সংরক্ষিত নারী আসনের বিদ্যমান ব্যবস্থা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের পৌঁছানোর জন্য সঙ্গতিপূর্ণ নয়- এমন মন্তব্য করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। এই ব্যবস্থা কার্যকর ও অর্থবহ করতে সংরক্ষিত নারী আসনেও যোগ্যতার ভিত্তিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে বাধ্যতামূলক ৫০ ভাগ নারীকে মনোনয়ন প্রদান নিশ্চিত করার পরামর্শ এই সংগঠনের। একই সঙ্গে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত এমপিদের হলফনামায় দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ উপস্থাপনে বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) সুজন এর ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। নির্বাচিত এমপিদের হলফনামায় বিশ্লেষণ তুলে ধরে তিনি জানান, সাধারণ আসনের মতো এবারের সংসদে সংরক্ষিত ৫০ আসনেও নির্বাচিতদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব আসনে নির্বাচিত এমপিদের মধ্যে ১৩ জনের (২৬ শতাংশ) পেশা ব্যবসা। এছাড়া ৭ জন (১৪ শতাংশ) চাকরিজীবী, ৫ জন (১০ শতাংশ) শিক্ষক, ৫ জন (১০ শতাংশ) গৃহিণী, ২ জন (৪ শতাংশ) আইনজীবী ও ২ জন (৪ শতাংশ) কৃষিজীবী। ৮ জন (১৬ শতাংশ) তাদের পেশা ‘রাজনীতি’ উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ৮ জন (১৬ শতাংশ) বিভিন্ন পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আইন পেশায় সম্পৃক্ত দুজনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ীর হার শতকরা ২২.৯২ শতাংশ (১৩ জন) এবং জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিতদের ১০০ শতাংশই ব্যবসায়ী। অর্থাৎ, দলটির দুজনই পেশায় ব্যবসায়ী।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন শেষে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের তথ্য বিশ্লেষণ করে সুজন জানিয়েছিল, ২৯৯ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২০০ জনেরই পেশা ব্যবসা। শতকরা হিসাবে সংসদ সদস্যদের ৬৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ ব্যবসায়ী। একাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮৫ জন বা মোট সংসদ সদস্যের ৬১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৩৭.৩৩ শতাংশ কোটি টাকার বেশি আয় করলেও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের মধ্যে এই হার ৪ শতাংশ। এখানে সাধারণ আসন এবং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের মধ্যে আয়বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।
প্রার্থীদের আয়-ব্যয়ের বিশ্লেষণে জানানো হয়, সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত ৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে বার্ষিক ৫ লাখ টাকা বা তার চেয়ে কম আয় করেন মাত্র ১০ জন (২০ শতাংশ)। আয়ের ঘর পূরণ করেননি ২ জন। বছরে ৫ লাখ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন ২০ জন (৪০ শতাংশ), ২৫ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা আয় করেন ১০ জন (২০ শতাংশ), ৫০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা আয় করেন ৫ জন (১০ শতাংশ) এবং ১ কোটি টাকার বেশি আয় করেন ২ জন (৪ শতাংশ)।
সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সংরক্ষিত নারী আসন ইতিবাচক। কিন্তু এখন বাস্তবে কতটুকু নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সত্যিকার অর্থেই লিঙ্গসমতা অর্জন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে ন্যায্যতার ভিত্তিতেই আসন সংরক্ষণ করতে হবে এবং তা কোনোভাবেই ৫০%-এর কম নয়। এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতা প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, আমাদের সমাজে অনেক পিছিয়ে পড়া নারী রয়েছে। তারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান না। এ ধরনের নারীদের যেমন, একজন দলিত, একজন আদিবাসী, একজন বেদে নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হলে সংসদে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভারতে নারীদের যে ঘুর্ণায়মান পদ্ধতি রয়েছে তা একটি আদর্শ পদ্ধতি। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন ঘটে। আশা করি, বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি প্রবর্তনে রাজনীতিবিদরা উদ্যোগী হবেন।
নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে কার্যকর ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে সুজনের পক্ষ থেকে বেশকিছু শর্ত তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো- ১. পদ্ধতিটিকে দলীয় নেতৃবৃন্দের অনুগ্রহনির্ভর ‘টোকেনিজমে’ পরিণত না করে সংসদে পর্যাপ্ত সংখ্যক নারী প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে; ২. সংরক্ষিত আসনেও সাধারণ আসনের মতো প্রত্যক্ষ ভোটের নির্বাচনের বিধান করতে হবে; ৩. সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের দায়বদ্ধতা থাকবে জনগণের কাছে; ৪. এই আসন সংরক্ষণ পদ্ধতি এমন করতে হবে, যাতে কোনো দ্বৈততা না থাকে; ৫. সাধারণ আসনের মতো সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব হবে সমান; ৬. সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের ভিত্তি হবে নারী রাজনীতিবিদদের যোগ্যতা; ৭. সংরক্ষিত আসনের পদটিকে দলীয় নেতৃবৃন্দ, বিশেষত দলীয় প্রধানের পৃষ্ঠপোষকতা বা অনুগ্রহ বন্টনের হাতিয়ারে পরিণত করা যাবে না।
বর্তমান আসন সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়নে সুজনের পক্ষ থেকে তিন ধরনের প্রস্তাবকে বিবেচনায় নিতে নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। প্রথমত- বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন করা এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে বাধ্যতামূলক ৫০ ভাগ নারীকে প্রতিটি মনোনয়ন প্রদান করা। দ্বিতীয়ত-বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিই বহাল থাকলে প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ৫ ভাগ নারীকে মনোনয়ন প্রদান করা করা। এক্ষেত্রেও আসন সংরক্ষণের প্রয়োজন হবে না। তৃতীয়ত- নারীদের জন্য ঘুর্ণায়মান পদ্ধতিতে আসন সংরক্ষণ করা। এই পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের মোট আসনকে ৩ ভাগে ভাগ করতে হবে। একটি নির্বাচনে এই ৩ ভাগের এক ভাগকে শুধুমাত্র নারীদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে; যেখানে শুধু নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অবশিষ্ট দুইভাগ নারী-পুরুষ সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
সুজন মনে করে, আসন সংরক্ষণের এই পদ্ধতিতে টানা তিন মেয়াদের নির্বাচনের পর আসন সংরক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োজন নাও হতে পারে। কারণ কোনো সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়ে একজন নারী যথেষ্ট যোগ্যতার প্রমাণ রাখাসহ জনকল্যাণমুখী ভূমিকা রাখতে পারলে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এর ফলে পরবর্তীতে সাধারণ আসন থেকেও তিনি ভোটের লড়াইয়ে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন।
এলিস/এমএ/