেখ, যা হওয়ার তাই হলো। যা অবধারিত তা ঠেকানো গেল না! মাত্র বছর কয়েকের মাথায় পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার মানুষ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতার রক্তাক্ত যুদ্ধ করল, ভারত সে যুদ্ধে বড় ভূমিকা রাখল এবং অনেক বড় ভূমিকা রাখল ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরা!
রথীন দত্ত পেশায় শল্যচিকিৎসক, সারা জীবন মানুষের শরীরে অস্ত্রোপচার করে রোগ সারিয়ে তুলেছেন, কিন্তু তার ঘরের দেয়াল দেখলে মনের দেয়ালের ধারণা পাওয়া যায় বৈকি। দেয়ালে বিভিন্নজনের ছবি রাখা দেখে মল্লিকা সেনগুপ্ত সেটাই ধরতে পারল।
বলল- স্যার, অনেকের মনেই আক্ষেপ আছে ধর্মের নামে ভারত ভাগ হওয়ায়; দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শরৎ চন্দ্র বসু, আবুল হাসিম- এদের প্রস্তাবমতো বৃহত্তর স্বাধীন বঙ্গ না হওয়ায় আক্ষেপ, আপনিও কি সে রকম কোনো আক্ষেপ পোষণ করেন?
ক্যামেরা তখন সরাসরি ডাক্তার রথীন দত্তের মুখের দিকে তাক করা। দত্ত বাবু ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবতে থাকলেন; শিলংয়ের কথা, কলকাতার কথা, ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের কথা, আগরতলার কথা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। যে ব্যক্তি ইতিহাসের পথ ধরে বেড়ে ওঠে তার কাছে ইতিহাস নানা দাবি নিয়ে আসে, যদিও তা সময়ের সব দাবি পূরণ করে না। কিন্তু যতটা করে তারও কম মূল্য থাকে না। হয়তো সে কারণে শ্রী দত্ত ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে লাগলেন।
মল্লিকা ভাবল, ভদ্রলোক নির্ঘাৎ তার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু তা সত্য হলো না। রথীন দত্ত দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে বারকয়েক চোখ ঘুরিয়ে সরাসরি টিভি রিপোর্টারের দিকে চোখ রাখলেন। এই তাকানোতে অনেক প্রশ্ন।
দত্ত বাবু কিছুটা সময় নিলেন, তারপর বললেন- দেখ, আক্ষেপ যদি বল- তা তো আছেই, নিশ্চয়ই আছে। ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ একেবারেই অন্যায্য কাজ হয়েছে, মোটেও সুবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। আমি যুবক বয়সের ছিলাম, মেডিকেলে পড়ি। মনেপ্রাণে চাইছিলাম বাংলা অবিভক্ত থাক, কাটছাঁট না হোক। কিন্তু সেটাই হলো! ধর্মের নামে মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে দেয়াল তোলা হলো, পার্টিশনের কংক্রিট পোঁতা হলো, কাঁটাতার বসল, লাখ লাখ মানুষ শুধু ধর্মের নামে এপার-ওপার হলো, রক্তপাত হলো! কিন্তু আকাশ একই থাকল, বাতাস একই থাকল, পাখিরা যাতায়াত করতে থাকল, শুধু বাঙালি পারল না! সে ক্ষত কি আজও বহন করতে হচ্ছে না? তুমি তো তরুণ প্রজন্মের মানুস- কী মনে হয় তোমার?
চলবে...