![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/06/21/HARUN-HABIB-flat-1718951308.jpg)
গত সংখ্যার পর
তবে সব উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে হাসপাতালে সদ্য ভর্তি হওয়া সাবিনা নামের একটি ছোট বালিকার মুখ বারবার ভেসে ওঠে রথীন দত্তের চোখে। কী পবিত্র, ঠিক যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ! গায়ে চেককাটা ফ্রক। ক্ষত স্থানগুলো থেকে রক্ত ঝরে কাপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটে, মুখে,গালে, পেটে, ঊরুতে নেকড়ের উন্মত্ব থাবার জ্বলজ্বলে চিহ্ন! আশ্চর্য, তবু মেয়েটি বেঁচে আছে! নিষ্প্রণ শুয়ে থাকে সাবিনা জিবি হাসপাতালের বেডে। ওকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়। জ্ঞান ফিরলে যন্ত্রণায় ছটপট করে ওঠে- চিৎকার করতে থাকে। এক দুবার চোখ খুললেও আবার বন্ধ করে।
খুবই সামান্য বয়স মেয়েটার। বছর দশেক হলেও হতে পারে। নারী শরীরের চিহ্নগুলো পুষ্ট হতে তখনো বাকি। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি ওর! এক রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের কয়েকটি ট্রাক ওদের গ্রামে ঢুকল। এ গ্রামে নাকি মুক্তিবাহিনীর লোকজন আশ্রয় পায়, যাতায়াত করে। অতএব, নির্বিচারে আগুন ধরাল সৈন্যরা ঘরবাড়িতে। যুবক ও মধ্যম বয়েসী পুরুষরা যে যেদিকে পারল দৌড়ে পালাল। যারা পারল না তারা হয় গুলিতে মরল নয় আহত হয়ে কোকরাতে থাকল। মেয়েদের বেশির ভাগ অসহায় হয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বাঁচবার চেষ্টা করল। মিনিট কয়েকের মধ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে বীরদর্পে সৈন্যদের একটি দল সাবিনাদের বাড়িতে ঢুকল। উন্মত্ত সৈন্যদের হাতে মা পারভীন আক্তারসহ ধরা পড়ল সাবিনা। বাবা বাড়ি নেই, খুলনার দৌলতপুরের কোনো জুট মিলে কাজ করে। অতএব, সে কিছুই জানতে পারল না। উল্লসিত সেনারা মুহূর্তে মা ও মেয়েকে বিছানায় নিয়ে গেল। তারপর পালা করে ধর্ষণ করতে থাকল। সে রাতে সাবিনা ও তার মায়ের আর্তচিৎকার শোনা গেছে বহুদূর পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা জ্ঞান হারিয়েছে!
ডাক্তার দত্ত জানেন না কীভাবে মেয়ে ও মা কুমিল্লা অঞ্চলের একটি গ্রাম থেকে আগরতলা পর্যন্ত আসতে পেরেছিল। গ্রামবাসীদের অনেকেই যারা ঘরবাড়ি ফেলে বর্ডার পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরায় ঢুকেছে, হয়তো তাদেরই কেউ সাহায্য করে থাকবে। কিংবা গ্রামের যুবকরা যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ত্রিপুরায় পাড়ি দিয়েছে, তাদেরও কেউ সাহায্য করে থাকতে পারে।
সাবিনাকে যেদিন প্রথম দেখেন সেদিন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার দত্ত। এমন নিষ্ঠুরতা কেবল পশুরাই করতে পারে! মেয়েটিকে নেকড়ের মতো কামড়িয়েছে সৈন্যরা। পালাক্রমিক ধর্ষণে ওর যৌনাঙ্গটা এমনভাবে বিক্ষত হয়েছে যে আদৌ তা সারিয়ে তোলা যাবে কি না সন্দেহ আছে! ডাক্তার দত্ত অনেকক্ষণ সাবিনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কী করে বাঁচাবেন ওকে! মূত্রনালিটা ছিঁড়ে গেছে, অপুষ্ট যৌনাঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়েছে। অচেতন করে একাধিক নল লাগানো হয়েছে কৃত্রিম সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য।
এসব ভাবতে ভাবতেই কুঞ্জবনের বাড়ির সামনে পৌঁছলেন সার্জন দত্ত। গাড়ি দাঁড় করাতেই বিএসএফ-এর একটি জিপ এসে থামল। একটা চেনা ডাক ‘দত্ত দা- কেমন আছেন? কী হালচাল আপনার?’ শুনতেই তাকিয়ে দেখলেন সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য গলা বাড়িয়ে আছে। বললেন- অনেক যে রাত হলো দাদা? হাসপাতালে খুব কাজ বুঝি?
দত্ত বাবু উত্তর দিলেন- জানেন তো ওপারের রোগীতে হাসপাতাল সয়লাব। রাত না করে উপায় কী বলুন? তা আপনি কোথা থেকে?
আমরা শালবাগান থেকে ফিরছি, বিএসএফ-এর একটা গাড়ি পেলাম। জানেন তো মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প হয়েছে? পুরোদমে ট্রেনিং চলছে। খবরের কাগজে কাজ করি তো, তাই খবরাখবর নিতে যেতে হয়।
এরই মধ্যে জিপ থেকে নেমে অনিল ভট্টাচার্য রথীন দত্তের কাছে এগিয়ে এলেন। ফিস ফিস করে জানতে চাইলেন- ওই যে বাচ্চা মেয়েটা, মানে আপনার রোগী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া না কুমিল্লার, সে এখন কেমন আছে? বাঁচবে মনে হয়?
ডাক্তার দত্ত প্রথমে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেননি।
অনিল ভট্টাচার্য জানবে কি করে! একবার ভাবলেন সাংবাদিক মানুষ হয়তো জেনে গেছেন, আবার ভাবলেন ওর স্ত্রী সুনন্দা সরকারি পরিবার মঙ্গল পরিদর্শক, তার হাসপাতালেই, হয়তো সে সূত্রেই জেনে থাকবে। কথা না বাড়িয়ে দত্ত বাবু বলেন, মেয়েটার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল, ওকে ভালো করে তোলার একমাত্র পথ মেজর সার্জারি। কিন্তু আপনি তো জানেন কী আছে আমাদের? কীভাকে কী করব এখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি। ভগবানই জানেন ওর ভাগ্যে কী আছে।
অনিল ভট্টাচার্য খুবই ব্যস্থ মানুষ, একটা ছোট ছাপাখানা চালান। কলকাতার যুগান্তর, পিটিআই সংবাদ সংস্থা এবং মাদ্রাজের দি হিন্দু পত্রিকার আগরতলার স্থানীয় প্রতিনিধিও। জিপে ওঠার আগে নিজের সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমাচার পত্রিকার একটি সংখ্যা শ্রী দত্তের হাতে দিয়ে বললেন- অনেকগুলো লেটেস্ট স্টোরি আছে। পড়ে দেখবেন। পরিস্থিতি খুব জটিল দাদা। শুনলাম আমেরিকা পাকিস্তানকেই সাপোর্ট দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী আগরতলায় আসবেন শুনেছেন নিশ্চয়ই? আর ওপারে খুনখারাপি, লুটপাট, ধর্ষণ যেভাবে চলছে তাতে কোথাকার জল কোথায় গড়াবে বোঝা মুশকিল। আচ্ছা আসি আজ।
প্রচুর খোঁজখবর রাখেন ভদ্রলোক। ওর মেলার মাঠের বাড়িটায় পূর্ববঙ্গের মানুষের ভিড় লেগে থাকে। একদিকে ভারতের সব প্রান্তের সাংবাদিক যেমন আসেন অন্যদিকে পূর্ব বঙ্গের রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনা অফিসার- কে যায় না ওর বাড়িতে। বাড়ির ঠিক উল্টোপাশেই রাজ্য এমএলএস হোস্টেল, যেটি এরই মধ্যে শরণার্থী ব্যক্তিদের মূল আস্তানায় পরিণত হয়েছে।
বিএসএফ-এর গাড়িটা চলে যেতেই ডাক্তার দত্ত চুপচাপ ঘরে ঢুকলেন। হাতমুখ পরিষ্কার করে প্রথমে পাশের কামরায় গেলেন। দেখলেন, তার আট বছরের মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। পা টিপে মেয়ের কাছে গেলেন, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হাসপাতালে যন্ত্রণাবিদ্ধ মেয়েটার মুখ দেখতে পেলেন নিজের মেয়ের মুখে। মানুষকে বনের পশুর চাইতেও বেশি পশু মনে হলো তার।
এরপর বাধরুম থেকে বেরিয়ে সার্জন দত্ত খাবার টেবিলে গিয়ে বসলেন, সবকিছুই সাজানো আছে। কিন্তু কিছু মুখে দিতে পারলেন না। স্ত্রী ঘুমিয়ে গেছে। ভাবলেন ডাকবেন কিন্তু ডাকলেন না। সোজা গিয়ে লাইব্রেরি থেকে সার্জারির একটা বই বের করে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। মুখের, বুকের, শরীরের কামড়গুলোকে না হয় সারিয়ে তোলা যাবে, কিন্তু ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত যৌনাঙ্গের ছিন্নভিন্ন অংশগুলোকে কী করে সারিয়ে তুলবেন তিনি!
হঠাৎ স্ত্রীর কথায় রথীন দত্ত মুখ ঘুরালেন।
চলবে...