![ভাষাশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন](uploads/2023/11/10/1699610794.Mosarraf.jpg)
‘গাঁথিয়া কল্পনা সূত্রে নব গল্প হার
সঁপিলাম বন্ধু গলে নব উপহার’
মীর মশাররফ ছিলেন নব্য-উত্থিত মুসলিম মধ্যশ্রেণির প্রধান সাংস্কৃতিক মুখপাত্র। বিষাদ-সিন্ধু কিংবা জমিদার দর্পণের মতো ধ্রুপদী সাহিত্যের স্রষ্টা মীর মশাররফ হোসেন; যাকে দিয়েই মূলত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম প্রয়াসের সার্থক সূচনা। মুক্ত মন, উদার শিল্পদৃষ্টি, সমাজমনস্কতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা- তার জীবন ও সাহিত্যচর্চায় যেমন, তেমনই সাময়িকপত্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে।
স্বদেশ-মাতৃভাষা-জাতীয়তার প্রশ্নে বিভ্রান্ত রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান সমাজের কোনো প্রতিনিধির কণ্ঠে এমন প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ প্রায় অসম্ভব ও অকল্পনীয় বলে মনে হবে। এদিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে তিনিই বাংলার ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবক্তা বলে স্মরণ করতে হয়। বাংলা ভাষায় তার পারঙ্গমতাকে হিন্দু লেখকগণ অভিনন্দন জানান এই বলে: ‘তার মতো বাংলা অনেক হিন্দু লেখক শিখতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করবেন।’ তিনি কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর উদ্গীরিত কালীগঙ্গা তীরবর্তী লাহিনীপাড়া গ্রামে ১৩ নভেম্বর ১৮৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন; ছদ্ম নাম: গাজীমিয়াঁ। পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাতা দৌলতুন্নেছা। গৃহে মুন্সির কাছে আরবি-ফার্সি শিক্ষার মাধ্যমে মীর মশাররফের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। পরে বাংলা শিক্ষা গ্রহণে পণ্ডিত জগমোহন নন্দীর পাঠশালায়, কুমারখালীর ইংরেজি বিদ্যালয়, পদমদী নবাব স্কুল এবং কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে।
কর্মজীবনে মশাররফ হোসেন প্রথমে ফরিদপুর নবাব এস্টেট এবং পরে ১৮৬৬ সালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার পদে চাকরি করেন। জমিদার পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য এবং স্থানীয় লোক ও কর্মচারীদের সঙ্গে বিবাদের কারণে টাঙ্গাইল ছেড়ে কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং ১৮৬৯ সালে তার প্রথম গ্রন্থ ‘রত্নাবতী’ প্রকাশ করেন।
সব্যসাচী লেখক মীর মশাররফ হোসেন ৭৪টির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার লেখনী প্রসারিত ছিল। গ্রন্থগুলোর অধিকাংশই সমালোচকদের দ্বারা বিশেষ প্রশংসিত হয়। প্রথম গ্রন্থ ‘রত্নাবতী’ প্রশংসা লাভ করে প্রধানত ভাষার জন্য। ‘গোরাই ব্রিজ বা গৌরী সেতু’র সমালোচনা প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। আবারও ওই পত্রিকাতেই সম্পাদক স্বয়ং মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’ গ্রন্থটির সমালোচনা লেখেন। মশাররফ হোসেন প্রণীত প্রথম নাট্যগ্রন্থ ‘বসন্তকুমারী’ সোমপ্রকাশ পত্রিকার সমালোচনায় মুসলমান লিখিত নাটকে অন্য সমাজের ভাষা ও আচারাদি ব্যবহারের প্রশংসা পায়। বেঙ্গল লাইব্রেরির সালতামামি রিপোর্টে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই নাটককে ভালো লেখনী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক ‘বঙ্গদর্শনে’ (১৮৭২) তার গদ্য রচনাবলি ভূয়সী প্রশংসিত হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বিষাদ-সিন্ধু’কে বাংলা ভাষায় রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা রূপে চিহ্নিত করে যথার্থই বলেছেন: “এ গ্রন্থের ‘অন্তর্নিহিত আন্তরিকতা ও বেদনা’, ‘সমুন্নত নীতিবোধ’ এবং ‘মার্জিত রচনাশৈলী’ এ গ্রন্থকে অনন্য সৃষ্টির গৌরব এনে দিয়েছে।” ভারতের জাতীয় অধ্যাপক শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য: ‘মীর মশাররফ হোসেন আমাদের আধুনিক বাঙলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পী।’ জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক ড. এনামুল হক, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ও অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান মনে করেন, ‘মীর মশাররফ হোসেন উনিশ শতকের প্রধান গদ্য লেখকদের অন্যতম।’ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার মশাররফ-জীবনীতে অনুযোগ করে বলেছিলেন: ‘দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের এই প্রতিভাবান সাহিত্যিককে আমরা নামে মাত্র চিনি, জীবনীর এবং জীবনের সকল কীর্ত্তির পরিচয় তাহার স্ব-সমাজের লোকও রাখেন না।’ ব্রিটিশ সরকারও তাকে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করে তার যোগ্যতা ও কর্মের স্বীকৃতি দিয়েছে।
মশাররফের অমর কীর্তি ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (মোহররম পর্ব্ব ১৮৮৫, উদ্ধার পর্ব্ব ১৮৮৭, এজিদবধ পর্ব্ব ১৮৯১) উপন্যাসে কারবালার বিষাদময় ঐতিহাসিক বিস্ময়কর সৃষ্টি। মহররমের বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত মহাকাব্যদর্শী এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক স্থায়ী সম্পদ। বাংলার মুসলমান সমাজের দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর জড়তা দূর করে আধুনিক ধারায় ও রীতিতে সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে তার এই শিল্পকর্মের মাধ্যমেই। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের একটি বহুল সমাদৃত ও জনপ্রিয় গ্রন্থ।
সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা- এই দুই পর্যায়েই মীর মশাররফ হোসেন প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন মূলত ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ সম্পাদক কুমারখালীর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার এবং সেই সঙ্গে কলকাতার ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। মশাররফ তার আত্মকথা আমার জীবনীতে লিখেছেন: “কলিকাতার সংবাদ প্রভাকর সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু রামপ্রাণ গুপ্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ও সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহিত পত্রে পত্রে দেখাশোনা যেরূপ হইতে পারে তাহা আছে। আমি অনেক সংবাদ তাঁহাদের কাগজে লিখিতাম। তাঁহারাও দয়া করে ছাপাইতেন। আমাকে নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন ‘আমাদের কুষ্টিয়ার সংবাদদাতা’।”
নিরপেক্ষ ও সৎ সাংবাদিকতা, লোককল্যাণের প্রয়াস, পল্লিউন্নয়নের চিন্তা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমদর্শী-দৃষ্টিভঙ্গি, প্রয়োজনবোধে সরকার, প্রশাসন, জমিদারের সমালোচনা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশে নির্ভীকতা মীর মশাররফ হোসেনকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। ১৫০ বছর আগে স্বদেশ-মাতৃভাষা-জাতীয়তার প্রশ্নে বিভ্রান্ত রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান সমাজের কোনো প্রতিনিধির কণ্ঠে এমন প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ প্রায় অসম্ভব ও অকল্পনীয় বলে মনে হবে। সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাঙালি মুসলমানের বিলম্বিত আত্মপ্রকাশ ঘটে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-প্রয়াসের সার্থক সূচনা তাকে দিয়েই। ঊনবিংশ শতাব্দীর যে কয়েকজন সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মুসলমান সাহিত্য-সাধক মীর মশাররফ হোসেন। তিনি ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।