![জরুরি খাদ্যসামগ্রী এখন বিলাসী পণ্য : সিপিডি](uploads/2024/06/02/baget-expand--1717400902.jpg)
বিশ্বের ১৭টি উচ্চ, মধ্যম আয় ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের মাথাপিছু খাদ্যে ব্যয় সর্বোচ্চ। অথচ বার্ষিক মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণে এই ১৭ দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। দেশে নিত্যপণ্যের বিদ্যমান মূল্য পরিস্থিতি বিশ্বের ১৭টি দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ তথ্য জানিয়েছে।
সিপিডি বলেছে, দেশে এখন জরুরি খাদ্যসামগ্রী মূল্যের দিক থেকে বিচার-বিবেচনায় বিলাসী পণ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্প আয়ের দেশে এ ধরনের মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক। এর মূল কারণ হলো বাজার তদারকিতে আইনের প্রয়োগ যথাযথ হচ্ছে না কিংবা আইনের কাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ জন্য যে সংস্কার দরকার, তাও হচ্ছে না। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
রবিবার (২ জুন) রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ সিপিডি কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ বা আইআরবিডি (ইন্টারিম রিভিউ অন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট) শীর্ষক এক প্রতিবেদনে অর্থনীতির একটি হালনাগাদ চিত্র ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, কল্পনা করা যায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার চেয়ে বাংলাদেশে খাদ্যে ব্যয় বেশি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে শ্রীলঙ্কাকে কদিন আগেও আঙুল তুলে কথা বলা হয়েছে, সে দেশের চেয়েও এখন বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেশি। আমরা এখন ৯-১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কাঠামোতে অবস্থান করছি। ফলে নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও স্বল্প মধ্যবিত্তের আয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাদের আয়-ব্যয়ে চাপ বাড়ছে ও জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের খাদ্যতালিকায় থাকা মোট ৩৪ ধরনের পণ্যের মূল্য ১৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। খোদ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর দেওয়া মূল্যতালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে কোভিডের আগে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি কেজিপ্রতি রসুনের মূল্য ছিল ৫০ টাকা। ২০২৪ সালের মে মাসে সেই মূল্য ৩১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২০৫ টাকা। প্রতি কেজি আদার দাম ১১০ টাকা থেকে ২০৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৩৫ টাকা।
মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫২ টাকা। অথচ বেশি আয়ের মানুষের ভোগের তালিকায় থাকা মিনিকেট ও পাইজাম চালের দাম তুলনামূলকভাবে কম যথাক্রমে ১৫ ও ১৭ শতাংশ বেড়েছে। ময়দার দাম কেজিতে ৬০ শতাংশ বেড়ে আগের মূল্য ৩৬ টাকা থেকে বর্তমানে হয়েছে ৫৭ টাকা ৫০ পয়সা। আটার দাম কেজিতে ৫৪ শতাংশ বেড়ে ৩৪ টাকা থেকে ৫২ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে।
সর্বাধিক ব্যবহৃত খোলা ভোজ্যতেলের (পাম অয়েল) লিটারপ্রতি দাম ১০৬ শতাংশ বেড়ে ৬৩ টাকা থেকে ১৩০ টাকা হয়েছে। খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে যথাক্রমে ৮৫ ও ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় দানা ও ছোট দানা দুই ধরনের মসুর ডালের দাম যথাক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে ৯৫ ও ৮৮ শতাংশ। পেঁয়াজের দাম ১৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৭২ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। যদিও মাঝপথে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়েছিল। শুকনা মরিচ ও কাঁচা মরিচ দুটিরই দাম বেড়েছে দ্বিগুণ থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত। শুকনা মরিচ আগে এক কেজি পাওয়া যেত ২০০ টাকায়, যা বর্তমানে ৪১০ টাকার মতো। অন্যদিকে ৩০-৪০ টাকার কাঁচা মরিচ বর্তমানে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। হলুদের দাম প্রতি কেজিতে ৭০ শতাংশ বেড়ে ২০০ থেকে ৩৪০ টাকা হয়েছে।
গরুর মাংসের দাম কেজিতে ৪৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৬৫ টাকা। দর বৃদ্ধির হার ৫৮ শতাংশ বা অর্ধেকেরও বেশি। ব্রয়লার মুরগির দাম ৫৯ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ১৩৫ টাকা থেকে ২১৫ টাকা হয়েছে। ইলিশ ও রুই মাছের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩৫ ও ১০ শতাংশ। সহজলভ্য পুষ্টির অন্যতম উৎস ডিমের দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। গুঁড়া দুধের দাম ৪৩ থেকে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। চিনির দাম বেড়েছে ১৫২ শতাংশ। লবণের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশে মাথাপিছু খাদ্যে ব্যয় ৯২৪ ডলার (বছরে)। প্রতি ডলার ১১৭ টাকা দরে এর বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ৮ হাজার টাকা। দেশে বর্তমানে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ৭ হাজার ৮০৫ ডলার বা ৯ লাখ ১৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু খাদ্যে ব্যয় ১২ শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতে মাথাপিছু খাদ্যে ব্যয় মাথাপিছু জিডিপির ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় এ ব্যয় জিডিপির ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। উচ্চ আয়ের দেশ কলম্বিয়া ও ব্রাজিলে মাথাপিছু খাদ্যব্যয় যথাক্রমে জিডিপির ৪ দশমিক ৬৬ ও ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আরও যেসব দেশে খাদ্যব্যয় বাংলাদেশের তুলনায় কম, সেগুলো হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, ইরাক, মরক্কো, জর্ডান, লাওস, তিউনিসিয়া, বলিভিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, দেশে জিডিপি বেড়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। আয় বৃদ্ধির হারও জিডিপি অনুপাতে বাড়েনি। এ বছর জিডিপির হিসাবে সংগতি নেই। অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, যা সচরাচর সম্ভব হয় না। তবে আশার কথা হলো, জিডিপি নিয়ে প্রতি তিন মাসে একটি প্রতিবেদন সরকার প্রকাশ করছে। এতে অর্থনীতির সূচক-সম্পর্কিত একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, যা নীতিমালা প্রণয়নে কাজে লাগানো সম্ভব।
প্রবন্ধকার বলেন, ‘সরকারের ব্যয় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা নেই। জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বাজেটের বরাদ্দ ব্যয়ে সক্ষমতা নেই। তার পরও অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য ব্যয় থেকেই গেছে। এটা অনেকটা সরকারের স্ববিরোধিতা। সরকার একদিকে সংকোচনমূলক ব্যবস্থার কথা বলছে, অন্যদিকে নিজেই বন্ড ইস্যু করে ঋণ নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। বিদেশ ভ্রমণ ও গাড়ি কেনার মতো প্রকল্প আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছে এনবিআর। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের বিশাল অর্থের কেনাকাটা করমুক্ত রাখা হয়েছে। অথচ মেট্রোরেলের ভাড়ায় ভ্যাট আদায়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ধরনের নীতি কতটা যৌক্তিক, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কারণ কর-ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া আমরা দেখেছি সরকারের আয় কম, অথচ ঋণ করছে বেশি। আয় না থাকায় আবার ঋণ করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে। সরকার বৈদেশিক ঋণের দায়ভারে বাহুল্য তৈরি করছে। প্রকৃত অর্থে এমন অনেক বৈদেশিক ঋণ আছে, যার যৌক্তিকতা হয়তো নেই। এ ধরনের বৈদেশিক ঋণ বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাহ্যিক খাতের অস্থিরতা রোধে রেমিট্যান্স বাড়াতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখতে পাচ্ছি না। এযাবৎ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩৫ শতাংশের মতো। আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের দর বৃদ্ধি, সুদহার বৃদ্ধি এবং অফশোর আমানত বাড়ানোর চেষ্টা এ ক্ষেত্রে কাজে আসবে কি না, তার মূল্যায়ন এখনই করা যাচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে ২৮ লাখ লোক প্রবাসে গেছে। সে অনুপাতে রেমিট্যান্স বাড়েনি। অবৈধ পথে হুন্ডি-হাওলার মাধ্যমে রেমিট্যান্সের টাকা দেশে আসছে। অর্থাৎ বড় অঙ্কের প্রবাসী আয় বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বৈধ পথে রেমিট্যান্স না আসায় রিজার্ভে বড় পতন হয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।’
প্রবন্ধে বলা হয়, সরকার এত এত ইকোনমিক জোন করল, কিন্তু সেগুলোতে বিনিয়োগ নেই। ওয়ান স্টপ সার্ভিস কাজ করছে কি না, তার মূল্যায়ন নেই। রিজার্ভ পুনর্গঠন করতে হলে বৈদেশিক বিনিয়োগও লাগবে। কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। সারের স্থানীয় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আমদানি করতে হচ্ছে বেশি। এতে বাড়তি ব্যয়ের দায় পড়ছে কৃষকের ওপর। কৃষিঋণের টাকা প্রাণিসম্পদ ও পোলট্রি খাতে চলে যাচ্ছে। একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে অব্যাহতভাবে দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। বিশেষ করে ধান, সবজি ও ফলমূলের উৎপাদন বেড়েছে। একফসলি জমিকে পুনঃপুনঃ আবাদের আওতায় আনা যেতে পারে। দেশে প্রায় ১১ লাখ একর আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘২০৪১ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির একটি চাহিদা প্রক্ষেপণসংবলিত মাস্টারপ্ল্যান করেছে সরকার। তাতে কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতির কাঠামোগত পরিবর্তনকে আমলে নেওয়া হয়নি। এতে চাহিদার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সিপিডি একটি নিরপেক্ষ চাহিদাবিষয়ক প্রক্ষেপণ করেছে। তাতে দেখা যায়, অর্থনীতির পরিবর্তিত প্রবণতা আমলে নিলে গ্যাস-বিদ্যুতের চাহিদার পরিমাণ কমে আসবে। তাতে সরকারের কষ্টার্জিত আয় সাশ্রয় হবে এবং সে অর্থ অন্য কোনো কল্যাণকর বা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা যাবে।
সিপিডির পক্ষ থেকে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম অবিলম্বে সরকারকে এ মাস্টারপ্ল্যান রিভাইজ করার দাবি জানান।