![এমপি আজীম হত্যাকাণ্ড : খুন ঢাকতেই পৈশাচিকতা](uploads/2024/05/24/MP_Azim-1716522002.jpg)
হত্যাকাণ্ড চাপা দিতেই পৈশাচিক পন্থা অবলম্বন করেছে খুনিরা। এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের দেহ নৃশংসভাবে টুকরো টুকরো করে কেটে হাড় ও মাংস আলাদা করে হলুদ মাখিয়ে রাখা হয় বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তবে এখনো তার লাশ পুরোপুরি পাওয়া যায়নি বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বসে ভারত ও বাংলাদেশের কিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে আখতারুজ্জামান শাহীন। ডিবি পুলিশ বলছে, এই হত্যার জন্য ১০ কোটি টাকার বাজেট করা হয়। এর মধ্যে ভাড়াটে খুনিদের অগ্রিম ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা হত্যার পর দেওয়ার কথা।
আনারকে খুন করার জন্য শাহীন তিন মাস আগে থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনা করেন এবং তার ওপর নজর রাখেন। আজীমকে হত্যার কয়েকটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। পরে তারা ভাড়াটে খুনিদের কাজে লাগিয়ে ঘটনাটি বিদেশের মাটিতে ঘটান। বিদেশের মাটিতে অপরাধ করলে বাংলাদেশ পুলিশের নজরে আসবে না বলেই অপরাধীরা কলকাতাকে বেছে নেয়। পরে পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী অপরাধীরা হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
সূত্র জানায়, অপরাধীদের উদ্দেশ্য ছিল আনারের লাশ গুম করা, যাতে তাকে কোনো দিন খুঁজে না পায়। আর সেটাই হয়েছে। তার লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, এর আগে রাজধানীর গুলশান ও বসুন্ধরার দুই বাসায় এমপি আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেও পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তারা পরিকল্পনা করেছিল ঢাকায় হত্যা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের নজরদারি ও ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের পর সব হত্যার ক্লু পুলিশ বের করতে পারে বলেই হত্যাকারীরা কলকাতায় এমপিকে হত্যা করেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সংসদ সদস্য আনারকে হত্যার পর হাড় ও মাংস আলাদা করে হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ঢোকান হত্যাকারীরা। যাতে কেউ সন্দেহ করলে বাজার থেকে কেনা মাংস বলে রক্ষা যাওয়া যায়। তিনি বলেন, দেশে হত্যাকাণ্ডের সাহস না পেয়ে হত্যাকারীরা দেশের বাইরে হত্যার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে তারা কলকাতায় বাসা ভাড়া নেন। এরপর পরিবার পরিচয়ে তারা কলকাতার ভাড়া বাসায় ওঠেন। পরে সেখানে জিহাদ ও সিয়াম নামে দুজনকে তারা ভাড়া করেন। এরপর হত্যাকাণ্ডের সব পরিকল্পনা সাজিয়ে মূল পরিকল্পনাকারী ঢাকায় ফিরে আসেন।
এমপি আনার কলকাতায় গিয়ে বন্ধু গোপালের বাসায় ওঠেন। পরদিন কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হন আনার। পরে ফয়সাল নামে একজন সাদা গাড়িতে তাকে রিসিভ করেন। কিছু দূর যাওয়ার পর আরেকজন সেই গাড়িতে ওঠেন। পরে তারা ওই ভাড়া করা বাসায় যান। এর পরই মুস্তাফিজ নামে এক ব্যক্তি ওই বাসায় ঢোকেন। সেই বাসায় জিহাদ অথবা জাহিদ ও সিয়াম আগে থেকেই ছিলেন। এরপর আধা ঘণ্টার মধ্যেই আনারকে হত্যা করা হয়। তার লাশ খণ্ডিত করা হয়। পরে ছাই রঙের একটি স্যুটকেসে করে লাশের একটি অংশ ও পরদিন হাড় ও মাংসের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে পলিথিনে ভরে সরিয়ে ফেলা হয়।
হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল আনারের লাশ এমনভাবে গুম করা, যাতে তাকে কোনো দিন খুঁজে না পাওয়া যায়। হত্যাকাণ্ডের পর হত্যাকারীরা একে একে বাংলাদেশে চলে এলে মূল পরিকল্পনাকারী দেশ থেকে চলে যান। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। হত্যাকারীরা অনেক দিন ধরে এমপি আনারের ভারতে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন। হত্যার পর হত্যাকারীরা আনারের ফোন থেকে বিভিন্ন জনকে মেসেজ পাঠান। যাতে কেউ তার নিখোঁজের বিষয়টি সন্দেহ না করে। সর্বশেষ ১৮ মে একটি মেসেজ পাঠানো হয়।
এ ছাড়া ঘন ঘন একাধিক স্থানে আনারের ফোনটি পাঠানো হয়। সর্বশেষ বেনাপোল থেকে আনারের ফোন দিয়ে তার ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে মেসেজ পাঠানো হয়। এর মাধ্যমে তদন্তকারী সংস্থাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করারও চেষ্টা করা হয়।
ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কলকাতা পুলিশ ওই ফ্ল্যাট ও আশপাশের ভবনের সব সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আমান ও তার সহযোগীদের ট্রলি ব্যাগ আনা-নেওয়া, এমপি আনারের বাইরে রাখা জুতা ভেতরে নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। এ ছাড়া শিলাস্তি রহমান ওরফে শিলাস্তি নামে শাহীনের বান্ধবীর বাইরে থেকে পলিথিন ও ব্লিচিং পাউডার নিয়ে আসার দৃশ্যও সিসিটিভি ফুটেজে আছে। জিজ্ঞাসাবাদে আটক হওয়া আমান জানিয়েছেন, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার জন্য ১০ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে তাদের ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল হত্যাকাণ্ডের পর।
কর্মকর্তারা জানান, এমপি আনোয়ারুল আজীমকে নির্মমভাবে হত্যার নেপথ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আক্তারুজ্জামান শাহীন নিজেও একজন স্বর্ণ চোরাচালানকারী। এমপি আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধেও স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। কলকাতায় শাহীন ও আজীমের যৌথ ব্যবসা রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, স্বর্ণ চোরাচালানের বিপুল অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, এমপি হত্যাকাণ্ডে কলকাতাতেও একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। কলকাতার স্থানীয় পুলিশ ওই ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এমপি আজীমের পরিচয় নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে কলকাতার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা লাশের টুকরোগুলোর সন্ধানে মাঠে নেমেছেন। এ জন্য পলাতক সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। লাশের টুকরোগুলো কোথায় ফেলা হয়েছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বলেন, ‘আনার হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। বিষয়টি বলার মতো তেমন কিছু নেই। সময় হলে সব কিছু সামনে আসবে।’
ডিবি সূত্র জানায়, আখতারুজ্জামান শাহীন কলকাতায় গিয়েছিলেন আমেরিকার পাসপোর্ট ব্যবহার করে। সেখানেই হত্যা এবং লেনদেন করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান আনারের ছোটবেলার বন্ধু শাহীন। ডিবি সূত্র জানায়, ১০ কোটি টাকার চুক্তিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শাহীন ভাড়াটে খুনিদের এমপি আজীমকে হত্যার দায়িত্ব দেন।
পরিকল্পিতভাবে খুন করে কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশ হয়ে ইতোমধ্যে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের একাংশ।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, আখতারুজ্জামানের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে। এলাকায় তিনি শাহীন মিয়া নামে পরিচিত। তার ভাই কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র সহিদুজ্জামান।
শাহীনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার মতো আমিও শুনেছি এই হত্যার সঙ্গে অনেকেই জড়িত। তবে হত্যার ঘটনায় ১০ কোটি টাকা খরচ করার কথা ছিল, ৫ কোটি লেনদেন হয়, এমনটিই জানিয়েছেন আটক ব্যক্তিরা। তবে সেসব বিষয়ে আমাদের কাছে শক্ত তেমন কোনো ডকুমেন্ট নেই। তা ছাড়া এই ঘটনায় বেশ কয়েকজন আটক আছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলেন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ আমান, মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। সর্বশেষ শিলাস্তি রহমানকে আটক করা হয়। এ ছাড়া ৩০ থেকে ৪০ জনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
ভারতীয় পুলিশের দুই সদস্য ঢাকায়
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ভারতীয় পুলিশের দুই সদস্য ঢাকায় এসেছেন। তারা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সন্ধ্যায় তাদের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্ত তদারক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার আব্দুল আহাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আলোচিত এই ঘটনাটির তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল শিগগির কলকাতায় যাবে। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ ভারতীয় পুলিশের কাছে আটক হওয়া আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
কলকাতায় আটক ২
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কলকাতায় দুজনকে আটক করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোনো ট্রলি ব্যাগ কিংবা এমপির দেহাবশেষের খোঁজ পাওয়া যায়নি কলকাতায়। স্পেশাল টাস্কফোর্সের একটি বিশেষ দল ঢাকায় অবস্থান করছে। সেই দলের সঙ্গে এনআইএর একজন সিনিয়র কর্মকর্তাও রয়েছেন। জরুরি ভিত্তিতে ওই দলের প্রয়োজনীয় প্রোটোকল সম্পূর্ণ করার কাজও হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির এক সূত্র জানিয়েছে, এমপিকে হত্যা করে দেহ খণ্ড খণ্ড করে বেশ কয়েকটি ব্যাগে ভরে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো উদ্ধার করার জন্যও তাদের জেরা করা প্রয়োজন। সিসিটিভি সূত্রে পাওয়া এক অ্যাপ ক্যাবচালককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন সিআইডির অফিসাররা। পাশাপাশি রাজারহাট-নিউ টাউন অঞ্চল থেকে যে ট্যাক্সিচালককে আটক করা হয় তাকেও রাতভর জেরা করেছে পুলিশ। গতকালই বনগাঁ থেকে একজনকে আটক করেছে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইডি)। জুবায়ের নামে সন্দেহভাজন ওই যুবক সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, খুনে অভিযুক্ত একজন এই যুবকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই তাকে আটক করে জেরা শুরু হয়েছে। এমপির দেহ কোথায় লোপাট করা হয়েছে তদন্তকারীরা তা খতিয়ে দেখছেন।
কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, খুনের পর দেহ সারা রাত ফ্রিজে রাখা হয়েছিল। পরে দেহটি টুকরো টুকরো করে ট্রলিতে ভরে নিউ টাউন থেকে গাড়ি বদল করে খুনিরা যান রাজারহাটে অ্যাক্সিস মলের কাছে। নজরুল তীর্থের কাছে কোথাও ট্রলিভর্তি দেহটি ফেলে দেওয়া হয়। তারপর খুনিরা আরেকটি গাড়ি নিয়ে বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যান।
৩০ এপ্রিল ঘাতকরা কলকাতায় আসেন। এক দালালের মাধ্যমে রেন্টালে ভাড়া করা ছিল গাড়ি। ৩০ এপ্রিল থেকে ভাড়ার ওই গাড়ি ব্যবহার করা শুরু করেন বাংলাদেশি তিন আততায়ী। গাড়ির চালককে জেরায় মিলেছে এই তথ্য। খুনের কয়েক দিন আগে ওই গাড়িতে করে শহরের বিভিন্ন শপিংমল, রিটেল স্টোরসহ একাধিক জায়গায় ঘোরেন তারা।
১৩ মে ওই গাড়িতে করে সংসদ সদস্যকে বরানগর থেকে নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ১৪ মে আলাদা আলাদা সময় ওই ফ্ল্যাটে থেকে বেরিয়ে গাড়িতে করে যান তিনজন। তার পরই সম্ভবত বাংলাদেশে ফেরেন ওই ত্রয়ী।
ওই ফ্ল্যাটের বেডরুমের খাটের কোনায় রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। রক্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে দরজার কাছে এবং সেখানে জুতার ছাপও পাওয়া গেছে। রান্নাঘরে লাশ কাটা হয় বলে পুলিশের অনুমান। যদিও রান্নাঘরে রক্তের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সেখানে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। হ্যান্ড গ্লাভসের প্যাকেট পাওয়া গেছে খাটের নিচ থেকে, যদিও তাতে কোনো গ্লাভস ছিল না বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশের ধারণা, কোনোভাবে যাতে ধস্তাধস্তি করতে না পারে সেই কারণে খাটের কোনায় তাকে ফেলে শ্বাসরোধ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারা হয়। সেই কারণেই সেখানে রক্তের দাগ রয়েছে। এরপর সেখান থেকে রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময় ওই ঘরে এমপিসহ মোট সাতজন ছিলেন।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি জানিয়েছে, আনোয়ারুল আজীমের হত্যার মূল চক্রান্তকারী আমেরিকাপ্রবাসী ব্যবসায়ী আখতারুজ্জামান শাহীন গত ৩০ এপ্রিলের পর আর ভারতে ঢোকেননি। বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে সেখানকার গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এমপিকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ করে ১০ মে তিনি কলকাতা ছাড়েন। বিধাননগর কমিশনারেট এবং সিট -এর অফিসাররা জানিয়েছেন, এই তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতা মিলছে না, কারণ গত ৩০ এপ্রিল কলকাতায় আসা এবং তার কয়েক দিনের মধ্যে কলকাতা ছাড়ার রেকর্ড রয়েছে। তারপর আর কলকাতা তথা ভারতে ঢোকার কোনো রেকর্ড নেই। এ ব্যাপারে দুই দেশের তদন্তকারীদের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান চলছে।
কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, শেষবার তার ফোনের লোকেশন ছিল উত্তর প্রদেশ। খুনের পর সবাইকে বিভ্রান্ত করতেই তার মোবাইলটি উত্তর প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয় বলে সন্দেহ পুলিশের।
পুলিশ তদন্ত করে জেনেছে, উত্তর প্রদেশের মুজফফরপুরে মোবাইলের শেষ টাওয়ার ছিল। মাঝে মাঝে মোবাইল খোলা হচ্ছিল। তবে বেশির ভাগ সময়ের জন্যই বন্ধ করে রাখা হয়েছিল ফোনটি।
১৫ মের পরের দিন অর্থাৎ ১৬ মে সকালে আনারের নম্বর থেকে একটি ফোন আসে তার আপ্তসহায়কের নম্বরে। আবার অন্য ফোনটি আসে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মোবাইলে। কিন্তু এমন সময় ফোন করা হয়, দুজনের কেউই তা ধরতে পারেননি।
কিন্তু খুনের বিষয়টি সামনে আসার পর পুলিশের ধারণা, খুনের পর খুনিরা মোবাইলটি লুট করে নেয়। এরপর প্রমাণ লোপাট করতেই এক আততায়ী তার মোবাইলটি নিয়ে বিহার হয়ে উত্তর প্রদেশে চলে যান। সেখান থেকে তিনি দিল্লি পালান, এমন সম্ভাবনাও পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছে না। পুলিশের মতে, যে ব্যক্তি পুলিশ ও এমপির পরিবারের সদস্যদের বিভ্রান্ত করতে মোবাইল নিয়ে পালিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশিও হতে পারেন, আবার বাংলাদেশি আততায়ীদের এই রাজ্যের লিংকম্যানও হতে পারেন। এমন সম্ভাবনাও রয়েছে।
এমপি খুনের আগের সময়টায় আমেরিকাপ্রবাসী আখতারুজ্জামান শাহীনের সর্বশেষ গতিবিধি নিয়ে আলাদা করে তদন্ত চলছে। এখনো পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা হলো নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনের ৫৬বি ইউ ফ্ল্যাটটি তিনি ভাড়া নেন গত ২৫ এপ্রিল। ফলে মনে করা হচ্ছে সংসদ সদস্যকে খুন করার জন্যই তড়িঘড়ি ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। মাসিক ১ লাখ টাকায় ফ্ল্যাটটি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন স্থানীয় এক দালাল।
পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাটের মালিক অতিরিক্ত এক্সাইজ কমিশনার সন্দীপ রায়। একটি ফ্ল্যাটে (৫৬এ ইউ) সপরিবার সন্দীপবাবু থাকেন।
৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ আদালতের
খুনের উদ্দেশ্যে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনারকে অপহরণের মামলায় ৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হক এই আদেশ দেন। গতকাল বৃহস্পতিবার এই মামলার এজাহার আদালতে উপস্থাপন করা হলে তা গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করে এই নির্দেশ দেন আদালত। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা (আদালতে দায়িত্বরত) পুলিশের উপপরিদর্শক জালাল উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগ এনে এই থানায় মামলাটি করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর বাসায় আমরা সপরিবারে বসবাস করি। ৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা আনোয়ারুল আজীম আনার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ যাওয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ১১ মে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তা কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও বন্ধ পাই।
১৩ মে বাবার ভারতীয় নম্বর থেকে উজির মামার হোয়াটসঅ্যাপে একটি খুদে বার্তা আসে। এতে লেখা ছিল, ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি রয়েছেন। আমি অমিত সাহের কাজে সেখানে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। আমি পরে ফোন দেব।’ এ ছাড়া আরও কয়েকটি বার্তা আসে। খুদে বার্তাগুলো আমার বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারেন।
মামলায় তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজ করতে থাকি। কোনো সন্ধান না পেয়ে তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস বাদী হয়ে ভারতীয় বারানগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। এর পরও আমরা খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখি। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে বাবাকে অপহরণ করেছেন।