![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/05/03/ttipurar-uppakkan-1714717341.jpg)
ত্রিপুরার মাটি বাংলাদেশকে জন্মঋণে আবদ্ধ করেছে, পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ-নির্যাতন থেকে বাঁচতে ১৫ লাখ বাঙালি সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ১৬ লাখ মানুষের ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যে। দেশত্যাগী এই উদ্বাস্তু অসহায়কে আগলে রেখেছে ত্রিপুরাবাসী পরম মমতায়। সীমান্তছোঁয়া আগরতলা এবং ত্রিপুরার পাহাড়, সমতল, গ্রাম, শহর-গঞ্জ সয়লাব হয়েছে লাখো ভিনদেশি জনস্রোতে ও মুক্তিবাহিনীর পদভারে। হাসপাতালগুলো ভরে উঠেছে আহত নারী-পুরুষে। ১৯৭১-এর বিস্ময়কর সেই ঐতিহাসিক উপাখ্যান প্রথমবারের মতো উঠে এসেছে উপন্যাসে।...
আগরতলার কুঞ্জবন থেকে শেষ পর্যন্ত কলকাতার গল্ফ গ্রিনের বাড়িতে পাড়ি জমাতে হয়েছে ডা. রথীন দত্তকে। বন্ধুবান্ধব ও ঘনিষ্ঠজনরা তার ত্রিপুরা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মত দেয়নি। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে নিজের রাজ্যে থাকা হলো না প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক রথীন দত্তের। দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে অবসর নিলেন। ভাবলেন, যে বাড়িতে জীবনের এতগুলো বছর কাটল সেই বাড়িতে বাকি জীবনটাও কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। আগরতলার স্মৃতিঘেরা বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমাতে হলো তাকে দক্ষিণ কলকাতায়।
গল্ফ গ্রিনের বাড়িটা বেশ বড়, প্রচুর আলোবাতাস, বিস্তর গাছগাছালি, প্রশস্ত একটা ফুলবাগান। আধুনিক জীবনযাপনের প্রায় সবই আছে বাড়িটায়। কিন্তু সবকিছু থাকলেও লোকজন নেই। আগের বাড়িতে হরহামেশা লোকজনের যাতায়াত ছিল- এখানে তা নেই। কেমন এক সুনসান নীরবতা। ছেলেমেয়েরা দূর-দূরান্তে নিজেদের জীবনজীবিকা গুছিয়ে নিয়েছে। স্ত্রী গাইনোকলজিস্ট ডা. স্বপ্না দত্ত। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন সময় কমবেশি কাটত। অবসর নেওয়ার পর তিনিও গত হলেন। এখন নব্বই ছুঁইছুঁই বয়স সার্জন দত্তের। শরীর খানিকটা দুর্বল- ইচ্ছে করলেই আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বাইরেও যান না এখন। পুরনো সার্জন বন্ধুরা কেউ কেউ টেলিফোনে কথা বলেন, জুনিয়র ডাক্তাররা নানা বিষয়ে পরামর্শ নেয়, ভালোমন্দ খবর জানতে চায়। সার্জারির জরুরি কনসালটেন্সির কলও পান মাঝে-মধ্যে।
এদিকে বিশ্বে নতুন মরক শুরু হয়েছে। বিশ শতকের প্লেগ ১০০ বছর পেরোতেই একুশ শতকে এসে করোনার তাণ্ডব শুরু করেছে। ইউরোপের কিছু দেশে দলে দলে লোকজন মারা যাচ্ছে। এদের মধ্যে বয়স্ক মানুষের ভাগই বেশি। ভারতেও রোগটি ধরা পড়েছে কিন্তু মৃত্যুহার এখনো আতঙ্কজনক হয়ে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির বাইরে যাওয়া আরও সীমিত হয়েছে তার। চারদিকেই মৃত্যুর আতঙ্ক!
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একটা রুটিন, অভ্যেসও বলা যায়, রপ্ত করেছেন সার্জন দত্ত। সকালে চা নিয়ে খবরের কাগজ হাতে দক্ষিণের জানালামুখী ড্রইং রুমটায় বসেন। রয়াল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাবের বিস্তৃত উদ্যান, দক্ষিণ কলকাতার বহু জায়গা দেখা যায় জানালা দিয়ে। সকালের সময়টা এভাবেই কাটান তিনি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণার খবর নেন। নিজের রাজ্য ত্রিপুরার খবরাখবর জানার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের খবর পেলে প্রথম থেকে শেষ অব্দি চোখ বুলিয়ে নেন। চোখের ঝামেলাটা বেশ খানিকটা বেড়েছে, তবু চশমা চোখে নিয়মিত টেলিভিশন দেখেন। এক-দুটো বইও পড়েন। রবীন্দ্রসংগীত ও শচীন কর্তার গানের ভক্ত তিনি, আগে রেডিওতে শুনতেন, এখন একটা সাউন্ড সিস্টেম লাগিয়েছেন। বাছাই কিছু গান শুনে সময় কাটান।
নিচতলার দক্ষিণমুখী যে ঘরটায় প্রতিদিন সকালে তিনি বসেন, তার দুটি দেয়ালে নিজের পেশাগত ও পারিবারিক জীবনের অনেক স্মৃতিস্মারক সাজানো আছে। স্ত্রী, সন্তান ও নিজের ছবির বাইরেও আছে কয়েকটি বিশেষ মানুষের ছবি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সি আর দাস, শরৎ চন্দ্র বসু, নেতাজী সুভাষ বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, মাস্টারদা সূর্য সেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্ত্রীর সঙ্গে মিলে নিজের রুচিতে ছবিগুলো পরিপাটি করে সাজিয়েছিলেন তিনি নতুন বাড়িতে ওঠার পর পর- সেও অনেক বছর হলো। দীর্ঘকালীন গৃহকর্মী ভজহরি এখন ধুলোবালি পরিষ্কার করে। অবসরপ্রাপ্ত সার্জন চেয়ারে বসেন, চশমাটা ঠিকঠাক করে দেয়ালের দিকে তাকান। ভারতের অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরার দ্বিতীয় পদ্মশ্রী উপাধি লাভের গৌরব তার। শিক্ষাগত ও ডাক্তারি জীবনেরও অর্জন কম নেই। এর বাইরে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা এবং আরও আছে একটি নয়-দশ বছরের বালিকার ছবি। তারও পাশে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সিল দেওয়া একটি পুরনো খাম। খামের লেখাগুলো খুব স্পষ্ট না হলেও পড়া যায়। লেখাটা এ রকম: ‘বড় আব্বা, ডা. রথীন দত্ত, জিবি হাসপাতাল, কুঞ্জবন, আগরতলা, ত্রিপুরা, ভারত।’
পুরনো এই খামটা ডাক্তার দত্তের জীবনের বড় স্মৃতিস্মারক। মাঝেমধ্যে পা ফেলে তিনি দেয়ালটার কাছে যান। চশমা মুছে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেন। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
একদিন সকালের চা খেতে খেতে আনন্দবাজারসহ কয়েকটা দৈনিকের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন রথীন বাবু। পাশের টেবিলে রাখা আগরতলার দৈনিক সংবাদ ও কলকাতার আরও কিছু কাগজ। হঠাৎ একটি খবরে তার চোখ পড়ল। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের, সে নিয়ে কলকাতার সাউথ ব্লক ও ঢাকার সেগুন বাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আগাম প্রস্তুতি চলছে। নতুন দিল্লি ডেটলাইনের খবরটা তিনি মনোযোগসহকারে পড়লেন। কী মনে করে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে সাঁটানো পুরনো চিঠিটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। ইদানীং তার হাত কাঁপে- তবু পিন খুলে চিঠিটা হাতে নিলেন সার্জন দত্ত। তারপর আবার চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
চলবে...