![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/06/07/HARUN-HABIB-Subornorekha-1717741151.jpg)
গত সংখ্যার পর
বছর কয়েকের মধ্যে উচ্চশিক্ষা নিতে যেতে হলো রথীন দত্তকে বিলেতে। দেশে ফিরলেন ১৯৬০ দশকের মাঝামঝি। কলকাতা ও দিল্লিতে স্থায়ী বসবাসের বিস্তর সুযোগ ছিল তার কিন্তু সে লোভ তিনি অগ্রাহ্য করলেন। নিজের ইচ্ছেয় ত্রিপুরার জিবি- অর্থাৎ গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালে যোগ দিলেন। ভারতের ক্ষুদ্র রাজ্যের মানুষ তিনি, ভাবলেন, আরেক দেশের সীমানা দিয়ে তিন দিক ঘেরা রাজ্যটির গরিব মানুষদের সেবা দিলে জীবন সার্থক হবে। স্ত্রী স্বপ্না রায় গাইনোকোলিজস্ট, তাকেও বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাজি করালেন। তারপর একদিন সোজা আগরতলার কুঞ্জবনের বাড়িতে এসে উঠলেন। পুরনো বন্ধুরা রথীনকে নিজ রাজ্যে পেয়ে খুশি হলো।
প্রাচীনকাল থেকে সমতল বাংলার সীমানা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি ত্রিপুরার গভীর হৃদ্যতা। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ত্রিপুরার মানিক্য মহারাজাদের বহুকালের সম্পর্ক, সেই যোগসূত্রকে স্থায়ী সুখ-দুঃখে নিবিড় করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর ভিত্তিমূলে ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মানিক্য মহারাজাদের গভীর প্রীতি। বাংলাতেও যখন বাংলা ভাষার সরকারি মর্যাদা নেই, ফার্সি ও ইংরেজি যখন সবকিছুর ওপরে, ত্রিপুরার রাজভাষা তখনো বাংলা! প্রায় অবিশ্বাস্য এক অতীত!
ত্রিপুরার আধুনিক ইতিহাসের সূচনা ঘটে মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্যের শাসনামলে। বলা যায় তখন থেকেই শিক্ষা, সংগীতচর্চা ও গুণীজনের সমাবেশ- ইত্যাদি আধুনিক জীবনের লক্ষণগুলো স্থান করে নিতে থাকে ত্রিপুরায়। সেকালের কিশোর রবীন্দ্রনাথকে, যার পরিচিতি যখন কেবলই পরিচিতজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাকে সর্বপ্রথম ‘কবি’ বলে স্বীকৃতিদান করলেন মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, ‘যে অপরিণত বয়স্ক কবির খ্যাতির পথ সম্পূর্ণ সংশয়সংকুল ছিল, তার সঙ্গে কোনো রাজত্ব গৌরবের অধিকারীর এমন অবারিত ও অহেতুক সখ্য-সম্বন্ধের বিবরণ সাহিত্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব।’ মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য সর্বপ্রথশ রবীন্দ্রনাথকে ‘কবি’র সম্মানে ভূষিত করলেন এবং তারই প্রপৌত্র বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য কবিগুরুকে সম্মানিত করলেন ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি দিয়ে।
পোনে ২০০ বছরের শাসনে ইংরেজ যদিও ত্রিপুরাকে সরাসরি শাসন করেনি তবুও ত্রিপুরা তাদের বৃত্তের বাইরে যায়নি। এর পরও স্বাধীনচেতা মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রিটিশবিরোধী বাঙালি স্বদেশি যোদ্ধাদের এককালীন আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে ত্রিপুরার পাহাড়। বাংলার বিপ্লবীরা আশ্রয় লাভ করেন ত্রিপুরার মাটিতে, যা ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। প্রবীণ সমাজতন্ত্রী নেতা বীরেন দত্ত সে কারণেই লিখেছেন : ‘১৯০৯ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক সমস্ত বিপ্লবী দলগুলোর প্রকাশ্য কাজকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর এই শহরটিকে (আগরতলা) তারা আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।’
ত্রিপুরার মহারাজাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা, সংগ্রামী। ভারতের বেশির ভাগ রাজা-মহারাজার মতো ভোগবিলাসী নন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘হিস্ট্রি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘ত্রিপুরার রাজাদের অনুগত প্রজা বা সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ি এলাকা বিলোনিয়া ও উদয়পুরে দুটো খামার ছিল। সেগুলো দৃশ্যত কৃষি খামার হলেও মূলত তা ছিল প্রশিক্ষণ শিবির। দিনের বেলায় সমিতির সদস্যরা মাঠে কাজ করত; কিন্তু রাতের বেলা তাদের বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো এবং নিকটবর্তী পাহাড়ে গিয়ে তারা গোলাগুলির মহড়া দিত।’
ত্রিপুরার এ মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতায় আগরতলার রাজপ্রাসাদে শহিদ ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিনে কীর্তনের আয়োজন করা হয়- যা ছিল প্রকাশ্য প্রতিবাদ। এর জন্য অবশ্য দামও দিতে হয়েছে মহারাজাকে। রাধাকিশোর মানিক্যের ‘মহারাজা’ উপাধি কেড়ে নিয়েছে ইংরেজ।
মহারাজাদের হাতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির যে পৃষ্ঠপোষকতা, তারও সূত্রপাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। কবিবন্ধু জগদীশ চন্দ্র বসু বিলেতে গিয়ে বিজ্ঞান সাধনা করবেন। প্রচুর অর্থ চাই তার। অতএব, অর্থ সংগ্রহে মাঠে নামলেন বন্ধু রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য বাধ সাধলেন। তিনি কবিগুরুকে চিঠি লিখলেন : ‘এ বেশ আপনার সাজে না, আপনার বাঁশি বাজনাই কাজ, আমরা ভক্তবৃন্দ ভিক্ষার ঝুলি বহন করিব।’ রাধাকিশোর আরও লিখলেন :‘প্রজাবৃন্দের প্রদত্ত অর্থই আমার রাজভোগ জোগায়- আমাদের অপেক্ষা জগতে কে আর বড় ভিক্ষুক আছে।’
সেকালে জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনার কাজে ৫০ হাজার টাকা দান করেন রাধাকিশোর মাণিক্য। উদাত্ত সহায়তা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির
প্রতিষ্ঠার কাজে। শুধু তাই নয়, অন্ধ কবি হেমচন্দ্র এবং ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাদের জীবনের অন্যতম সংকটতম মুহূর্তে ত্রিপুরার মহারাজাদের মাসোহারা পেয়ে সংকটমুক্ত হয়েছেন। বিশ্বভারতী স্থাপনে মুক্তহস্তে দান করেছেন ত্রিপুরার মহারাজা।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। রবীন্দ্র অনুরাগীরা আগরতলার উমাকান্ত একাডেমিতে ‘রাখিবন্ধন উৎসব’ পালন করে ১৯০৬ সালে। অবশ্য আন্দোলনে সহিংসধারার সূচনা দৃশ্যমান হতেই দূরে সরে যান কবি।
আশি বছরের জীবনসীমার প্রায় ষাট বছরই ত্রিপুরার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বীরচন্দ্র মাণিক্য, রাধাকিশোর মাণিক্য, বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য ও বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য- এই চার মহারাজার সঙ্গে সম্পর্ক কবির। বোধ করি, এই অসামান্য যোগসূত্রের কারণেই কবি তার ‘রাজর্ষি’ এবং ‘বিসর্জন’ ছাড়াও অসংখ্য গান এবং কবিতা উপহার দিয়েছেন ত্রিপুরাকে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্ব কিছু ক্ষেত্রে এতটাই গভীরে প্রবেশ করে যে, রাজপরিবারের একান্ত ব্যক্তিগত কলহেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ! সে আরেক ইতিহাস।
‘রাজমাল্য’য় আছে: ত্রিপুর রাজাদের অধিষ্ঠান ছিল এককালে ফিরাত দেশে। বর্তমান বাংলাদেশের অনেক জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ছিল এই ফিরাত রাজ্য। চীনা পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা ঘুরে এমনি এক দেশের নামোল্লেখ করেছেন। কেবল ফিরাত নয়, ব্রিটিশ আমলেও ত্রিপুরা যুক্ত ছিল বাংলার সঙ্গে। সে সংযোগ আজ নেই। নতুন সীমানা ব্যবচ্ছেদ করেছে শরীর! কিন্তু হৃদয়? তাকেও কি ছেড়া গেছে? সম্ভবত নয়। ত্রিপুরার গোমতী শরীর বিছিয়ে আছে বাংলার মটিতে।
চলবে...