![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/05/31/HARUN-HABIB-1717138907.jpg)
গত সংখ্যার পর
ভারতের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের ঘোষণা দিলেন বাংলার সূর্যসন্তান সূর্য সেন।
এ পর্যন্ত বলেই রথীন দত্ত দাঁড়ালেন। সে সময় তাকে অনেকটাই অস্থির মনে হতে থাকল। প্রশস্ত ঘরটার একপাশে একটা বড় লাইব্রেরি। সেখানে গিয়ে একটি বই খুঁজে বের করলেন। সেটি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা খুঁজে বের করলেন। এরপর বললেন- সূর্য সেন ভারতের স্বাধীনতার সেই ঘোষণায় কী বলেছিলেন, জান? ইংরেজিতেই বলেছিলেন কারণ সারা বিশ্ব যেন জানতে পারে।
এই বলে তিনি পড়তে শুরু করলেন : ‘The great task of revolution in India has fallen on the Indian Republican Army. We, in Chittagong, have the honour to achieve this patriotic task of revolution for fulfilling the aspiration and urge of our nation. It is a matter of great glory that today our forces have seized the strongholds of Government in Chittagong…The oppressive foreign Government has closed to exist. The National Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood’.
পড়া শেষ হতেই সার্জন দত্তকে খানিকটা উত্তেজিত মনে হতে থাকল। টেবিলে রাখা গ্লাসটা তুলে নিজেই অর্ধেক গ্লাস গলায় ঢাললেন। চশমাটা আরেকবার পরিষ্কার করলেন। মল্লিকা সেনগুপ্ত কিছু বলতে যাচ্ছিল, হয়তো প্রসঙ্গ থেকে সরাতে, কিন্তু ওকে হাত দিয়ে বারণ করলেন।
এরপর বলতে থাকলেন।
-সিপাহি বিদ্রোহের পর শাসক ইংরেজের বিরুদ্ধে এটিই ছিল সর্বাত্মক সশস্ত্র সংগ্রাম। কিন্তু সেই স্বাধীনতা বেশিদিন টেকানো গেল না। খাদ্য নেই, আধুনিক কিছু অস্ত্র জোগাড় হলেও গোলাবারুদ নেই। অতএব, চারদিক থেকে কয়েক শ ইংরেজ সেনা দ্রুত চট্টগ্রামে এসে জড়ো হলো। খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা জালালাবাদ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। চার দিন পর। ২২ এপ্রিল ১৯৩০। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলতে থাকল ভয়ংকর যুদ্ধ। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলো ‘ইন্ডিয়ার রিপাবলিকান আর্মি’। শহিদ হলেন প্রায় ১০০ স্বাধীনতা সংগ্রামী। ব্রিটিশের পক্ষে মারা গেল ৭০ জন। কিন্তু ইংরেজ বাহিনী সূর্য সেনকে ধরতে পারল না। তিনি ধরা পড়লেন অন্যত্র। এরপর ফাঁসি হলো তাঁর।
এ পর্যন্ত বলে রথীন দত্ত হয়তো অনুভব করলেন তিনি সত্যি সত্যি রিপোর্টারের দাবি মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অতএব, হাসলেন এবং বললেন, এই যে মেয়ে, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছ?
মল্লিকা সেনগুপ্ত যথেষ্টই বুদ্ধিমতি। বলল- না স্যার, একেবারে না। অনেককিছুই জানা হলো আমার। এবার চলুন আমরা ১৯৭১ সালে ফিরি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু তো বলার আছেই ডা. রথীন দত্তের। পাঁচ দশক সময় গেলেও সেদিনের ঘটনাবলি তার মতো একজনকে আজও স্মৃতিকাতর করে। কিন্তু কীভাবে, কতটা গুছিয়ে বলবেন তিনি, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবেন? এসব ভাবতে ভাবতে ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকিয়ে, হাত বাড়িয়ে, কিছুক্ষণের জন্য ছবি তোলা আটকে রাখলেন তিনি। ভজহরিকে ডেকে সবার জন্য আরেক প্রস্থ চা দিতে বললেন। কাজের মেয়ে রাধাকে বারকয়েক জোরে জোরে ডাকলেন। ‘আসছি’ বলে উত্তর দিলেও আসতে দেরি হচ্ছে দেখে রথীন বাবু নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ড্রইং রুমে পায়চারি করতে থাকলেন।
তরুণ রিপোর্টার ভাবল আসল কাজটা বুঝি আজ আর হলো না! কিন্তু দত্ত বাবু তাকে নিরাশ করলেন না। বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললেন, দেখ, অনেকদিন ধরেই ভাবছি ত্রিপুরার মাটিতে বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখব, অনেক আগেই লেখা উচিত ছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি!
নিশ্চয়ই হবে স্যার, কেন হবে না। একটু বসুন, একটু বিশ্রাম নিন।
মল্লিকা সেনগুপ্ত ত্বরিৎ কথা বলে রথীন বাবুকে হাত ধরে চেয়ারে এনে বসাল এবং কিছুটা আবদারের স্বরে বলল, আপনাদের মতো মানুষের কাছে আমাদের অনেক দাবি স্যার, এ দাবি ইতিহাসেরও। যতক্ষণ ভালো লাগে বলুন, যতটা পারি আমরা রেকর্ড করব, বাকিটা নোট নেব। টিভি চ্যানেলে খুব কম ফুটেজই ব্যবহার করা যাবে, তবে সবটা নিয়ে একটা স্মৃতিকথা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যদি আপনি রাজি থাকেন।
সার্জন দত্ত মেয়েটির কথায় খুশি হলেন বলে মনে হলো। মুচকি হাসলেন এবং বললেন- তা ঠিক আছে, তবে এক বৈঠকে হবে না, বারকয়েক আসতে হবে তোমাকে- সেটা পারবে তো?
সে কোনো ব্যাপার নয় স্যার, আমি আসব, বারবার আসব। আপনার মতো মানুষের স্মৃতিকথা থাকা উচিত, পরের প্রজন্মের জন্য একটা বই থাকা উচিত। আজ যা যা মনে পড়ে বলে যান, যতটা পারেন, এরপর আবার আসব।
আগরতলার ডাক্তার রথীন দত্ত, ত্রিপুরা রাজ্যের খ্যাতিমান সার্জন রথীন দত্তের মুখ থেকে বোঝা গেল তিনি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রতিশ্রুতির সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন। জীবনে বইপত্র কম পড়েননি কিন্তু একটি বইও লেখা হয়ে ওঠেনি এ যাবৎ। জীবনভর শুধু ডাক্তারি বিদ্যার ইংরেজি বই ঘাটতে হয়েছে। তাই ভাবলেন, একজন লেখিয়ে যখন পাওয়া গেল তখন মন্দ কী। অতএব, তিনি মনে মনে তৈরি হতে লাগলেন। টিভি ক্যামেরা আবারও চালু হলো, মল্লিকা সেনগুপ্ত তার ফোনের ‘ভয়েস মেমো’ চালু করে দত্ত বাবুর সামনে এগিয়ে গেল। কলম, নোট বইটি ঠিকঠাক করে নিল।
পাঠকদের উদ্দেশে বলে রাখি, রিপোর্টার মল্লিকা সেনগুপ্ত এরপর অনেকবারই এসেছেন সার্জন দত্তের বাড়ি, নোট নিয়েছেন তার স্মৃতিকথার। সে বয়ান আগে-পিছে করে, বলা যায়, কোনোরকম কাটছাঁট না করেই এ উপাখ্যানে স্থান পেয়েছে। এই কাহিনির কথক আগরতলার জিবি হাসপাতালের এমন একজন সার্জন- যার একই সঙ্গে আছে দুটি গৌরব- একটি স্বদেশের ‘পদ্মশ্রী’ অন্যটি বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’।
৩.
বছর কয়েক হলো ভারত স্বাধীন হয়েছে। ইউনিয়ন জ্যাক নেমে গেছে দিল্লির লাল কেল্লা থেকে। পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তান হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ নতুন ভারতে পড়েছে। চারদিকে দেশভাগের আতঙ্ক, যন্ত্রণা- হৃদয়ছেঁড়া সব যন্ত্রণা! পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের নানা ধর্ম সংঘাতে সে আতঙ্ক চরমে উঠেছে। লাখ লাখ আতঙ্কিত হিন্দু ধর্মাবলম্বী পিতৃপুরুষের বাড়িঘর ফেলে রাতারাতি নতুন ভারতে পাড়ি দিচ্ছে। এদের বেশির ভাগ ঠাঁই নিচ্ছে নতুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হিন্দু পরিবারগুলো আশ্রয় নিচ্ছে ত্রিপুরার মাটিতে। কেউ যাচ্ছে আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ের দিকে। অন্যদিকে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের একটি বড় অংশ ঘরবাড়ি রেখে পাড়ি জমাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে। উর্দুভাষী মুসলমানদের আরও একটি বড় অংশ আসছে বিহার থেকে। দেশ ভাগ সবকিছু তছনছ করেছে- সবকিছু লন্ডভন্ড হয়েছে টর্নেডোর ভয়ংকর আঘাতে!
আসামের ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর কলকাতায় চলে এলেন তরুণ রথীন দত্ত। ভাগ্যগুণে ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের অধীনে ইন্টার্ন করার সুযোগ পেলেন। কীর্তিমান বিধান চন্দ্র রায়- ১৯৫০ থেকে টানা মুখ্যমন্ত্রী- ১৯৬২ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। একদিকে সামলে চলেছেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লাখো শরণার্থীর চাপ, তাদের পুনর্বাসন, অন্যদিকে সামলে চলেছেন রাজ্যের প্রশাসনিক অবব্যবস্থা। এরই মধ্যে গড়ে তুললেন রিফিউজিদের জন্য সল্ট লেক, গড়ে উঠল বিধাননগর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান বিমান সৈনিকরা নদীয়ার যে জায়গাটায় ঘাঁটি বানিয়েছিল সেই পরিত্যক্ত স্থানে গড়ে তুললেন তিনি আধুনিক কল্যাণী শহর। আশ্চর্য এক মানুষ ডাক্তার বিধান রায়! এসব কিছু সামলেও দিয়ে চলেছেন গণমানুষের চিকিৎসাসেবা। রথীন দত্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতেন অসামান্য মানুষটাকে!
চলবে...