![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/06/14/Tripura-upakkhan-1718350333.jpg)
গত সংখ্যার পর
৪.
সার্জন রথীন দত্ত ভেবে চলেছেন ভারতের ক্ষুদ্র রাজ্যটির কথা, ত্রিপুরার অতীতের কথা। টিভি রিপোর্টারকে সামনে পেয়ে বলছিলেনও ছিটেফোঁটা। শরীরটা ইদানীং তার ভালো যায় না। তবু তিনি ভাবেন- মাত্র ১০০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সবকিছু পাল্টে গেল! পুরনো গিয়ে নতুন এবং নিত্যনতুন এল।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত নিজ রাজ্য ত্রিপুরাতেই বাসা বাঁধলেন ডা. রথীন দত্ত। কুঞ্জবনের পৈতৃক বাড়িতে থাকেন। দিনের বেশির ভাগ সময় হাসপাতালে কাটান, রাত গভীরে বাড়ি ফেরেন। প্রথম দিকে কয়েক বছর খুবই ব্যস্ততায় কাটল। সার্জারি বিভাগ গোছানো এবং সুপারের দায়িত্ব পালনে কখন যে বছর চলে গেল বুঝতেই পারলেন না! এরই মধ্যে এল ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৭০-এর নির্বাচনি ফলাফল মানবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগকে দেশ শাসন করতে দেবে না। দেশের সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের ওপর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। ওরা অস্ত্র দিয়ে বাঙালিকে দমাতে চায়। এ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে বাঙালিদের স্বাধীনতার লড়াই। এপার থেকে ওপারের ঘরবাড়ি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। রাতে সে আগুন ত্রিপুরার জনপদকেও আলোকিত করে তুলছে। মর্টার সেল ও কামান দাগার বিকট শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ করেই দলে দলে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ত্রিপুরায় ঢুকতে শুরু করেছে। সীমান্তরক্ষীরা বাধা দিয়েও পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহেই সোনামোরা, ধর্মনগর, বিশালগড়, খোয়াই হয়ে সাব্রুমের এলাকাগুলো আরেক দেশের ছিন্নমূল মানুষে ভরে উঠেছে। সে এক অভাবিত দৃশ্য!
কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। একদিন রাত ২টার মতো হবে। নিজেই অ্যাম্বাসেডর চালিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন রথীন দত্ত। গুলি ও বোমার আঘাত নিয়ে প্রায় শ’খানেক মানুষ এরই মধ্যে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। এরা কে কীভাবে বর্ডার পাড়ি দিচ্ছে, কার পরিবার-পরিজন কোথায় আছে, কেউ জানে না! ছোট আকারের হাসপাতাল, ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ অপ্রতুল। কিন্তু বিপন্ন লোকগুলোর চিকিৎসা না দিলে কোথায় যাবে ওরা? কোথায় চিকিৎসা পাবে?
এরই মধ্যে বড় সংকট বাঁধিয়েছে কয়েকজন নারী, যারা পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধর্ষিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এরা বেশির ভাগই সীমান্ত এলাকার কিংবা আশপাশ অঞ্চলের মানুষ। আরও সংকট হচ্ছে এদের কয়েকজনের শরীরে সন্তান দানা বাঁধতে শুরু করেছে। গাইনোকলজি বিভাগ এখন এই নারীদের নিয়ে কী করবে? বাচ্চাগুলোকে রাখা হবে, না কি গর্ভপাত করানো হবে? হাসপাতাল সুপার রথীন দত্ত গাইনোকলজি বিভাগের ডাক্তারদের নিয়ে বসলেন। একটা সিদ্ধান্ত আসতে হবে। পরিস্থিতি সামলাতে হবে।
বিভাগীয় প্রধান ডা. স্বপ্না দত্ত বললেন, সমস্যা আরও যে বেশির ভাগ মেয়েই ধর্ষণের ঘটনা লুকাতে চায়, সাধারণ ওয়ার্ডে থাকতে চায় না। এরই মধ্যে একটা আলাদা জায়গাও করে দিয়েছি। কিন্তু এত রোগীর স্থান সংকুলান কীভাবে হবে?
সুনন্দা ভট্টাচার্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পরিদর্শক। তারও সংকট কম নয়।
বললেন- স্যার, এরই মধ্যে আমি কিছু কিছু আরলি এবরশন করিয়েছি। সময় বেড়ে গেলে কিছু এবরশন আবার রিস্কি হয়ে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে কী করব স্যার আমরা?
অতএব, সমস্যা বেড়ে চলেছে। সেদিনই জনাকয়েক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে কয়েক ঘণ্টা টানা বৈঠক করেছেন সার্জন দত্ত। বৈঠকটি একটি মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি নির্মম ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি। সহকর্মীদের প্রায় সবাই একবাক্যে বলে দিলেন, ইটস্ ইমপসিবল, স্যার। প্রাণে বাঁচলেও বাঁচতে পারে, কিন্তু মেয়েটাকে কিছুতেই নরমাল লাইফ দেওয়া যাবে না- সিমপ্লি ইমপসিবল।
সহকর্মীদের মতামত শুনে রথীন দত্ত বিমর্ষ হলেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না। কথা না বলে অনেকক্ষণ চুপ থাকলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠবার আগে শুধু বললেন, পেসেন্টের ক্ষতস্থানগুলো সারাতে হবে, নরমাল লাইফ ফিরিয়ে দিতে হবে ওকে। মনে রাখবেন, এটা আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
মধ্য রাতে সার্জনের সাদা অ্যাম্বাসেডর এগিয়ে চলছে। কুঞ্জবনের আরেক প্রান্তে তার বাড়ি। ইচ্ছে করেই বাড়ির পথে না গিয়ে শহর আগরতলার নানা সড়কে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দত্ত বাবু। দেখলেন, পথের পাশে জটলা করে আছে হাজার হাজার মানুষ। এই নিশুতি রাতেও ভিনদেশি ছিন্নমূল মানুষের ভিন্ন ভিন্ন দলগুলো জেগে আছে। এরা সদ্য বর্ডার পাড়ি দিয়েছে। ক্যাম্পে জায়গা খুঁজে নিতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে। সরকারের খাতায় নাম-ঠিকানা উঠবে- তারপর। অতএব, যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে।
উদ্বাস্তু মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ডাক্তার দত্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পূর্ববঙ্গ পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে তা কেউ জানে না। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা যেভাবে নির্বিচার যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করছে তাতে নিরস্ত্র মানুষজন কী করবে? আহতরা কোথায় চিকিৎসা পাবে, এদের কতজন বাঁচবে, যারা বর্ডার পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে তারাই-বা কতদিনে নিজের ঘরবাড়িতে ফিরতে পারবে- সব কিছুই চরম অনিশ্চিত!
যত্রতত্র শুয়ে-বসে থাকা ছিন্নমূল মানুষের দল এড়িয়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে লাগলেন ডাক্তার রথীন দত্ত। এরই মধ্যে বিএসএফ-এর কয়েকটা ট্রাক দ্রুত চলে গেল। ট্রাকের হেড লাইটে বিপন্ন মানুষদের মুখ দেখা গেল। ডাক্তার দত্ত কয়েক জায়গায় গাড়ি থামাতে বাধ্য হলেন। দেখলেন বেশির ভার শিশু মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বয়স্কদের কেউ কেউ অসহায় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। কেউ আবার লুকিয়ে সামান্য কিছু মুখে পুরছে। এ রকম দৃশ্য তাকিয়ে দেখা যায় না। অতএব, রথীন দত্ত গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে দিলেন। এরপর পথ পরিবর্তন করে এগিয়ে চললেন বাড়ির পথে।
গভীর দুশ্চিন্তামগ্ন সার্জন রথীন দত্ত। কী হতে যাচ্ছে পূর্ববঙ্গে? পড়শি দেশের যুদ্ধের ক্ষত এরই মধ্যে ভারতীয় অঞ্চলে আঘাত হানতে শুরু করেছে। কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের পথঘাট লাখো দেশত্যাগী মানুষে ছয়লাব হয়েছে। মেঘালয় ও আসামের বর্ডার এলাকাগুলো ভরে উঠেছে লাখো উদ্বাস্ত নারীপুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশুতে। মহানগরী কলকাতার একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে জটলা করে হেঁটে চলেছে পূর্ব বাংলার শরণার্থী। এরা কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ ছাত্র, কেউ শহর-গঞ্জ-গ্রামের সাধারণ নারীপুরুষ; কেউ আবার চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্য, সীমান্ত প্রহরী কিংবা গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য। এদিকে বাংলাদেশ ও ভারতে সীমান্তজুড়ে নবীন মুক্তিবাহিনীর বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ গড়ে ওঠার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করেছে নবীন মুক্তিবাহিনীর দল। কিন্তু এরপর কী? এভাবেই কি শেষ রক্ষা হবে?
জিবি হাসপাতালে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর, আনন্দবাজার, স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার, বসুমতিসহ কয়েকটি কাগজ আসে সকালের ফ্লাইটে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১০টা-১১টা বাজে। কাগজগুলো আসতেই কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। সবাই জানতে চায়- কী ঘটছে বর্ডারের ওপারে। পত্রিকা পড়ার বিড়ম্বনা ঠেকাতে সার্জন দত্ত ভোর বেলাতেই আগরতলার স্থানীয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটি জোগাড় করে নেন। সব পত্রিকার খবর প্রায় এক : পাকিস্তানের সৈন্যরা পোড়ামাটি নীতি নিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। শেখ মুজিব ও তার সমর্থকদের শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছে সৈন্যরা। তরুণ বা যুবকরা- যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে নামতে পারে- বয়স বিবেচনা করে যাকেই পাচ্ছে তাকেই কতল করছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ওরা শহর, গ্রামের ঘরবাড়ি, ছাত্রীনিবাস, লঞ্চ ঘাট, বাসস্ট্যান্ড থেকে তুলে বাঙালি মেয়েদের জোর করে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে! এদের মধ্যে যাদের ভাগ্য প্রসন্ন তারা বর্বরতার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কোনোভাবে পালিয়ে বর্ডার পাড়ি দিচ্ছে। আগরতলার জিবি হাসপাতালের বেডগুলো এরই মধ্যে ভরে উঠেছে আরেক দেশের নারীপুরুষে।
চলবে...