![কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে জাপা : চাপা শঙ্কা](uploads/2023/12/01/1701406897.Rowshon_Kader.jpg)
জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্বে এবার দলকে বড় মাশুল দিতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের আশঙ্কা, বরাবরই রওশন এরশাদের দিকে ঝুঁকে থাকা দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বাচনের ঠিক আগে রওশনের দিকে ঝুঁকে যেতে পারেন।
প্রত্যয়ের সঙ্গে শঙ্কার মেঘ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল মোতাবেক বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) ছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। এদিনে জাপার বনানী কার্যালয়ে ছিল রাজ্যের নীরবতা। কজন কেন্দ্রীয় নেতা ঘোরাঘুরি করছিলেন বিক্ষিপ্তভাবে। গত বুধবার রাতে রওশন এরশাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন তারা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তারা কজন কথা বলেন খবরের কাগজের প্রতিবেদকের সঙ্গে।
তাদের কেউ বলছেন, দলের বহিষ্কৃত নেতাদের নিয়ে নির্বাচনের আগে দলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না পেয়ে রওশন এরশাদ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা ভেঙে জি এম কাদের দলকে আওয়ামী লীগের বলয় থেকে বের করে আনায় তাতে রওশন এরশাদ ব্যাকফুটে চলে গেছেন বলে তারা মন্তব্য করেন।
দলের প্রভাবশালী একজন নেতা বলেন, ‘চেয়ারম্যান জি এম কাদের যখন দলকে একটা স্বকীয় অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিংবা গৃহপালিত বিরোধী দলের তকমা মুছে ফেলার জন্য বদ্ধপরিকর, তখন তাতে বাদসেধেছেন রওশন ম্যাডাম। কেবল এমপি হওয়ার জন্য, মন্ত্রী হওয়ার জন্য লালায়িত নই আমরা। ভোটের মাঠে আমরা লড়াই করব। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে তারা কাকে ভোট দেবে। ভোট সুষ্ঠু হলে জাতীয় পার্টির নেতারা কারো দয়াদাক্ষিণ্য ছাড়াই নির্বাচনে ভালো ফলাফল করবেন।’
জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির দুজন নেতা বলেন, ‘গত দুই নির্বাচনে আমরা তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধলাম। লাভ কী হলো? ম্যাডাম আবার তাদের সঙ্গে জোট বাঁধবেন বলে জানালেন। যারা তাকে উসকানি দেন, তারা তো দলের কেউ না। তারা সবাই তাকিয়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের দিকে। আশা করেছিলেন, আওয়ামী লীগ তাদের এমপি বানিয়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েনি। তাই নির্বাচনের পথ থেকে সরে গেলেন সবশেষে।’
জি এম কাদের শিবিরে মনোনয়ন প্রক্রিয়ার তোড়জোড় শুরু হলে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ নির্বাচনী ইস্যুতে আলোচনা করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন। চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে কোনোভাবে কোণঠাসা করতে না পেরে তিনি ভরসা করছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে৷ রওশনপন্থি নেতাদের মনোনয়ন ও সংসদ সদস্য পদ নিশ্চিত করাও ওই বৈঠকের অ্যাজেন্ডা ছিল বলে জানা যায়। তবে প্রধানমন্ত্রী নিরাশ করেন রওশন এরশাদকে। জাপার গৃহবিবাদে এবার তিনি মধ্যস্থতা করতে আসেননি।
জি এম কাদেরের অনুসারীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেনদরবারে রীতিমতো শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে রওশন এরশাদ অনুসারীদের। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে গেলেন তারা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া জাপা শেষ পর্যন্ত ২৮৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। জাপা মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ভোটের মাঠের পরিবেশ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে জাতীয় পার্টি অধিকাংশ আসনে বিপুল ভোটে জয়ী হবে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা তো এখন সরকার গঠনের চিন্তায় বিভোর।’
দলের মহাসচিবের কণ্ঠে প্রত্যয়ের সুর ধ্বনিত হলেও শীর্ষ নেতাদের নানা কর্মকাণ্ডে দলে তৈরি হয়েছে নানা অসন্তোষ। মনোনয়ন প্রক্রিয়া কার্যক্রম যখন চলমান, তখন দলের কো চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যদের অনেকে রওশন এরশাদের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক চালিয়ে যান। এ নিয়ে এক প্রশ্নে মুজিবুল হক চুন্নু দাবি করেছেন, দলের কোনো নেতাকর্মী জি এম কাদেরের বলয়ের বাইরে নন। তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন কথা বলছে।
রওশন এরশাদের গুলশানের বাসভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার নিয়মিত গিয়েছেন রওশনের বাড়িতে৷ জাপার সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে নানা দূতিয়ালি চালিয়ে গেছেন, সে তৎপরতা দৃশ্যমান। গত বুধবার রাতে রওশন আরা মান্নান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপরে তিনি যান রওশন এরশাদের বাসায়। রওশন এরশাদ তার সঙ্গে সাক্ষাতের আড়াই ঘণ্টা পরে ব্রিফিংয়ে জানান, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না।
জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা রওশন আরা মান্নানের ওই বৈঠক নিয়েও গতকাল আলোচনা হয়েছে দলে। গত ১৬ নভেম্বর জাতীয় সংসদ অধিবেশন শেষে তার নেতৃত্বেই দলের ১৬ জন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যান। ওই বৈঠকে ছিলেন না জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। নির্বাচনের আগে দলের বিভক্তি তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রওশন আরা মান্নানের বুধবারের তৎপরতায় শঙ্কা জেগেছে, তার নেতৃত্বে দলের বর্তমান সংসদ সদস্যরা আবার না রওশন এরশাদকে সমর্থন করে বসেন।
১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। মনোনয়ন পাওয়া শীর্ষ নেতারা শিবির বদল করতে পারেন, এমন গুঞ্জনও দলে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে জি এম কাদের শিবির থেকে চট্টগ্রাম-৯ আসনের জন্য মনোনয়ন পাওয়া সানজিদ রশিদ চৌধুরী রওশন এরশাদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তবে দলের নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডে আশঙ্কাবোধ করছেন না দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু্।
তিনি খবরের কাগজকে বলেন, জি এম কাদেরের নেতারা কেউ ওদিকে ভিড়ছেন বলে জানা নেই৷ যদি এমনটা হয়েই থাকে, তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।
রওশন এরশাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ায় দল কী ভাবছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক৷ ওনার স্বাধীনতা রয়েছে নির্বাচন করবেন কি করবেন না। তবে তিনি নির্বাচনে না এলে দলে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
রওশন এরশাদের নির্বাচনী সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘ম্যাডাম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে কোনো আলোচনা হয়নি আমরা সবাই এখন নির্বাচনমুখী তৎপরতায় ব্যস্ত।’
শেষ হয়েও হলো না শেষ
নির্বাচনী তোড়জোড় শেষ হয়ে গেলেও রাজনৈতিক তৎপরতায় জি এম কাদের শিবিরকে চাপে রাখতে নানা কৌশল নিচ্ছে রওশন শিবিরে। গত সোমবার জাপার মনোনয়ন ঘোষণার পরে রওশন শিবির দলে পঞ্চম দফা ভাঙনের দাবি করেন। তারা বলেছিলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে দলের আলাদা কাউন্সিল করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। এ নিয়ে রওশন শিবিরে জোর প্রস্তুতি চলছে। গতকাল রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ জানান, আগামী দু-একদিনের মধ্যে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন রওশন এরশাদ।