![নাফ নদীতে মায়ানমারের ‘যুদ্ধজাহাজ’, আতঙ্ক](uploads/2024/06/14/23221222323-1718307710.jpg)
কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদীতে মায়ানমারের ‘যুদ্ধজাহাজ’ দেখা গেছে। এদিকে সীমান্তের ওপার থেকে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে এপারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সীমানায় চলাচলরত নৌযান লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ অবস্থায় ঢাকার পক্ষ থেকে নেপিদোর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশের (বিজিপি) কাছে প্রতিবাদলিপি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, গত বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নাফ নদীর টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়ায় মায়ানমারের কাছে মায়ানমারের জাহাজটি দেখা গিয়েছিল। এরপর রাত ৯টা থেকে এপারে ভেসে আসতে থাকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। গতকাল বৃহস্পতিবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মায়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘যে জাহাজের কথা বলা হচ্ছে সেটি মায়ানমারের জলসীমাতেই আছে। ঢাকার পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়েছে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এর আগে বিভিন্ন ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে অন্তত চারবার তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এবারও রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মায়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজের উপস্থিতি যে এবারই প্রথম তা নয়। এর আগে গত মার্চেও নাফ নদীতে মায়ানমারের যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছিল। যদিও তখন সেটি মায়ানমারের জলসীমাতেই অবস্থান করছিল।
সেন্ট মার্টিনগামী ট্রলারে স্পিডবোট থেকে লক্ষ্য করে মায়ানমারের দিক থেকে গুলি চালানো হয়েছে। এর আগে গত বুধ ও শনিবারে মায়নামার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশি ট্রলারকে লক্ষ্য করে দুই দফায় গুলি চালানো হয়েছে। বিজিপি নাকি সেখানকার বিদ্রোহী কোনো গোষ্ঠী গুলি চালিয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য জানতে পারেনি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলছেন, কারা গুলি করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে গুলি করার ব্যাপারে অস্বীকার করেছে মায়ানমার সরকার।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, ওপার থেকে বাংলাদেশের ভেতরের কয়েকটি নৌযান লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। ফলে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। সংকটের অবসান না হওয়া পর্যন্ত ওই এলাকায় নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
নৌযানে গুলির ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে বিজিপির কাছে। বিজিবি ও কোস্টগার্ড সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
থেমে থেমে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ, আতঙ্ক
স্থানীয়রা বলছেন, বৃহস্পতিবারও থেমে থেমে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। নাফ নদীতে যুদ্ধজাহাজ আসার পর টানা ৩ ঘণ্টা ধরে সীমান্তের লোকজন ওই শব্দ শুনেছেন। তারপর থেমে থেমে রাতভর শোনা গেছে। গতকালও একটু পরপর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এতে বাংলাদেশ সীমান্তের টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এনামুল হক এনাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীমান্তে আমার এলাকায় বুধবার দুপুর থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ওপার থেকে আসা বিকট গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ওপারের সুদাপাড়া ও ডেইলপাড়ায় নাফ নদীতে সে দেশের যুদ্ধজাহাজ দেখা যাচ্ছে। এতে ওই এলাকায় সীমান্তের পাঁচ হাজার মানুষ ভয়ের মধ্য রয়েছে। গ্রামে জরুরি কাজ ছাড়া সীমান্তে কোনো ধরনের মানুষ চলাচল করতে নিষেধ করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তের কাছাকাছি চিংড়িচাষিদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে বিজিবির পক্ষ থেকে।’
টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌরুটে গুলিবর্ষণের বিষয়ে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সার্ভিস ট্রলারকে গুলিবর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপির কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া চলমান পরিস্থিতিতে সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসরত মানুষজনকে নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। এসব এলাকায় বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জেনেছি। জাহাজটি মায়ানমারের অংশে রয়েছে। বর্তমান সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্টরা সজাগ রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।’
ইউএনও বলেন, ‘তিনটি ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিন থেকে দুপুরে ঈদের ছুটি বা বিভিন্ন কাজে গিয়ে আটকা পড়া দুই শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। ট্রলারগুলো মূলত বঙ্গোপসাগর হয়ে টেকনাফে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে ওই ট্রলারেই টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন গেছে দ্বীপের পাঁচ শতাধিক বাসিন্দা।’
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, ‘বিম্ফোরণের শব্দে সীমান্ত লাগোয়া শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাট এলাকাসহ জালিয়াপাড়া, পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া ও আচারবনিয়ার আশপাশের বসতঘর ও স্থাপনা কেঁপে ওঠে। এ সময় সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি বসবাসকারীদের অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে কিছুটা দূরে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসার ঘটনা অব্যাহত থাকায় স্থানীয়দের অনেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। জাহাজটি এখন নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে রয়েছে। বিকেল পর্যন্ত গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।’
সংকটে সেন্ট মার্টিনের ১০ হাজার বাসিন্দা
এই পরিস্থিতিতে সংকটে পড়েছেন সেন্ট মার্টিনের ১০ হাজার বাসিন্দা। সেন্ট মার্টিন থেকে ফেরার পর একটি রিসোর্টের ম্যানেজার ইব্রাহীম খলিল খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাত-আট দিন ধরে খুবই বাজে অবস্থা। চাল ছাড়া সেন্ট মার্টিনে কিছুই মিলছে না। দ্বীপটি এমন এক জায়গায়, যেখানে চাষের সুযোগ নেই। সবকিছু টেকনাফ থেকে আনতে হয়। হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ খুব কষ্টে পড়ে গেছে।’
ইব্রাহীম খলিল আরও বলেন, ‘শুধু কোনো রকমে ভাত রান্না করে খাওয়া যাচ্ছে। বাসিন্দাদের যে সবজির প্রয়োজন বা অন্যান্য সামগ্রীর প্রয়োজন তার কিছুই নেই। প্রশাসন যদি এই মুহূর্তে কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে দ্বীপের বাসিন্দাদের কষ্ট আরও বাড়বে।’
সেন্ট মার্টিন ডিঙ্গি রিসোর্টের ম্যানেজার মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় আট দিন ধরে আটকা ছিলাম। এই মুহূর্তে সেখানকার সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে খাবার। সরকারের উচিত দ্রুত খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা।’
সেন্ট মার্টিনের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে আমাদের বসবাস। টেকনাফে চিকিৎসার জন্য এসে আর ফিরতে পারিনি। মায়ানমার বাহিনীর সংঘর্ষ আমাদের ওপর প্রভাব ফেলছে। দ্রুত সরকারের সহায়তা না পেলে না খেয়ে মরবে দ্বীপের মানুষ।’