![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/05/24/Subornorekha_8+9-HARUN-HABI-1716532551.jpg)
গত সংখ্যার পর
২.
জীবনসায়ান্নে এসে জীবনটাকে মাঝেমধ্যে বেশ ছোট মনে হয় শ্রী দত্তের কাছে। সবকিছু করার বা বলার সুযোগ মেলে না। আবার মনে হয় নব্বইয়ের মতো বয়েস হলো- জীবন আর ছোট থাকল কই! স্ত্রী চলে গেলেন, ছেলেমেয়েরাও দেখতে দেখতে বড় হলো, যার যার কাজ- যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই! রথীন বাবু ভাবতেই পারেননি শেষ বয়েসে এসে এতটাই নিঃসঙ্গ হবেন! তবে এটিও ভাবেন ইতিহাসের এতসব ঘটন-অঘটনের মাঝ দিয়ে পথ হেঁটেছেন- যা তাঁকে নিঃসঙ্গ হওয়ার সুযোগ দেবে কেন।
দেয়ালে টানানো সূর্য সেনের ছবিটার দিকে তাকালেন দত্ত বাবু। এই মাস্টারদা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলেন তার ছাত্রজীবনে। গড্ডালিকায় না ভেসে সত্যিকারের স্বাধীন হওয়ার মন্ত্রণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সূর্য সেন। কিন্তু প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও রথীন দত্ত বিপ্লবী হতে পারেননি। কলেজের সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতেই ১৯৪৭ সাল এসে গেল। সুদীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটল। ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হলো। বাংলা ভাগ হলো। সি আর দাস, শরৎ বসু আর আবুল হাসিমরা হেরে গেলেন। একবার ভাবেন- যদি তারা সফল হতেন?
রথীন দত্ত সবটা দেখেছেন তা নয়, তবে ইতিহাসের অনেককিছুই তার জানা, মনেও পড়ে আগে-পরের সেই ইতিহাস। নিপীড়ক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গান্ধীজি তার অহিংস আন্দোলন শুরু করলেন। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে স্বদেশিরা শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের টার্গেট করতে থাকল। অনুশীলন ও যুগান্তর দলের সদস্যরা বোমা ও পিস্তল হাতে ইংরেজ বিতাড়নে জোর লড়াই চালাল। ঠিক তখনই, অনেকটা অভাবিতভাবেই, চট্টগ্রামের মাটিতে এক বড় প্রলয়ের জন্ম দিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। ঘটনাটা ঘটে রথীন দত্তের জন্মের বছরখানেক আগে। আসামের মঙ্গলদৈ-এ জন্ম তার, খানিকটা বড় হতেই স্কুলে পড়তে পাড়ি দিলেন শিলং শহরে। এরপর ভর্তি হলেন ডিব্রুগড়ের আসাম মেডিকেল কলেজে। ডাক্তারও হলেন ভালো রেজাল্ট করে, এরপর ইন্টার্ন করার সুযোগ ঘটল কলকাতায়, তাও প্রবাদপ্রতীম চিকিৎসা গুরু ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের অধীনে। কয়েক বছর কাটিয়ে এরপর পাড়ি দিলেন লন্ডনে এফআরসিএস পড়তে। দেশে ফিরে চিকিৎসা গবেষণায় আবারও গেলেন বিদেশে- এবার বার্লিনে।
নিঃশব্দে নানা কিছু ভেবে চলছিলেন সার্জন দত্ত। এবার মুখ ঘুরিয়ে রিপোর্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন : শোন, যে স্বাধীন ভারতবর্ষ তোমরা হাতে পেয়েছ জন্মের পর থেকে, তাকে স্বাধীন করার, রাহুমুক্ত করার সংগ্রাম বহু যুগের, বহু মানুষের রক্ত ও আত্মত্যাগ মিশে আছে এই স্বাধীনতায়।
এটুকুন বলেই রথীন বাবু চেয়ার থেকে উঠলেন, পাশের সেলফ থেকে একটা পুরনো বই হাতে তুলে আবারও আসন নিলেন, নিজের মনে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। টিভি রিপোর্টার আগ্রহী হয়ে বিরবির করে বইটার নাম আওড়াল- ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, রচয়িতা পূর্ণেন্দু দস্তিদার।
রথীন দত্ত এককালে নবীন ডাক্তারদের শল্যচিকিৎসা পড়িয়েছেন, সার্জারির টেবিলে বাস্তব জ্ঞান দিয়েছেন। টিভি রিপোর্টারের সামনে তিনি এমনভাবে কথা বলে চললেন যে তিনি যেন ইতিহাস পড়াচ্ছেন ছাত্রকে! সত্যি বলতে কী, ওকে খানিকটা উৎফুল্লও মনে হতে থাকল সে সময়।
-মাস্টারদা, হ্যাঁ, মাস্টারদা সূর্য কুমার সেন। একবার ভাব তো- কী বিস্ময়কর জীবনযাপন করেছেন বাঙালির এই স্বাধীনতা সংগ্রামী! উমাতারা উচ্চবিদ্যালয়ের অঙ্কের শিক্ষক, গোপনে বিপ্লবী দলের নেতা। কম কথা বলার মানুষ, শান্তশিষ্ট, দেখে বুঝবার উপায় নেই মাতৃভূমিকে উপনিবেশমুক্ত করতে জীবন উৎস্বর্গ করতে পারেন! একেবারেই বিয়ে করবেন না ঠিক করেছিলেন কিন্তু বাবা-মা’র চাপে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলেন। কিন্তু সংসারধর্ম পাছে তাকে কর্তব্যভ্রষ্ট করে- এই বিশ্বাসে একটিবারের জন্যও নববধূর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বললেন না তিনি! দেশের ডাকে ফুলশয্যার প্রথাটিও অস্বীকার করলেন সূর্য সেন অবলিলায়! বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।
১৯২৬ সাল। কলকাতায় পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন সূর্য সেন। মুম্বাইয়ের রত্নগিড়ি জেলে থাকলেন। সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন উদ্যমে গোপন বিপ্লবী দলের কার্যক্রম চালাতে থাকলেন। সঙ্গে পেলেন বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী, চারুবিকাশ দত্ত, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, নির্মল সেনকে।
সার্জন দত্ত বলে চললেন- নিশ্চয়ই জান, ১৯২০ সালে গান্ধীজি ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সে আন্দোলনে যোগ দিলেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। যুক্ত হলেন সূর্য সেনও। কিন্তু বছর দুই পর আন্দোলন পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেন গান্ধীজি। কষ্ট পেলেন বাংলার বিপ্লবীরা। বাধ্য হয়ে আবারও তারা আবারও গোপন পথে সক্রিয় হলেন। এরই মধ্যে ঘটল চট্টগ্রামের নাগরখানা পাহাড়ের যুদ্ধ। গ্রেফতার হলেন সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী। ছাড়া পেয়ে আবারও শুরু করলেন গোপন তৎপরতা। আবারও গ্রেফতার হলেন। এবার থাকলেন মেদেনীপুর সেন্ট্রাল জেলে। মুক্তি পেলেন ১৯২৮ সালে। এরই মধ্যে তারই নেতৃত্বে এবং নতুন উদ্যমে চট্টগ্রামের মাটিতে গঠিত হলো একটি শক্তিশালী বিপ্লবী দল। এতে যোগ দিলেন প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, কল্পনা দত্তসহ কয়েকজন নারী বিপ্লবীও।
এবার দেয়ালের দিকে নিজের ডান হাতটা উঁচিয়ে ধরলেন সার্জন দত্ত, বললেন: ওই যে নেতাজীকে দেখছ, জান, তারও সঙ্গে সখ্যতা হয়েছিল মাস্টারদার। ঔপনিবেসিক ইংরেজ শাসনে পিষ্ট ভারতকে মুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে তারা শলাপরামর্শ করেছিলেন। এগিয়েও ছিলেন অনেকটা। কিন্তু শেষটা শেষ হয়নি।
১৯২৮ সাল। কলকাতার পার্ক সার্কাসের কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেন সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, তারকেশ্বর দস্তিদার প্রমুখ চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হয়ে। সেখানেই নেতাজী ও মাস্টারদার মধ্যে ঘটল প্রথম বৈঠক। পরের বছর চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সূর্য সেন। কিন্তু সশস্ত্র পথে ইংরেজ তাড়াবার পথ থেকে তিনি সরে এলেন না। ‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির’ আদলে গড়ে তুলতে থাকলেন ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’। চলল অস্ত্র প্রশিক্ষণ, গোলাবারুদ সংগ্রহ- সব প্রস্তুতি।
এরপর এল ১৯৩০ সাল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সঙ্ঘবদ্ধ ও প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘটল চট্টগ্রামের মাটিতে। এরই ফলে দখলে এল ব্রিটিশের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার, ইউরোপিয়ান ক্লাব, ঘটল জালালাবাদ পাহাড়ের ঐতিহাসিক যুদ্ধ।
রিপোর্টার মল্লিকার ইন্টারভিউ নিতে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বা ত্রিপুরার অবদান নিয়ে কিন্তু রথীন দত্ত যে বাংলার বিপ্লবীর ইতিহাসের একনিষ্ঠ ছাত্র- তা ওর জানা ছিল না। অতএব, বক্তাকে থামাতে সে বিনয়ের স্বরে বলল- স্যার, যদি কিছু মনে না করেন- আমরা এখন কী বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসতে পারি?
কিন্তু রথীন দত্ত রিপোর্টারের কথা কানে তুলবেন কেন! তিনি বলে চললেন- বাংলাদেশের জন্ম তো অন্যায্য ভারত ভাগেরই অনিবার্য পরিণতি। অপেক্ষা কর- আসব সে প্রসঙ্গে।
তারপর বলতে থাকলেন- তোমরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস পড়েছ কি? মনে হয় না। দেখ, তোমাদের জেনারেশনে মোবাইল এসেছে, কম্পিউটার এসেছে, তথ্যপ্রযুক্তি দারুণভাবে এগিয়েছে। পৃথিবীটা মনে হয় হাতের আঙুলে। কিন্তু কেউ তোমরা বই পড়বে না- পড়া উচিত।
সেদিন ছিল শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘রেড লেটার ডে’। পরাক্রমশালী ইংরেজের বিরুদ্ধে বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার পরিকল্পিত সশ্রস্ত্র যুদ্ধ। নির্ধারিত সময়ে চারটা বাড়ি থেকে বের হলেন চট্টগ্রামের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। পাশের রেলস্টেশনে একটা মালগাড়ি উল্টিয়ে রাখা হলো যাতে চট্টগ্রামকে বাইরের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা যায়। পরিকল্পনা মতো কাজ এগোতে লাগল। ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র একটি দল নন্দনকাননের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করল, আগুন ধরিয়ে সব যন্ত্রপাতি ধংস করল- যাতে ব্রিটিশ শাসকরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। অন্য দল পাহড়তলীর ইউরোপিয়ার ক্লাব দখলে নিল, রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করল। নিয়ন্ত্রণে নিল উন্নতমানের বহু রাইফেল ও রিভলবার। আরেকটি দল দখল নিল দামপাড়ার পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক। ওড়ানো হলো চট্টগ্রামের মাটিতে স্বাধীন ভারতের পতাকা।
সার্জন দত্তকে ইতিহাসে পেয়ে বসেছে। এরই মধ্যে বেশ খানিকটা সময় চলে গেছে। এক-দুবার তাকে মূল বিষয়ে ফেরাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে টিভি রিপোর্টার।
-তারপর কী হলো জান? ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ চট্টগ্রামকে স্বাধীন ঘোষণা করল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অধিনায়ক সূর্য সেনকে মিলিটারি কায়দায় স্যালুট জানাল।
চলবে...