সম্প্রতি এবারের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানতের পরিমাণ ১০ গুণ বৃদ্ধি করাসহ বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ওই প্রস্তাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য চলমান এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর থাকার বিধান তুলে নেওয়া, রঙিন পোস্টার ফিরিয়ে আনাসহ বেশ কিছু প্রস্তাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের কেউ কেউ জামানত বাড়ানোর প্রস্তাবকে ইতিবাচক মনে করলেও ভিন্ন মতও রয়েছে। প্রার্থীদের জামানত একসঙ্গে দশগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক মনে করছেন তারা। বলছেন, ওই বিধি কার্যকর হলে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন সর্বজনীনতা হারাবে। কারণ তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্ব আরও বেশি ব্যবসায়ী ও সম্পদশালীদের হাতে চলে যাবে।
এ ছাড়া প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রঙিন পোস্টার চালু না করে ইসির উদ্যোগে যৌথ পোস্টার করা এবং ভোটারদের সঙ্গে প্রার্থীদের মুখোমুখি সংলাপ আয়োজনের পরামর্শ বিশ্লেষকদের।
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানত বাড়ানোকে ইতিবাচক মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, আজকাল নির্বাচনে দাঁড়ানো একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। দেখেন আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি, আমার পোস্টার লাগল! এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করি। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন এক লাখ টাকা দিয়ে একজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হবেন কেন? এটা নাহলে ভোটের সময় হাজার হাজার অখ্যাত লোক এসে প্রার্থী হয়ে যান। এমন অনেক প্রার্থী আছেন তাদের জন্য এক লাখ টাকা কোনো বিষয় না। আর যারা নির্বাচনে জয়ী হবেন তারা তো এই টাকা আবার ফেরত পাবেন। কিন্তু যারা হেরে গিয়ে জামানত হারাবেন- তাদের জন্য সমস্যা। এটাও তো ভাবা দরকার যে, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা করতে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়।
তিনি বলেন, প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় কমানোর জন্যই তো সাদাকালো পোস্টার করার নিয়ম করা হয়েছিল। তারা কোন ভাবনা থেকে রঙিন পোস্টার করতে চাচ্ছেন বুঝলাম না। প্রচারে এমনতেই নির্বাচনি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কারণ অনেকেই সেই নিয়ম মানতে চান না, নানা কৌশলে কয়েকগুণ বেশি টাকা খরচ করেন। তার পরও শৃঙ্খলা রক্ষায় সাদাকালো পোস্টারের বাধ্যবাধকতা অনেকটা ভূমিকা রেখেছে। নির্বাচনে রঙিন পোস্টারে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীর জামানত এত বেশি বাড়ানো সঠিক হবে না বলে মনে করছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘জামানত সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কিছু বাড়তেই পারে, কিন্তু এত বেশি কেন? কারণ ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে এই নির্বাচন সর্বজনীনতা হারাবে। কারণ তৃণমূল পর্যায়ের নেতৃত্ব আরও বেশি সম্পদশালীদের হাতে চলে যাবে। নিম্নবিত্ত সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনের ব্যয় সংকুলান করা আরও কঠিন হবে।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের যে এক শতাংশ বা ২৫০ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিধান রয়েছে- সেটা তুলে দেওয়া হলে জনসম্পৃক্ততাহীন, অগ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তির স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বাধা থাকবে না। বিপুলসংখ্যক ভুঁইফোড় লোক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে হঠাৎ হয়ে ভোটে অংশ নেবেন। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়তে পারে। ভোটে দাঁড়িয়ে জামানত হারানো প্রার্থীর সংখ্যা আরো বাড়বে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে এই বিধান যখন ছিল না তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য প্রায় শখানেক লোক ওইসব নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের কিছু অসদ্ব্যবহার থাকলেও সেটা জনসম্পৃক্ততা বোঝার একমাত্র কৌশল ছিল। স্থানীয়দের সমর্থন পেতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীও ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করতেন- এরপর সেটা রক্ষা হবে কী করে? বিধানটি না থাকলে স্বতন্ত্র প্রার্থী কারা হতে পারবেন, তাদের বাছাইয়ের মানদণ্ড কী হবে সেটা ভেবে দেখা দরকার মনে করছি।
সংসদ নির্বাচনসহ এ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচনি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে এমনিতেই কোনো অবকাঠামো, জনবল নেই। তাই সব নির্বাচনেই প্রার্থীরা ইসির নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ভোটের মাঠে ব্যয় করেন। উন্নত দেশগুলোতে নির্বাচনি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাধীন সেল গঠন করা হয় শুধু সেগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য, যেটা আমাদের নেই। সাদাকালো পোস্টার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল মূলত নির্বাচনি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে। এখন রঙিন পোস্টারে প্রচার নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচন মানেই টাকার খেলা- এমন সংস্কৃতি চলমান। জামানত বাড়ানোর ফলে তৃণমূলের রাজনীতি আরও ধনাঢ্যদের দখলে চলে যাবে। অর্থ দিয়ে কেনা যায়- এমন গণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছি কি না, ভেবে দেখা দরকার। কারণ এর ফলে প্রার্থীর যোগ্যতা ও স্থানীয়দের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কতখানি তা টাকার সক্ষমতার কাছে অনেকাংশে হেরে যাবে। নিম্নবিত্ত মানুষের নির্বাচনে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে। নির্বাচনকে যারা খেলাতে পরিণত করতে চায়- সেই ভুঁইফোঁড় ব্যক্তিদের প্রার্থী হতে নিরুৎসাহিত করতে ইসি সম্ভবত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। এতে নিম্নবিত্ত যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে কি না, ভাবা দরকার।
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য এক শতাংশ বা ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিধান তুলে নেওয়াকে ইতিবাচক মনে করছেন এই বিশ্লেষক। তার মতে, ভোটারের স্বাক্ষর নিয়ে অনেক ছলচাতুরি হয়েছে, অনেক যোগ্য প্রার্থীকে কৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে। রঙিন পোস্টার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমনিতেই প্রার্থীদের ব্যয় আকাশচুম্বী অবস্থায়। তার ওপর রঙিন পোস্টারবিধি ফের চালু করে ব্যয় বাড়ানোকে যৌক্তিক মনে করি না। আর ভোটের আগে সভা-সমাবেশকে বেশি উৎসাহিত না করে ভোটারদের মুখোমুখি প্রার্থীদের দাঁড় করতে ইসিকে সংলাপ এবং সব প্রার্থীর তথ্য সংবলিত যৌথ পোস্টার করার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের।
এ বিষয়ে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম খবরের কাগজকে বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনবিধি সংশোধনী কমিটির প্রস্তাবিত কয়েকটি সিদ্ধান্তে কমিশন সভায় সম্মতির পর তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় সেগুলো বিশ্লেষণ করছে। এ বিষয়ে আমরা এ পর্যায়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায়। তারা চাইলেও প্রস্তাবে সংযোজন-বিয়োজন করতে পারেন।
জামানত বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জামানত বাড়ানো হলেও সেটা কিন্তু ফেরতযোগ্য, এখানে ধনী-গরিব মুখ্য নয়, প্রার্থী জনপ্রিয় হলে স্থানীয়রা চাঁদা তুলেও প্রার্থীর জামানতের টাকার ব্যবস্থা করেন, আমরা এমনো দেখেছি। আর তিনি কাস্টিং ভোটের ১৫ শতাংশ পেলে সেই টাকাও ফেরত পাবেন। যিনি ভোটে আসবেন তার অন্তত ১৫-২৯ ভাগ ভোট পাবেন এমন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভোটে আসা উচিত। ভোট পেলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে না। গণতান্ত্রিক ধারায় গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের স্বতন্ত্রভাবে ভোটে অংশ নেওয়ার বাধা দূর করতে- এক শতাংশ ভোটারের সই থাকার বিধান তুলে নেওয়ার দাবি ছিল অনেকের। সেই লক্ষ্যেই বিধিটি তুলে নিতে ইসি সমর্থন দিয়েছেন।